শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
‘খালেদা জিয়াকে প্রধান উপদেষ্টার সম্মান দেয়া সততার পুরস্কার’ ফ্যাসিস্ট সরকারের সব অন্যায়ের বিচার হবে : ডা. জাহিদ কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা

ড. কাজী দীন মুহম্মদ: বিশ্বাসী কীর্তিমান মনীষী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জুবাইর আহমদ আশরাফ ।।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ ছিলেন একজন উচ্চস্তরের শিক্ষাবিদ। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ভাষাবিজ্ঞানী। তার পর্যায়ের ধ্বনিবিজ্ঞানী ও ভাষাতত্ত্ববিদ সারা পৃথিবীজুড়ে ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। কিন্তু তার এসব পরিচয় আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অন্য একটি পরিচয়ের কারণে। তা হলো, তিনি ছিলেন ইসলামের একজন নিষ্ঠাবান অনুসারী, একজন খাঁটি মর্দে মুমিন।

সে জন্য এত বড় পন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও জাতীয়তাবাদী কারো কাছেই উপযুক্ত কদর পাননি। আসলে ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর তুচ্ছ সম্মান তিনি কামনাও করেননি। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আফসোসও তার মাঝে ছিল না। তিনি যা চেয়েছেন, তা পেয়েছেন।

তিনি জীবনের শেষ দিকে এসে বহুবার বলেছেন, আমার জন্য একটাই দোয়া করুন-আল্লাহ পাক যেন আমার প্রতি রাজি খুশি থাকেন এবং আমার পরকালের জীবন যেন শান্তিময় হয়। মৃত্যুর চার পাঁচ বছর পূর্বে অসুখে পড়ে একদিন তিনি বলেছেন, ‘আমার জন্য শুধু দুআ করবেন-হায়াতে তাইয়েবা ও রেজায়ে মাওলার।’

হাদীস ও কুরআনের ভাষ্যমতে বুঝা যায়, তিনি হয়তো রেজায়ে মাওলা লাভ করেছেন। কারণ আল্লাহ পাক যার প্রতি সন্তুষ্ট হন তাকেই এবাদত-বন্দেগী করার সুযোগ দান করেন। তিনি সারা জীবন, বিশেষত জীবনের শেষ সময়ে প্রচুর পরিমাণে এবাদত-বন্দেগী করেছেন। তার ন্যায় জাতীয় পর্যায়ের পন্ডিত ও মনীষী মারা গেলে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সম্মান দেখানো কর্তব্য, আমাদের রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা তা প্রদর্শন করেননি। তার পরশে ধন্য বাংলা একাডেমী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিক্ষাবোর্ড, আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তা করেনি।

এমনকি, তার কাছ থেকে শিক্ষা লাভকারী শত শত ছাত্র, যারা এখন ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠিত, তারাও তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হননি এবং তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেননি। মূলত এদের কাছ থেকে তিনি সম্মান আদৌ কামনা করেননি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তার সম্পর্ক ছিল ধর্মপ্রাণ লোকদের সঙ্গে। তারা দীন মুহম্মদ সাহেবের জানাজা ও দাফনকার্যে উপস্থিত হয়েছেন এবং তার জন্য অনেক দোয়া করেছেন।

আমাদের বিশ্বাস, শত শত মর্যাদাবান ফেরেশতা তার মৃত্যুর সময় তার সম্মানার্থে উপস্থিত হয়েছেন এবং তার কল্যাণ কামনা করে তার জন্য প্রার্থনা করেছেন। সকলের সম্মিলিত প্রার্থনায় হয়তো তিনি কবর জীবনে শান্তিতে আছেন। আশা করি, আল্লাহ পাক তাঁর সব ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করবেন।

কাজী দীন মুহম্মদ পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকে আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাই জন্মসূত্রেই তিনি নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার শিক্ষা পান। তার পিতার নাম কাজী আলীম উদ্দীন এবং দাদা মাওলানা কাজী গোলাম হোসাইন। তার দাদা ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম। দীন মুহম্মদ সাহেবের মাতার নাম মুসাম্মৎ কাওসার বেগম। তার নানা হলেন সোনারগাঁয়ের বিখ্যাত পীর মাওলানা শরাফতুল্লাহ চিশতী।

তিনি শৈশবে মায়ের কাছে আলিফ-বা-তা-এর শিক্ষা লাভ করেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পূর্বেই তিনি মায়ের কাছে সূরা ফাতিহাসহ কুরআনের শেষের দিকের ছোট ছোট অনেক সূরা এবং নামাজের প্রয়োজনীয় দোয়া ইত্যাদি মুখস্থ করে ফেলেন। তার মা-ই তাকে নামাজ-রোজার নিয়ম শিক্ষা দেন এবং নামাজ-রোজার গুরুত্ব বুঝান। এর ফলেই কাজী দীন মুহম্মদ চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায়ে যত্নবান ছিলেন।

আর যে বছর তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়েন সে বছর রমজানের তিনটি রোজা রাখেন। এর পরের বছর পুরো ত্রিশটিই রাখেন। সেই যে ত্রিশটি রোজা রাখা শুরু করেন জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত কখনো এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি যেখানে যে অবস্থায়ই ছিলেন, এমনকি প্রতিকূল পরিবেশেও নামাজ-রোজা কখনো তরক করেননি। তিনি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে কবি নজরুল সরকারী কলেজ) সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন।

কলেজের নিকটবর্তী কলতাবাজার মহল্লায় স্কুল সেকশনের ছাত্রদের হোস্টেল ছিল। এ হোস্টেলেই তিনি থাকতেন। হোস্টেলের নিকটবর্তী মসজিদে প্রতিদিন জামায়াতের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। এখানে থাকা অবস্থায় এক রাতে হোস্টেলে পুরস্কার বিতরণী ও ড্রামা হয়। শুতে বারটা বেজে যায়। পরের দিন সূর্য উঠার পর তার ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠার পর তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কিন্তু বন্ধুরা এত কান্নার কারণ জানতে পীড়াপীড়ি করলেও তিনি প্রকৃত কথা বলেননি। শৈশব থেকেই তিনি রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস করেন। ফজরের সময় হলেই তার আম্মা তাকে জাগিয়ে দিতেন। এ অভ্যাস তিনি আজীবন লালন করেছেন।

মরহুম কাজী দীন মুহম্মদের বয়স যখন নয় বছর শুরু হয় তখনই তার পিতার ইন্তেকাল হয়। এরপর থেকে তিনি মায়ের স্নেহের ছায়ায় লালিত-পালিত হন। দীনদার ও তাহাজ্জুদগোজার মায়ের আদেশ উপদেশ ও সুশিক্ষাই তার জীবনে প্রতিফলিত হয়।

কাজী দীন মুহম্মদ সাহেব ছিলেন অতিমাত্রায় মাতৃভক্ত। জীবনের যাবতীয় কাজ তিনি মায়ের পরামর্শ অনুযায়ী করতেন। তিনি ‘আমার জীবনে মায়ের অবদান’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। এ প্রবন্ধে তার মায়ের উপদেশ কীভাবে তাকে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে নিয়ে গেছে তার আনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে।

প্রবন্ধখানি সুখপাঠ্য-পড়লে হৃদয় বিগলিত হয়। শুরুর দিকে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মা জীবনের সকল পার্থিব সুখ ত্যাগ করে তার সবকিছু উজাড় করে আমাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি অধম। তাই তার ত্যাগের সবটুকুর সুযোগ পেয়েও তার সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। কারণ তিনি যা চেয়েছিলেন, তা কি হতে পেরেছি? তিনি তার সন্তানকে যেখানে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, তা কি দেখে গেছেন? তবে এ কথা স্বীকার করি, জীবনে যেটুকু হতে পেরেছি, যে যৎসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছি তার সবটুকুই আমার মায়ের প্রাপ্য।

প্রবন্ধটির একেবারে শেষে লিখিত হয়েছে- ছাত্রজীবন পেরিয়ে সংসার জীবনে প্রবেশ করার পরও একের পর এক হিমালয়ের মত বিশাল তুফানের ঝাপটা এসে আমার জীবনতরী ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে চেয়েছে। তখনো আমার মা নির্ভীক নাবিকের মত হাল ধরে এ অসহায় যাত্রীকে অকূল পাথার থেকে উদ্ধারের প্রয়াসে তওহীদী অঙ্গুলি নির্দেশে কূলের সন্ধান দিয়েছেন। বিয়াবান মরু সাহারায় যখন একাকী পথহারা পথিকের মত নিরাশ হয়ে জীবনের আশার ক্ষীণ আলোর রশ্মিটুকুও দেখতে পাইনি, সেই অতি কঠিন দুঃসময়ে আমার মহিয়সী মা ধ্রুব নক্ষত্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে দিয়েছেন, ওই তো আলো। ‘নিরাশ হয়ো না রে দরগাহে আল্লাহর। আল্লাহর নিরানববই মায়া থাকে উপরে বান্দার।’

দেশকে ভালবেসে দেশের দুশমন হয়েছি, পল্লী জননীকে ভালবেসে প্রতারিত হয়েছি, মানুষকে ভালবেসে আঘাত পেয়েছি, কিন্তু মাকে ভালবেসে সব ভুলে গেছি। তার করুণাধারা আমাকে শাণিত করেছে ইস্পাতকঠোর, আমার চরিত্রে এনে দিয়েছে হিমালয়ের সাহস। আজ তিনি নেই, কিন্তু তিনি সব সময় আমাকে আগলে রেখেছেন। বোধ করি, মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত মহিমাময় শান্ত সমাহিত দৃষ্টিতে তিনি কাছে টেনে নিবেন।

কাজী দীন মুহম্মদ মরহুমের এ প্রবন্ধ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। বিশিষ্ট কবি ও গদ্যশিল্পী মরহুম প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান ‘কাজী দীন মুহম্মদের পরিচয়’ নামক প্রবন্ধে ২০০৪ সনে লিখেছেন- ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পত্রিকা অগ্রপথিক একবার একটি আলোচনা প্রবর্তন করেছিল। দেশের কিছু সংখ্যক সম্মানিত ব্যক্তিদেরকে তাঁদের মাতা সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করতে বলা হয়েছিল। অনেকের লেখাই এতে ছিল। কিন্তু আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম দীন মুহম্মদের প্রতিবেদনে। গল্পের মত সহজ এবং সাবলীল ভঙ্গিতে মাতার প্রতি তার আন্তরিক অনুভূতিকে তিনি প্রকাশ করেছেন। তিনি তার শৈশবের অনেক ঘটনার উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে, চিরকাল মাতার আদেশ ছিল তাঁর জন্য শিরোধার্য। এ প্রবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কাছে পেয়ে একদিন বলেছিলাম, তোমার মাতার প্রতি যে অনুভূতি তুমি প্রকাশ করেছো তা সত্যি আমাকে অভিভূত করেছে।

ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন এখানে তিনি শ্রী সুশীল কুমার দে, শ্রী গণেশচন্দ্র বসু ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ মনীষী ও পন্ডিতকে শিক্ষক হিসেবে পান। শহীদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে তার পূর্ব থেকেই পরিচয় ছিল। শহীদুল্লাহ সাহেব পন্ডিত হওয়ার পাশাপাশি ধর্মপরায়ণও ছিলেন। ছাত্র কাজী দীন মুহম্মদের পড়ালেখার প্রতি উৎসাহ এবং পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় শহীদুল্লাহ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি দীন মুহম্মদ সাহেবকে অতিমাত্রায় স্নেহ করতে থাকেন। এমনকি, সহপাঠীরা তাকে শহীদুল্লাহ সাহেবের নাতনী জামাই বলে ঠাট্টা করত।

কাজী সাহেব তার শিক্ষকদের মধ্যে মরহুম মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করতেন। তার আন্তরিক অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার ফলেই তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। শহীদুল্লাহ সাহেবই তাকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করার অনুপ্রেরণা দান করেন।

ভাষাতত্ত্বের তিনটি ধারা রয়েছে। প্রথমত বর্ণনামূলক ধারা। একে আধুনিক ভাষাতত্ত্বও বলা হয়। দ্বিতীয়ত তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এবং তৃতীয়ত ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব। কাজী দীন মুহম্মদই প্রথম ব্যক্তি-যিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্গুইজটিকস এন্ড ফনিটিকস বিভাগে আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বে বাংলা ভাষার ক্রিয়ারূপ নিয়ে গবেষণা করে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। এর পূর্বে ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উভয়েই তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে গবেষণা করে ডিগ্রী অর্জন করেন।

কাজী দীন মুহম্মদ ১৯৬১ সালে লন্ডন থেকে ডক্টরেট লাভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পুনরায় যোগদান করেন। এখানে তিনি প্রায় বত্রিশ বছর যাবৎ শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর কিছুদিন তিনি ঢাকার দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্বও পালন করেন।

কাজী দীন মুহম্মদ সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করলেও ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও গ্রন্থ প্রণয়নে জীবনের অনেক বড় অংশ ব্যয় করেছেন। তিনি ইসলামী সাহিত্যের যে বিশাল ভান্ডার গড়ে দিয়ে গেছেন, সমকালে তার তুলনা বিরল। তিনি প্রতিটি লেখাই প্রচুর পরিশ্রমের মাধ্যমে তৈরি করেছেন। তার রচনার প্রতিটি বাক্যই আঁটসাট সুগ্রন্থিত ও সুদৃঢ়।

বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমের গদ্যের ন্যায় তার গদ্য প্রকৃষ্ট বন্ধনে সমৃদ্ধ। তিনি এক অনন্যসাধারণ গদ্যশৈলীর রূপকার। যেহেতু তিনি ধ্বনিবিজ্ঞানেও পারদর্শী ছিলেন তাই তার সুগঠিত বাক্যের প্রতিটি শব্দই ধ্বনিতত্ত্বের আওতায় সংযোজিত হয়েছে। এজন্যই তিনি একজন মহত্তম গদ্যশিল্পী ও প্রাবন্ধিক।

তার রচিত ইসলাম বিষয়ক কিছু গ্রন্থের নাম প্রকাশকালসহ এখানে উল্লেখ করা হল।

মানবমর্যাদা, ১৯৬০; সুফীবাদ ও আমাদের সমাজ, ১৯৬৯; জীবনসৌন্দর্য, ১৯৮১; সূফীবাদের গোড়ার কথা, ১৯৮০; মানবজীবন, ১৯৮০; প্রতিবর্ণায়ন নির্দেশিকা, ১৯৮২; শিক্ষা, ১৯৮৯; ইসলামী সংস্কৃতি, ১৯৮৯; বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব, ১৯৯০; বিচিত্র প্রবন্ধ, ১৯৯১; জুমুআর ঘরে, ১৯৯১; নাস্তিকতা ও আস্তিকতা, ১৯৯৩; আমি তো দিয়েছি তোমাকে কাউসার, ১৯৯৩; মহানবীর বাণী শতক, ১৯৯৮; বিধান তো আল্লাহরই, ১৯৯৯; ছোটদের হযরত মুহাম্মদ (সা), ১৯৯৯; বিসমিল্লাহর তাৎপর্য, ২০০০ ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘মানবজীবন’ ও ‘জীবনসৌন্দর্য’ এ দুটি গ্রন্থ নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করা হল।

‘মানবজীবন’ গ্রন্থখানি ১৯৮০ সনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৮০। এ গ্রন্থে যেসব বিষয় স্থান পেয়েছে তা যথাক্রমে নিম্নরূপ : ইসলাম, ঈমান, কালিমা, আল্লাহ, ফিরিশতা, কিতাব, কুরআনের মৌলিক শিক্ষা, রাসূল, হাদীস, আখেরাত, ইবাদত, যাকাত, জিহাদ, শাহাদাত, তকদীর ও কর্মে স্বাধীনতা, ইসলামে জ্ঞানসাধনা, ইসলামে মুক্ত বুদ্ধির ভূমিকা, ইসলামে মানুষের মর্যাদা, ইসলামে মানবের মৌলিক অধিকার, ইসলামে নারীর মর্যাদা, ইসলামে হক্কুল ইবাদ, ইসলামে শিষ্টাচার, ইসলামে গার্হস্থ্য জীবন, ইসলামে কর্ম, শ্রমের মর্যাদা, ব্যবসা বাণিজ্য, সমাজকল্যাণ, আনুগত্য ইত্যাদি।

এসব প্রবন্ধের স্বরূপ ও তাৎপর্য কী, তা লেখকের মুখ থেকেই শুনুন :

‘ধর্ম ইংরেজি রিলিজিয়্যন কথাটার প্রতিশব্দ নয়, সামগ্রিক জীবনবোধের অভিব্যক্তি। জীবনের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত হয়ে মানুষ কিভাবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে, ইহকালে ও মানবজীবনে চিন্তা ও কর্মের প্রভাব কতখানি এবং ইসলামী জীবনধারার ব্যবহারিক মূল্যবোধের স্বরূপ কি তা সংগৃহীত প্রবন্ধগুলোতে সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে।’

‘জীবনসৌন্দর্য’ গ্রন্থখানি ১৯৮১ সনে একই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৫৬। এখানে সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যবোধ, দায়িত্বজ্ঞান, সহনশীলতা, আত্মবিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি, দেশপ্রেম ইত্যাদি মানবিক গুণ নিয়ে প্রায় চল্লিশখানি সারগর্ভ প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। লেখক মুখবন্ধে বলেছেন, ‘এ জীবন ও জগৎ উদ্দেশ্যবিহীন সৃষ্টি নয়। জ্ঞানের অনুশীলনের মাধ্যমে সৃষ্টির রহস্য উপলব্ধি করে ইহজীবন ও পরজীবনে শান্তির পথ খুঁজে পায় যে জীবন তা-ই প্রকৃত মনুষ্য জীবন। স্রষ্টার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সে জীবনই হয়ে ওঠে সার্থক। রাসূলে কারীম যে বলেছেন : তাখাল্লাকু বি-আখলাকিল্লাহ-আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও, এ কথার সার্থক রূপায়ণ সে জীবনেই সম্ভব, যে জীবন শিক্ষার আলোকে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ ও পরহিতে নিয়োজিত। সে জীবনই সুন্দর জীবন। সে জীবনই মানুষের কাম্য। পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা সাধনায় জীবনে সফলকাম হওয়ার জন্য, ব্যবহারিক জীবনে অনুশীলনযোগ্য, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কতিপয় প্রবন্ধের সংকলন ‘জীবনসৌন্দর্য।’

প্রজ্ঞাবান মনীষী কাজী দীন মুহম্মদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনুদিত ও প্রকাশিত কুরআন, বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, তিরমিযী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, মোয়াত্তা, হেদায়া, আলমগীরী, ফাতাওয়া ও মাসাইল ইত্যাদি বহু বৃহৎ গ্রন্থের সম্পাদনার জন্য গঠিত বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

বোর্ডের প্রবীণ আলেম সদস্যদের সঙ্গে বসে প্রধানত তিনি ভাষা ও শব্দ প্রয়োগের উপযোগিতা এবং মর্ম ব্যক্ত করায় শব্দের ভূমিকা নিয়ে কাজ করতেন।

মরহুম কাজী দীন মুহম্মদের ইসলামের নানা দিক নিয়ে লেখা উন্নতমানের চিন্তামূলক ও গবেষণামূলক বহু প্রবন্ধ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত অগ্রপথিক, ত্রৈমাসিক ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অধুনালুপ্ত ঐতিহ্য ও সীরাত স্মরণিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এগুলো গ্রন্থিত হওয়া প্রয়োজন।

আধুনিক শিক্ষিত লোকেরা ইসলাম নিয়ে লেখালেখি করলে তাদের দ্বারা কখনো কখনো ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে কাজী সাহেব ছিলেন বেশ ব্যতিক্রম। এর অন্যতম কারণ হল, এ দেশের হক্কানী ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ ও মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছেন। হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা মুফতী দীন মুহাম্মদ খান, মাওলানা আবদুল ওয়াহাব পীরজী হুজুর, হযরত হাফেজ্জী হুজুর, বাইতুল মুকাররমের ভূতপূর্ব খতীব হযরত মাওলানা মুফতী আবদুল মুঈজ, আজিমপুরের মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, বাইতুল মুকাররমের সাবেক খতীব হযরত মাওলানা উবায়দুল হক, মাওলানা আমীনুল ইসলাম, মাওলানা রিজাউল করীম ইসলামাবাদী, মালিবাগের মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ ও মরহুম মাওলানা ইসহাক ফরিদী প্রমুখের সঙ্গে তার হৃদয়ের নিবিড় সম্পর্ক ছিল।

কাজী দীন মুহম্মদ সাহেব অনেক আলেম-ওলামার ব্যক্তিত্ব, দীনী খেদমত ও অবদান নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক অনেক লেখা লিখেছেন। তন্মধ্যে যশোরের মাওলানা মুনশি মেহেরুল্লাহ, নোয়াখালীর মাওলানা মুসতাফীজুর রহমান, হযরত হাফেজ্জী হুজুর, হযরত মাওলানা উবায়দুল হক ও চরমোনাইর মরহুম মাওলানা ফজলুল করীম সাহেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেবের দরসে বুখারী শরীফের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকে হযরতের অবদান নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন।

এদেশের কওমী মাদরাসাগুলো বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও চিন্তাধারার সূতিকাগার। এসব প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজী সাহেব ভাবতেন এবং অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতেন। তিনি অনেক কওমী মাদরাসার সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন। বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও চিন্তাধারার অধিকারী কাজী দীন মুহম্মদ আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানকেও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন।

এই মহান শিক্ষাবিদ বহুবার বলেছেন, ঢাকার নন্দীপাড়ায় তার কয়েক বিঘা জমি আছে। সেখানে তিনি একটি কওমী মাদরাসা ও মসজিদ নির্মাণ করবেন। তিনি জীবদ্দশায় তা দেখে যেতে পারেননি।

শিক্ষানুরাগী এই কর্মবীর ও ইসলামী চিন্তাবিদ ১৯২৭ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিগত ২৮ অক্টোবর ২০০১ জুমাবার দিবাগত রাত পৌনে বারটায় ইন্তেকাল করেন। পরদিন জোহরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রূপসীর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।- মাসিক আল কাউসার।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ