সাইদ আহমদ ।।
ইউরোপীয় এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার এই আগ্রাসনের যুগে মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক ইউনানী চিকিৎসা-শাস্ত্রকে যিনি তার নিরলস সাধনা ও কর্মপ্রচেষ্টা দ্বারা আধুনিক বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন তিনি হলেন পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক হাকীম মুহম্মদ সাঈদ রহ.।
১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসে দিল্লীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দু’বছর বয়সে পিতার স্নেহহছায়া থেকে তিনি বঞ্চিত হন এবং বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন। শুরুতে তার মুখে প্রচণ্ড রকমের জড়তা ছিলো। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও লাগাতার মশক-অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি জন্মগত এই ত্রুটি থেকে মুক্তি লাভ করেন।
তখন থেকেই তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও ‘দৃঢ় প্রতিজ্ঞতা’র বিষয়টি সবার সামনে আসে এবং মানুষ বুঝতে পারে, বড় কিছু একটা করার জন্যই পৃথিবীতে তার আগমন। পিতা দিল্লীতে হামদর্দ নামে যে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রেখে গিয়েছিলেন, দু’ভাই মিলে সেটিকে এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেন। মূলত দু’ভাইয়ের অপরিসীম ত্যাগ ও সাধনার কল্যাণেই বিভাগপূর্ব ভারতে হামদর্দ এর নাম ছড়িয়ে পড়ে।
পকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্ন পর্যন্ত হামদর্দ এশিয়ার বৃহত্তম ঔষধি প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি অর্জন করেছিলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি তার ব্যবসা-বাণিজ্য ও সচ্ছল আয়েশী জীবনের মোহ ত্যাগ করে, সর্বোপরি ভারত সরকারের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে করাচি চলে আসেন। দিল্লীতে তিনি বিলাসবহুল গাড়ীতে আরোহণ করতেন, অথচ করাচিতে পায়ে হেঁটে রূহ আফজা শরবত বাজারজাত করার চেষ্টায় তাকে নামতে হয়েছিলো।
ইউনানী চিকিৎসাকে তার প্রাপ্য অবস্থানে অধিষ্ঠিত করা ছিলো হাকীম সাঈদের একমাত্র মিশন। হামদর্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা ছিলো এই মিশনের পথে প্রথম জোরালো পদক্ষেপ। কিন্তু যত সহজে বলা হলো তত সহজ ছিলো না বিষয়টি। পদে পদে তাকে এমন সব প্রতিকূলতা ও জটিলতার মোকাবেলা করতে হয়েছিলো যা কল্পনা করলেও অবাক লাগে যে, কোন রকম সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একজন মাত্র মানুষের পক্ষে কীভাবে তা সম্ভব হয়েছিলো!
তার আরেকটি বড় পদক্ষেপ হলো হামদর্দ তিব্বিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা। এটি ছিলো ইউনানী চিকিৎসার আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে অতি সাহসী একটি পদক্ষেপ। এখান থেকে আধুনিক চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন বহু ইউনানী চিকিৎসক উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন, যারা অল্প খরচে সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন; যারা ‘জীবিকার চেয়ে সেবা বড়’ হাকীম মুহাম্মাদ সা‘ঈদের এ জীবনমন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে নিজ নিজ জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন।
একসময় তিনি সিন্ধুপ্রদেশের গভর্নর হয়েছেন; প্রেসিডেন্ট যিয়াউল হকের মন্ত্রিসভায় শামিল হয়েছেন, কিন্তু তখনো তিনি রোগী দেখা বন্ধ করেননি। তখনো পাকিস্তানের প্রায় ছয়টি শহরে রুটিনমত সকাল থেকে সন্ধ্যা রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র দিতেন। এজন্য জীবনে কখনো তিনি কোন সম্মানী গ্রহণ করেননি। এমনকি দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধেরও ব্যবস্থা করেছেন। দীর্ঘকাল থেকে অভ্যাস ছিলো, তিনি রোযা রেখে দাওয়াখানায় বসতেন, যাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা একটানা রোগী দেখতে পারেন। তাছাড়া তার উদ্দেশ্য ছিলো, যাতে রোযার ওছীলায় আল্লাহ তা‘আলা তার চিকিৎসায় বরকত, শিফা ও আরোগ্য দান করেন।
হামদর্দ ন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি শিক্ষা ও সামাজিক বিভিন্ন অঙ্গনে বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। তার মধ্যে ইউনানী চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর মৌলিক গবেষণাকর্ম ছিলো অন্যতম। এ উদ্দেশ্যে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাপক আকারে আন্তর্জাতিক সেমিনার-সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। বেশ ক’টি মাসিক, সপ্তাহিক পত্রিকা ও গবেষণাপত্র এবং চিকিৎসা ও বিভিন্ন বিষয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেছেন।
জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ‘মাদীনাতুল হিকমাহ’ নামে একটি শিক্ষাশহর গড়ে তুলেছেন। শিশুশিক্ষা ও শিশুপরিচর্যা বিষয়ে তার অস্থিরতা ছিলো লক্ষ্য করার মত। জীবনের শেষ পর্বকে, বলা যায় শিশুদের জন্য তিনি ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। শিশুদের প্রতি তার ভালোবাসা ও মমতা ছিলো অপরিসীম। তিনি বলতেন, শিশুদের মহানরূপে গড়ে তোলো, পাকিস্তান নিজে নিজেই মহান হয়ে যাবে। শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা ও পরিচর্যার জন্য হামদর্দ ফাউ-েশনের পক্ষ হতে নওনেহাল নামে একটি মাসিক শিশুতোষ পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।
হাকীম মুহম্মদ সা‘ঈদ তার জীবনের শেষ ইচ্ছা এভাবে ব্যক্ত করেছিলেন, ‘আমি এ অবস্থায় মউতের ফিরেশতাকে ইসতিকবাল করতে চাই যে, আমার স্কুলে হাজার হাজার বাচ্চা আদর্শ শিক্ষা অর্জন করছে। আমার হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার যুবক আদর্শ মানুষ হয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং জীবনের সকল অঙ্গনে হকের আওয়ায বুলন্দ করছে।
১৭ অক্টোবর ১৯৯৮ খুব ভোরে এক সন্ত্রাসী হামলায় তিনি শাহাদত বরণ করেন। তার আকস্মিক মর্মান্তিক মৃত্যুতে সমগ্র পাকিস্তান যেমন শোকাহত হয়েছে তেমনি পৃথিবীর সকল শান্তিপ্রিয় মানুষ গভীর শোক প্রকাশ করেছে। আল্লাহ তাকে বেলা হিসাব জান্নাত নসীব করুন এবং তার কাজকে স্থায়িত্ব দান করুন, আমীন।
আরএম/