আওয়ার ইসলাম: তাবলিগ। তাবলিগ জামাত। তাবলিগ জামাতের সাথী এবং তাদের মেহনত। এ শব্দগুলো শুনলেই কিসে যেন মন ছুঁয়ে যায়। শিহরণ জাগায় মনে। আবেশ ও আবেগে প্রাণ ফিরে আসে। কিন্তু কেন?
এর একটাই কারণ। তাদের নিঃস্বার্থ মেহনত, প্রাণজুড়ানো হাসি, মায়াবী চেহারা আর প্রণয়মাখা হাতের ছোঁয়া, ছোঁয়ে দেয় লাখ পথ হারা মানুষের প্রাণ।
তাবলিগের সাথী ভাইদের প্রেমের পরশ, কোনও দলমত কিংবা কোনও জাতি-গোষ্ঠির জন্য নির্দিষ্টি নয়। ফকির থেকে ধনী, আমির থেকে নওকর, গরিব থেকে কোটিপতি, রিক্সাওয়ালা থেকে বিমানের পাইলট, জাহাজের নাবিক থেকে থেকে ডিঙি নাওয়ের মাঝি, ধর্মপ্রাণ মুসলমান থেকে সিনেমার তারকা, সাধারণ চাকরিজীবি থেকে মন্ত্রী-মিনিস্টার, সাংবাদিক থেকে ক্রিকেটার সবাই-ই তাদের প্রেমের আধার। সবাইকেই তারা দেখেন প্রণয়ের চোখে।
প্রেম বিলানোর ক্ষেত্রে তারা কাউকেই আলাদাভাবে দেখেন না। যাকেই তারা জীবন প্রকৃত স্রোতধারা থেকে দূরে দেখেন , তাদের আদরে ও ভালবাসায় ফিরিয়ে দেন জীবন প্রকৃত স্রোতধারা।
মেহনতি তাবলিগী ভাইদের এ ভালবাসায় যেমন সোনালি জীবনের সন্ধান পেয়েছেন, সিনেমার তারকা, সঙ্গীত পরিচালক, সিনেমা পরিচালক। তেমনি তাদের ভালবাসায় সোনালি জীবনের সন্ধান পেয়েছেন বেশ কিছু ক্রিকেটার। আজ আমরা সোনালি জীবনের সন্ধান পাওয়া কিছু ক্রিকেটারের জীবনপাতা ছুঁয়ে আসবো।
আফতাব আহমদ: বাংলাদেশ জাতীয় দল ও আইসিএল এর হয়ে মাঠ কাপানো এ খর্বকায় ক্রিকেটারকে কে না চেনে? বিভিন্ন কারণে ক্রিকেটের সঙ্গে তিনি ততোটা সক্রীয় নন। কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে যে দাগ গেছেন তিনি তা কি ভোলার মতো?
ক্রিকেট মাঠের ঝড় তোলা এ ব্যাটসম্যান নিজের জীবনধারাকে ইসলামের ছোঁয়ায় পাল্টে নিয়েছেন। পাল্টে নিয়েছেন সখ, আহ্লাদ ও আনন্দের রূপ। তিনি দাঁড়ি রেখেছেন। নামাজ রোজায় যত্ন শীল হয়েছেন। ক্রিকেটের পাশাপাশি তরুণদের রোজা-নামাজের জন্য উৎসাহিত যাচ্ছেন নিরলসভাবে।
রাজিন সালেহ: রাজিন সালেহও আফতাবের বদলে গেছেন তাবলিগের ছোঁয়ায়। জাতীয়দল থেকে একরকম হারিয়ে গেলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি সক্রিয়। তিনি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ক্রিকেট কোচিং দলের অধিনায়ক । নিয়মিত নামাজ কালাম ইবাদতে সময় দেন।
সোহরাওয়ার্দী শুভ : সোহরাওয়ার্দী শুভ। হঠাৎ করেই মুখভরা দাড়ি। চেহারায় সম্ভ্রান্তের ছাপ। জাতীয় ক্রিকেট দলের এমন পরিবর্তনের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, এর পেছনে সম্পূর্ণ ভূমিকা তাবলিগ জামাতের দীনি ভাইদের।
বাংলাদেশ ক্রিকেটদলের এ অলরাউন্ডার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করার পর দলের হয়ে বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছেন। সম্প্রতি দলের জাতীয় দলে সুযোগ না পেলেও বিভিন্ন দলের হয়ে খেলে যাচ্ছেন। জাতীয় লিগে ক্রিকেট দক্ষতা দেখাচ্ছেন। দক্ষতা দেখাচ্ছেন তাবলিগের ময়দানেও।
জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের নিয়ে সুযোগ পেলেই তিনি চলে যান তাবলিগে। তার দীনি কাজের নিপুনতা অনেক ক্রিকেটারের গায়েই লাগছে দীনের শান্তির সমীরণ।
হাশিম আমলা : ক্রিকেটের রানমেশিন খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান এ ব্যাটসম্যান এখনও ঝড় তোলেন বাইশ গজে। এছাড়া তিনি মাঠের একজন সার্থক ফিল্ডার। তাকে যেখানে অধিনায়ক দাঁড় করান, সেদিক দিয়ে বল ছুটবে! তা কল্পনাতীত।
তিনি কিন্তু ক্রিকেট মাঠের মতো নিজের ব্যক্তি জীবনেও পুরোপুরি সফল। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। নামাজ ও নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি তার বেশ গুরুত্ব। কখনো রমজানে মাঠে নামতে হলে রোজা রেখেই মাঠে নামেন তিনি।
শুধুমাত্র ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কারণে নিজ ক্রিকেট দলের প্রধান স্পন্সর ‘ক্যাসেল’ (মাদক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) এর লোগো সমৃদ্ধ টি-শার্ট পরেন না। শোনা যায়, এই লোগো ব্যবহার না করার কারণে ক্রিকেট বোর্ডকে নাকি কিছু অর্থও দণ্ড দিতে হয়।
ইমরান তাহির : পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করা দক্ষিণ আফ্রিকান এ ক্রিকেটার স্পিনযাদুতে ভরকে দিচ্ছেন বিশ্বে নামিদামি ব্যাটসম্যানদের। নিজদলের খেলা ছাড়াও তার স্পিননৈপুন্য মুগ্ধ আইপিএলসহ বিশ্বে প্রায় সব লিগের দর্শকরা। ক্রিকেটের পাশাপাশি তিনি যে কাজটি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাহলো তার চুলের রঙ পরিবর্তন। বলা যায় প্রত্যেক সিরিজে দর্শক দেখতো তার চুলের নতুন ঝলকানোরূপ।
কিন্তু প্রিয় সতীর্থ তাকে এ ব্যস্ততায় বেশিদিন থাকতে দেননি। ব্যস্ত করে দেন দীনে দাওয়াতে। ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এ বোলারকে জীবনের সার্থক এক দিগন্তের সন্ধান দেন হাশিম আমলা।
আমলার অনুপ্রেরণায় ইমরান তাহির নিজেকে সোপর্দ করেছেন ইসলামের ছায়াতলে। ইমরান তাহির বলেন, আমি বেশ বছর যাবৎ ক্রিকেট খেলছি। কিন্তু আমার ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হয়েছে, নিজেকে কঠোরভাবে ইসলাম ধর্মের দিকে মনোনিবেশ করার কারণে ।
ওয়েইন পারলেন : দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের একসময়ের সজীব ক্রিকেটার তিনি। ২০০৯ সালে জাতীয় ক্রিকেটে অভিষেক তার।
কিন্তু তার প্রকৃত জীবনের অভিষেক হয় ২০১১ সালে জানুয়ারিতে। তিনি ২০১১ সালে জানুয়ারিতে ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। নিজের নাম পরিবর্তন করে, নতুন নাম রাখেন ‘ওয়ালিদ’। তবে ক্রিকেট বিশ্বে এখনও তিনি ওয়েইন পারনেল নামেই পরিচিত।
তরুণ এ পেসার সম্প্রতি তার যুগল খুঁজে পেয়েছেন। আংটি পড়িয়েছেন সেই রূপবতীর হাতে। তার স্ত্রীর নাম ‘আয়েশা বাকের’। দক্ষি আফ্রিকার কেপ টাউনে ‘জিনাতুল ইসলাম মসজিদে’ ৪০০ জন অতিথির উপস্থিতিতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। তার জীবনের এ নতুন ইনিংসের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে রইলো শুভ কামনা।
মইন আলী : বর্তমান ইংলিশ দলের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার মইন আলীর পারফরমেন্স চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি ইসলাম ধর্মের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি আমার দাড়িকে ইসলামের পরিচয় হিসেবে দেখি, আর ধর্ম আমার কাছে অনেক গুরুত্বপ‚র্ণ একটা বিষয়। কোরআন আমার জীবনবিধান।
আদিল রাশিদ : পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত আদিল রাশিদ ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের হয়ে খেলছেন বেশ কিছুদিন ধরে। দলে স্থান লাভ ও অভিষেক হওয়ার পর তেমন কঠোর ইসলাম পালনকারী না হলেও সম্প্রতি ইসলামিক নিয়ম-কানুন মেনে নিজের জীবন পরিবর্তন করে নিয়েছেন। কোরআন তার জীবন পাল্টে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
মুশতাক আহমেদ : পাকিস্তান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বোলার মুশতাক আহমেদ। ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের পর পেশা হিসেবে কোচিং ও ইসলামিক ধ্যান-ধারণায় মনোনিবেশ করেছেন। তার ধারণা ইসলাম এবং ক্রিকেট তার জীবনকে বদলে দিয়েছে। সুতরাং ইসলামের অনুসরণ ভীষণ জরুরি।
ইনজামাম-উল-হক : তরুণ ক্রিকেটারদের আইডল তিনি। মুলতানের সুলতান খ্যাত পাকিস্তান ক্রিকেটের এই প্রভাবশালী ব্যক্তিটি এখন তাবলিগ জামাতের সক্রিয় সদস্য হিসেবে ইসলাম প্রচার করছেন। প্রত্যেক বছর বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন তিনি।
এশিয়া কাপে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে অনুশীলনের সময় ওমান-আফগানিস্তানের খেলোয়াড়দের নিয়ে ইনজামামের নেতৃত্বে নামাজ আদায়ের চিত্র অনেকের মনেই দাগ কেটেছিল।
সাকলাইন মুশতাক : পাকিস্তানী এ ঘূর্ণি যাদুকর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের পর নিজেকে সপে দিয়েছেন তাবলিগের কাজে। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অফ স্পিনারের দাওয়াতে পাকিস্তানের উঠতি অনেক ক্রিকেটারের জীবন বদলে গেছে। তাদের মাঝে নৈতিকতাবোধ সৃষ্টিতে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখছেন।
সাইদ আনোয়ার : তখনও তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্রিকেট মাঠ। বাইশ গজের সাদা পিচ পেলেই তিনি চার ছয়ের ফুলঝুড়ি তুলো বল পাঠান গ্যালারিতে। সব কিছু ভালোই চলছিল।
একদিন হঠাৎ তার স্ত্রীর একটি কল এলো তার মোবাইলে। তার মেয়ে খুব অসুস্থ। তিনি পাগলের মতো ছুটে গেলেন বাসায়। প্রাণাধিক সন্তানকে নিয়ে চললেন হাসপাতালে। হাসপাতালে গেলেন। ডাক্তার, নার্স সর্বাত্মক চেষ্টো করলেন। তিনি শেষ রক্ষা আর হলো না। তাকে বিদায় জানিয়ে চিরতরে চলে গেল না ফেরার দেশে।
দুঃখ, কষ্ট আর শোকে তিনি ভাষা হারিয়ে ফেললেন। পুরো পৃথিবী তার কাছে ছোট হয়ে এলো। তিনি মনে মনে ভাবলেন, আমার নাম, যশ, খ্যাতি, টাকা, ক্ষমতা কোনও কিছুই আমার মেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারলো না।
তাহলে আমার যখন মৃত্যু আসবে তখন কি এসবকিছু আমাকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারবে? পারবে না। আর আমার মৃত্যু কখন আসবে তাও তো বলা যায় না। সুতরাং আমার বুদ্ধির পরিচয় হবে এখন থেকেই কাঙ্খিত সেই মৃত্যুর জন্য তৈরি হওয়া।
এখান থেকেই শুরু ক্রিকেটের মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন আল্লাহর রাস্তায়। তাবলিগের অনুপম ছোঁয়ায় আজ তিনি খুঁজে পেয়েছেন জীবনের প্রকৃত শান্তি ও সার্থকতা।
মুহাম্মদ ইউসুফ : ক্রিকেট মাঠের অন্যতম সফল ও সেরা ব্যাটসম্যান মুহাম্মদ ইউসুফ। তিনি ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। নাম ছিল ইউসুফ ইউহানা। একসময়ের ক্রিকেট মাঠের সঙ্গী সাঈদ আনোয়ার তাকে বোঝান ইসলামের মহানুভবতার কথা।
সাঈদ আনোয়ারের সঙ্গ দিয়েছিলেন বিশিষ্ট আলেম দায়ি মাওলানা তারেক জামিল। তাদের অক্লান্ত মেহনতে তিনি আশ্রয় নেন ইসলামের শীতল ছায়ায়। ক্রিটেক মাঠ থেকে অবসর নিয়েছেন সেই কবে। কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় এখনও তিনি সক্রিয়। নিজের মতোই মানুষকে শান্তির পথে নিয়ে আসতে করে যাচ্ছে অক্লান্ত পরিশ্রম।
এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেটারদের মধ্য থেকে মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, তাসকিন আহমেদ, আরাফাত সানি, মোহাম্মদ আশরাফুল, রুবেল হোসেন ও ইমরুল কায়েসসহ বেশ কিছু ক্রিকেটারের মন ছুঁতে শুরু করেছে ইসলামের শীতল ও শান্তির সমীরণ।
আল্লাহ তাদের সবাইকে কবুল করুন। সঙ্গে আমাদেরও।
আরএম/