রকিব মুহাম্মদ ।।
যেনুবিয়া আরসালান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বসবাসকারী একজন লেখিকা। তিনি তার আশপাশের মুসলিম শিশুদের হ্যারি পটার, মারভেল সিরিজের কমিক পড়ে বড় হতে দেখেছেন। ধীরেধীরে কীভাবে অমুসলিম-অপসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব শিশুদের নাজুক হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছে, নিজ চোখে দেখেছেন তিনি।
যেনুবিয়া আরসালানেরও সন্তান আছে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পেয়েছেন। তিনি অনুভব করেছেন, তার বাচ্চাদের পড়ার মতো মুসলিম সাহিত্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যা থেকে তারা তাদের নিজস্ব বিশ্বাস, মূল্যবোধ, পরিচিতি ও সংস্কৃতির খোরাক পেতে পারে।
এই বিষয়টি তাকে উদ্বুদ্ধ করে মুসলিম শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র শিশুসাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কলম ধরতে। মুসলিম পটভূমির অধিকারী শিশুদের নিজস্ব গল্প নিয়ে সাহিত্য রচনার কলম ধরেন এই লেখিকা। পাকিস্তানে তার নিজের শৈশবকালীন সময়ে তার মধ্যে এই চিন্তার উদয় হয়।
যেনুবিয়া আরসালানের ভাষ্যমতে, শৈশবে, আমার পড়া বইগুলোর মধ্যে কখনোই আমি আমাকে বা আমার বিশ্বাসের প্রতিফলনকে খুঁজে পাইনি এবং সেই সময়ই তা আমাকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। বহু বছর পর, মা হিসেবে এবং আমাদের নিজস্ব বইচক্রের শিশুতোষ বইসমূহের সংরক্ষক হিসেবে আমি এমন বইয়ের প্রচুর অভাববোধ করি যা একই সাথে সুখপাঠ্য হওয়ার পাশাপাশি আমাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতিফলনকারী।
শিশুদের জন্য বই লেখার সর্বশেষ প্রচন্ড তাড়না তিনি অনুভব করেন, যখন তার আট বছরের মেয়ে তার কাছে স্কুল থেকে প্রদত্ত সৃজনশীল বাড়ির কাজ করার জন্য সাহায্য চায়। সেখানে নির্দিষ্ট কিছু চরিত্র ঠিক করে তাদের অবলম্বনে একটি গল্প তৈরির বিষয় ছিল।
তিনি বলেন, গল্পের জন্য আমি আয়েশা, আলী এবং ফাতেমা নামের চরিত্রের পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু সে এই নামগুলোকে তার গল্পের চরিত্রের জন্য বেমানান নাম হিসেবে নাকচ করে দেয় এবং সম্পূর্ণ ইংরেজি নামে তাদের নামকরণ করে ইংরেজ গ্রামীণ সমাজের পটভূমিতে গল্পের কাঠামোটি ঠিক করে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা স্বত্ত্বেও আরসালানের মেয়ে এনিড ব্লাইটন ও রুয়াল দালির মত লেখকদের গুনমুগ্ধ পাঠক। যেনুবিয়া আরসালান এই প্রসঙ্গে বলেন, এই বইগুলো চমৎকার এবং আমিও নিজের শৈশব থেকে এগুলো মুগ্ধতার সাথে পড়ে আসছি, কিন্তু আমাদের শিশুদের পাঠের জন্য এগুলোই একমাত্র গ্রন্থ হতে পারেনা। কারণ, বই হলো আয়নার মতো এবং আমাদের শিশুদের এতে তাদের প্রতিচ্ছবিকে দেখতে পাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
আরসালানের তৃতীয় এবং সাম্প্রতিক ‘বিটউয়িন ফিয়ার অ্যান্ড হোপ: এ মুসলিম চাইল্ডস জার্নি’ (Between Fear and Hope: A Muslim Child’s Journey) গ্রন্থটি আগস্টে প্রকাশিত হবে। এই বইয়ে একজন মুসলিম মা হিসেবে তার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তিনি গল্পের কাঠামো তৈরি করেছেন। গল্পটি তিনি একটি মুসলিম শিশুকে আবর্তন করে তৈরি করেছেন, যাতে তিনি দেখিয়েছেন কল্পনার সুপারহিরোর পরিবর্তে প্রতিটি শিশুর মধ্যে বাস্তবে সুপারহিরো হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
পাশাপাশি এখানে গল্পটির পিতার চরিত্রটিও গুরুত্বপূর্ণ, যিনি তার শিশুকে পরিবার বা সমাজের তথাকথিত আকাঙ্খিত ক্যারিয়ারের পরিবর্তে শিশুটির নিজস্ব ভালো লাগার জায়গা থেকে কাজ করায় সাহায্য করেন।
যদিও তিনি তার সাহিত্যে ভিন্ন সংস্কৃতির পটভূমিকে উপস্থাপন করেছেন, তথাপি ইংরেজিতেই তিনি তার বইগুলো লিখছেন। মূলত সারাবিশ্বে আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজির গুরুত্বের কারণে তিনি তার বইগুলো ইংরেজিতে লিখছেন।
যেনুবিয়া আরসালান বলেন, সংস্কৃতিগতভাবে কিছু নির্বাচিত পেশাকেই পিতা-মাতারা তাদের শিশুদের জন্য অনুমোদন করেন এবং শিশুদেরকে তাদের আগ্রহহীন পেশায় জোর করে পাঠানো হয়। আমার লিখিত বইয়ের মাধ্যমে আমি আশা করি পিতা-মাতা ও শিশু উভয়েই বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে পারবে এবং তারা তাদের আকাঙ্খা ও ইচ্ছাকে অন্য সকলের জীবনের জন্য কতটা মূল্যবান তা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবে।
মাতৃত্ব আরসালানের গল্প বলার বৃহত্তম অনুপ্রেরণা। তার প্রথম ‘বিফোর বার্থ, বিয়ন্ড লাইফ’ (Before Birth, Beyond Life) গ্রন্থটির রচনা মূলত তার নিজ সন্তানদের দুটি প্রশ্ন থেকে; “কোথা থেকে আমরা পৃথিবীতে এলাম” এবং “মৃত্যুর পর আমরা কোথায় যাবো”।
কুরআন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তিনি এই গ্রন্থে শিশুদের উপযোগী করে এই বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন, যা একইসাথে এই কঠিন বিষয় সম্পর্কে শিশুদের সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকেও সাহায্য করবে।
আরসালান বলেন, কিছু কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ শুধু শিশুদের জন্যই নয় এবং আমি মনে করি এটিও তার মধ্যে একটি। শিশুদের মত বয়স্করাও এই বিষয় সম্পর্কে গল্পচ্ছলে সহজে জানার জন্য এই বইটি পড়তে পারে।
তার বইয়ের পাতায় পাতায় তিনি বিবিধ মূল্যবোধ তথা সততা, সত্যতা, দুর্বলকে রক্ষা, ভদ্রতা, নামাজ আদায় প্রভৃতির প্রতি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষনের প্রচেষ্টা করেছেন।
গ্রন্থটি সম্পর্কে আরসালান বলেন, এই বইয়ে প্রতিদিনের সুপারহিরোর উপাদানসমূহ খুবই শক্তিশালী। তিনি আশা করেন, তার এই বইটি একই সাথে শিশু ও তাদের পিতা-মাতার অনুপ্রেরণার জন্য কাজ করবে।
আরএম/