আওয়ার ইসলাম: পাকিস্তানের পাঞ্জাবের লাহোরে অবস্থিত একটি মুঘল যুগের মসজিদ। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে ১৬৩৪ সালে এ মসজিদ নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৬৪২ সালে নির্মাণ শেষ হয়। এ মসজিদটি মুসলিম ঐতিহ্য আর স্থাপত্বশৈলির অনন্য এক নিদর্শন।
মুঘল যুগের মসজিদসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে সুসজ্জিত হিসেবে স্বীকৃত। মসজিদ খান মসজিদ টাইলের কাশি-কারি নামক জটিল শিল্পকর্ম ও অভ্যন্তরের চমৎকার মুঘল ফ্রেসকোর কারণে জন্য পরিচিত। আগা খান ট্রাস্ট ফর কালচার, ও পাঞ্জাব সরকারের তত্ত্বাবধানে ২০০৯ সাল থেকে মসজিদে সংস্কার কাজ শুরু হয়। জার্মানি, নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার এতে সহায়তা প্রদান করেছে।
ওয়াজির খান মসজিদ লাহোরের দেয়ালঘেরা শহরের ভেতরে শাহি গুজারগাহ সড়কের দক্ষিণে অবস্থিত। এই পথে মুঘল অভিযাতরা লাহোর দুর্গে যাতায়াত করতেন। মসজিদটি দিল্লি ফটকের ২৬০ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত।এছাড়া মসজিদের সম্মুখে ওয়াজির খান চক অবস্থিত।
মুঘল দরবারের প্রধান চিকিৎসক ইলামউদ্দিন আনসারি মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি ওয়াজির খান নামে পরিচিত ছিলেন। ওয়াজির খান পরবর্তীতে পাঞ্জাবের সুবেদার নিযুক্ত হন। তিনি লাহোরের আরো কিছু স্থাপনার নির্মাণ করেন।
মসজিদের অভ্যন্তরের ফ্রেসকোর সজ্জায় মুঘল ও স্থানীয় পাঞ্জাবি সজ্জার মিশ্রণ ঘটেছে। মসজিদের বাইরের অংশ পারস্য শৈলীর কাশি কারি সজ্জায় সজ্জিত করা হয়।
ওয়াজির খান মসজিদ একটি বিশাল কমপ্লেক্সের অংশ হিসেবে গড়ে উঠে। এই কমপ্লেক্সে ঐতিহ্যগতভাবে ক্যালিগ্রাফার ও বই বাধাইকারীদের জন্য দোকান বরাদ্দ করা হয়। মসজিদের প্রধান প্রবেশপথের সামনে শহরের চত্বর ছিল। মসজিদকে ঘিরে নির্মিত দোকানপাট থেকে প্রাপ্ত অর্থ মসজিদের জন্য ওয়াকফ হিসেবে নির্ধারিত হয়েছিল।
সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে ১৬৩৪ বা ১৬৩৫ সালে মসজিদের নির্মাণ শুরু হয় এবং সাত বছর ধরে নির্মাণ কাজ চলে। ১৮৮০ এর দশকের শেষদিকে রুডইয়ার্ড কিপলিঙের বাবা জন লকউড কিপলিং সাবেক জার্নাল অব ইন্ডিয়ান আর্টে মসজিদের সজ্জা নিয়ে লিখেছিলেন। ব্রিটিশ পণ্ডিত ফ্রেড হেনরি এন্ড্রুজ ১৯০৩ সালে মসজিদের ভগ্নদশার কথা লিখেছেন।
মসজিদটি একটি উচ্চ ভিত্তির উপর নির্মিত। এর মূল অংশটি ওয়াজির খান চকের দিকে উন্মুক্ত। মসজিদের বাইরের পরিসীমা হল ২৭৯ ফুট (৮৫ মি) by ১৫৯ ফুট (৪৮ মি)। এর দীর্ঘ অংশটি শাহি গুজারগাহর সাথে সমান্তরাল। মসজিদটি চুনাপাথর সহযোগে ইট দ্বারা নির্মিত।
বিভিন্ন অঞ্চলের সজ্জা শৈলীর ব্যবহারের কারণে ওয়াজির খান মসজিদ পরিচিত। শাহজাহানের যুগে লাহোরে নির্মিত অন্যান্য স্থাপনায় কাশি-কারি শৈলী ব্যবহার হলেও ওয়াজির খান মসজিদের মত ব্যাপক মাত্রায় আর কোথাও ব্যবহার হয়নি।
মসজিদের বাইরের অংশে কাশি-কারি নামে পরিচিত পারস্যের সজ্জা শৈলী শোভিত। ভেতরের উঠানের দিকে থাকা বহির্ভাগ সমৃদ্ধ মটিফে সজ্জিত।
এতে ১৭শ শতাব্দীর পারস্যের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। পারস্য রীতিতে ব্যবহৃত রঙের মধ্যে রয়েছে লাজভার্দ (কোবাল্ট ব্লু), ফিরোজা, সাদা, সবুজ, কমলা, হলুদ ও বেগুনি।
অন্যদিকে পারস্য প্রভাবিত মটিফে ফুল, ফলের নকশা রয়েছে। মসজিদে সাইপ্রাস গাছের মটিফ রয়েছে। এই মসজিদে প্রথম পারস্য রীতির মটিফ ব্যবহৃত হয়েছিল।
ওয়াজির খান চকের দিকে থাকা বহির্ভাগ টাইল ও ক্যালিগ্রাফি দ্বারা শোভিত করা হয়েছে। এতে কুরআনের আয়াত, হাদিস, দোয়া ইত্যাদি উৎকীর্ণ রয়েছে।নামাজের মূল স্থানের ইওয়ানে কুরআনের আয়াত উৎকীর্ণ রয়েছে। ক্যালিগ্রাফার হাজি ইউসুফ কাশ্মিরি এগুলো উৎকীর্ণ করেছেন।
ভেতরের দেয়াল সুন্দর ফ্রেসকোতে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। মুঘল যুগের অন্যান্য মসজিদের চেয়ে এই শৈলী স্বতন্ত্র। এতে মুঘল ও স্থানীয় পাঞ্জাবি অলঙ্করণ শৈলীর মিশ্রণ ঘটেছে। নামাজের মূল স্থানের একটি বর্গাকার প্যাভিলিয়নের উপর মসজিদের বৃহৎ গম্বুজ অবস্থিত। গম্বুজের ভেতরের অংশ নানা রকম নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে।
ওয়াজির খান চকের দিকে অবস্থিত খিলান লতাপাতার মটিফে সজ্জিত। মসজিদের নিচু গম্বুজগুলিতে লোদি যুগের শৈলী দেখা যায়।
একটি বৃহদাকার ইওয়ান দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। ইওয়ানের দুই পাশে দুইটি ঝুলবারান্দা রয়েছে। ইওয়ানের উপর আরবিতে শাহাদাহ উৎকীর্ণ রয়েছে। ইওয়ানের পাশে থাকা প্যানেলে ক্যালিগ্রাফার মুহাম্মদ আলি কর্তৃক উৎকীর্ণ পার্সিয়ান কবিতা রয়েছে। ছোট প্রবেশপথ দিয়ে মসজিদের বাজারে অবস্থিত অষ্টভুজাকার চেম্বারে যাওয়া যায়।
প্রবেশপথ ও অষ্টাভুজাকার চেম্বারের পথ ধরে মসজিদের কেন্দ্রীয় উঠানে যাওয়া যায়। এটি ১৬০ ফিট দীর্ঘ ও ১৩০ ফুট প্রশস্ত। এর চারপাশে খিলান সমৃদ্ধ গ্যালারি রয়েছে। এটি পারস্যের রাজকীয় মসজিদের একটি শৈলী।
মসজিদের উঠানে ওজুর জন্য একটি জলাধার রয়েছে। এটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩৫ ফুট। এখানে ১৪শ শতাব্দীর সুফি সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক গাজরুনির মাজার অবস্থিত।
উঠানের পাশে আলেমদের অধ্যয়নের জন্য বেশকিছু স্থান রয়েছে। উঠানের প্রতি কোণে মসজিদের চারটি মিনার অবস্থিত।
নামাজের স্থান পুরো অংশের পশ্চিমে অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে প্রায় ১৩০ ফুট ও ৪২ ফুট। এটি উত্তর দক্ষিনে পাঁচটি অংশে বিভক্ত। এর সাথে মরিয়ম জামানি বেগম মসজিদের মিল রয়েছে।
নামাজের স্থানের মধ্যভাগে ৩১ ফুট উচু গম্বুজ রয়েছে। এর ব্যাস ২৩ ফুট। চারটি খিলান নিয়ে গঠিত বর্গাকার প্যাভিলিয়নের উপর এটি অবস্থিত। এটি পারস্যের স্থাপত্য রীতি।
নামাজের স্থানের বাকি অংশের উপর ২১ ফুট উচু ও ১৯ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট গম্বুজ রয়েছে। এই গম্বুজগুলি লোদি যুগের শৈলীতে নির্মিত হয়। সর্বউত্তর ও সর্বদক্ষিণে চক্রাকার সিড়িবিশিষ্ট ঘর রয়েছে। এই সিড়ি দিয়ে ছাদে যাওয়া যায়।
এখানের দেয়ালে আরবি ও ফার্সি ক্যালিগ্রাফি উৎকীর্ণ রয়েছে। প্রত্যেক দেয়ালে স্বতন্ত্র মোজাইক নকশা দেখা যায়।গম্বুজের ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারনে ইমাম প্রদত্ত খুতবা মসজিদের প্রাঙ্গণে শোনা যায়।
মসজিদ কমপ্লেক্সটি পাঞ্জাবের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ সুরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের সম্ভাব্য তালিকায় মসজিদের নাম যোগ করা হয়েছিল।
২০০৪ সালে পাঞ্জাব সরকার মসজিদের সংরক্ষণ ও সংস্কার কাজ করে। ২০০৭ সালে আগা খান ট্রাস্ট ও পাঞ্জাব সরকার যৌথভাবে স্থাপনার সংস্কার কাজ করে। ২০০৯ সালে লাহোরের দেয়ালঘেরা শহরের সংস্কারের অংশ হিসেবে মসজিদে দুই বছর মেয়াদী একটি দীর্ঘ সার্ভে শুরু হয়।
২০১৫ সালে লাহোর ইউনিভার্সিটি অব মেনেজমেন্ট সায়েন্স এবং ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের যৌথ প্রচেষ্টায় মসজিদের ত্রিমাত্রিক ম্যাপিং করা হয়। সূত্র উইকিপিডিয়া
-এটি