আবদুল্লাহ তামিম
জ্যোতির্বিজ্ঞান হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রাচীনতম শাখাগুলোর অন্যতম। লিপিবদ্ধ ইতিহাসে দেখা যায় প্রাচীন ব্যাবিলনীয়, গ্রিক, ভারতীয়, মিসরীয়, নুবিয়ান, ইরানি, চিনা, মায়া ও বেশ কয়েকটি আমেরিকান আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী নিয়মবদ্ধ পদ্ধতিতে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করত।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্যোতির্মিতি, সেলেস্টিয়াল নেভিগেশন, পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পঞ্জিকা প্রণয়নের মতো নানা রকম বিষয় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্তর্গত। তবে আজকাল পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানকে প্রায়শই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের সমার্থক মনে করা হয়। পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞান দুটি উপশাখায় বিভক্ত। পর্যবেক্ষণমূলক ও তাত্ত্বিক।
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুগুলোকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেই সব তথ্য পদার্থবিজ্ঞানের মূল সূত্র অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাজ। অন্যদিকে তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে এসব বস্তু ও মহাজাগতিক ঘটনাগুলো বর্ণনার জন্য কম্পিউটার বা অন্যান্য বিশ্লেষণধর্মী মডেল তৈরির কাজ করা হয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই দুটি ক্ষেত্র পরস্পরের সম্পূরক। তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের ফলাফলগুলোর ব্যাখ্যা করে। অন্যদিকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাত্ত্বিক ফলাফলগুলোর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। অনেকে আবার জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রকে এক করে ফেলেন। এই দুটি বিষয়ের উৎস এক হলেও বর্তমানে তা সম্পূর্ণ পৃথক দুটি বিষয় হিসেবেই ধরা হয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক বস্তু ও ঘটনাবলির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে জ্যোতিষীগণ দাবি করেন, মহাজাগতিক বস্তুগুলোর অবস্থান মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
জাবির ইবনে সিনান আল-বাত্তানি (৮৫৮-৯২৯ সাল)
নিজের সময়ের তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়নে অন্যতম একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলে গণ্য হন জাবির ইবনে সিনান আল-বাত্তানি। পাশাপাশি গণিতেও আছে তার বিশেষ অবদান।
তিনি আলবাটেগনিয়াস, আলবাটেগনি বা আলবাটেনিয়াসসহ একাধিক ল্যাটিন নামেও পরিচিত। সংক্ষেপে আল-বাত্তানি বলেই চেনে সবাই। তিনি বছরের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেছিলেন বেশ সূক্ষ্মভাবে।
কোনো প্রকার টেলিস্কোপের সাহায্য ছাড়াই কেবল খালি চোখের পর্যবেক্ষণ এবং গণিতের প্রয়োগে তিনি সে সময়েই এক সৌর বছরের মান হিসাব করেন যার সঙ্গে আজকের আধুনিক হিসাবের (৩৬৫দিন ৫ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড) সঙ্গে মাত্র তিন মিনিটের গরমিল পাওয়া গেছে।
আল- বাত্তানি পৃথিবীর বিষুবরেখার মধ্য দিয়ে যাওয়া কাল্পনিক সমতলের সঙ্গে সূর্য ও পৃথিবীর কক্ষপথের মধ্যে যে সমতল, তা অসদৃশ বলে ব্যাখ্যা করেন। বিস্ময়করভাবে তিনি এই দুই কাল্পনিক সমতলের মধ্যকার কোণ পরিমাপ করেন। এই কোণকে বলা হয় ‘সৌর অয়নবৃত্তের বাঁক’।
আল-বাত্তানি পরিমাপ করেন ২৩ ডিগ্রি ৩৫ মিনিট যা বর্তমানের সঠিক পরিমাপ ২৩ ডিগ্রি ২৭ মিনিট ৮.২৬ সেকেন্ডের খুবই কাছাকাছি। তার এসব জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় তথ্য রেনেসাঁর যুগে ইউরোপীয় সব জোতির্বিজ্ঞানীর কাছে তুমুল প্রিয় ছিল।
তারা আল-বাত্তানির কাজের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। ৫৭ অধ্যায় সংবলিত তার লেখা ‘আল-জিজ আল-সাবি’ একটি অসাধারণ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সংকলন যা ষোড়শ শতকে ‘ডি মটু স্টেলারাম’ নামে ল্যাটিনে অনূদিত হয়।
আর্মিলারি স্ফিয়ারের উদ্ভাবক তিনি না হলেও তার তৈরি স্ফিয়ার ছিল আগের সব যন্ত্রের চেয়ে নিখুঁত এবং উন্নতমানের। এই যন্ত্র দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সম্বন্ধীয় যুগান্তকারী তথ্য দেন।
কোনো প্রকার টেলিস্কোপের সাহায্য ছাড়াই কেবল খালি চোখের পর্যবেক্ষণ এবং গণিতের প্রয়োগে তিনি সে সময়েই এক সৌর বছরের মান হিসাব করেন আল-বাত্তানির বাবা জাবির ইবনে সিনান ছিলেন জাবির হারান শহরের একজন বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা।
বাবার মতো আল-বাত্তানিও বাদ্যযন্ত্র নির্মাণকৌশল রপ্ত করেন। পরিমাপনে অত্যন্ত পরিপক্ব হওয়ায় তার তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলো হতো উন্নতমানের। তবে আল-বাত্তানি বেশি তৈরি করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় যন্ত্রপাতি। তার জন্মসাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ধরে নেওয়া হয় ৮৫৮ সালে আধুনিক তুরস্কের উরফা শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
সে সময় এলাকার সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষা বিষয়ে বাগদাদের সংস্কৃতির প্রভাব ছিল প্রবল। ফলে সংস্কৃতির একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল আল বাত্তানির মধ্যে। তার পূর্বপুরুষরা ঐতিহ্যগতভাবে জোতির্বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিল। এ ক্ষেত্রে আল-বাত্তানির জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়া এক রকম বংশের ধারা বলা যায়। মুসলিম ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন ৯২৯ সালে।
-এটি