বেলায়েত হুসাইন ♦
শায়েখ সালমান আল আওদাহ। পুরো নাম সালমান বিন ফাহাদ বিন আব্দুল্লাহ আল আওদাহ। সৌদি আরবের বিশিষ্ট একজন আলেমে দীন। সৌদির কাসিম প্রদেশের বুরাইদাহ নগরীর পশ্চিমাঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম আল বাসারে ১৯৫৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে তার জন্ম। একাধারে তিনি একজন লেখক, ধর্মপ্রচারক, প্রফেসর, ইসলামি চিন্তাবিদ এবং টিভি উপস্থাপক।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
শায়েখ সালমান আল আওদাহর শৈশবের দিনগুলি কাটে মাতৃভূমি বাসার গ্রামে। পড়াশোনার বয়স হলে কাসিম প্রদেশের বুরাইদাহতে চলে আসেন তিনি।
তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার শুরু এখানেই। বুরাইদাহতে এসে একটি বিদ্যালয়ে ছয় বছর শিক্ষার্জন করেন। অতঃপর ইলমেদীনের গভীর জ্ঞান লাভের জন্য তরুণ সালমান আল আওদাহ তৎকালীন সৌদিআরবের কয়েকজন বিখ্যাত স্কলারের সান্নিধ্যে চলে আসেন।
শায়েখ আব্দুল আজিজ বিন বাজ, মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন, আব্দুল্লাহ বিন জাবরিন এবং শায়েখ সালেহ আল বালেহি তাদের অন্যতম।
সালমান আল আওদাহ সর্বপ্রথম কুরআনে কারিমের হিফজ সম্পন্ন করেন। পরে একেক করে ইসলামের বাকি তিনটি মৌলিক বিষয়-সুন্নাহ,ইজমা ও কিয়াস-এর দিকে মনোনিবেশ করেন।
তাওহিদ এবং আকিদার বিষয়ের ইলম অর্জন শেষ করে সালমান আল আওদাহ মনোযোগী হন ইসলামের মৌলিক ও শাখাগত আরো বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। হাদিস শরিফের মৌলিকগ্রন্থ নুখবাতুল ফিকার, ইসলামের বিধিবিধানের প্রামাণিক গ্রন্থ বুলুগুল মারাম,সহিহ মুসলিমের উপর লিখিত হাফেজ আল মুনজিরির মুখতাসারসহ ইসলামি এবং জাহেলীযুগের শতশত শের-আশআর (কবিতা) তিনি মুখস্ত করেন শিক্ষাজীবনেই।
প্রখ্যাত এই দায়ি উচ্চতর শিক্ষার্জন করেন কাসিম প্রদেশের একটি মহাবিদ্যালয়ে। এবং এই প্রতিষ্ঠানের শরিয়ত অনুষদ থেকে উসূলুদ্দিন (ইসলামের মৌলিকতা) এর উপরে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এখানে পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন বুরাইদাহর সেই ছোটবেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন শিক্ষক রূপে।
কিছুদিন পরে শিক্ষকতা ছেড়ে আবার তিনি ফিরে আসেন কাসিম প্রদেশের মহাবিদ্যালয়টিতে এবং এখানে লেকচারার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কয়েকবছর শরিয়ত বিভাগের উসূলুদ দীন অনুষদের উস্তাদ হিসেবে দায়িত্বপালন করেন সালমান আল আওদাহ।
এদিকে লেখাপড়াও চালিয়ে যান তিনি। প্রবাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং বুলুগুল মারামের পবিত্রতা অধ্যায়ের উপর ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। এর পাশাপাশি দীনের দাওয়াতও চালিয়ে যান সুন্নি মতাদর্শের এই আলেম।
আশি এবং নব্বয়ের দশকে শায়েখ সালমান আল আওদাহ সৌদি জনগণের নিকট ধর্মীয় জাগরণের বিশিষ্ট স্কলার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হন। এ সময়ের মধ্যেই সৌদিআরবের রাজনৈতিক কারণে কাসিম প্রদেশের জামিয়া (মহাবিদ্যালয়) থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় সালমান আল আওদাহকে-এটা ১৪১৪ হিজরীর শেষদিকের ঘটনা।
ব্যক্তিগত জীবন: ২০১৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সালমান আল আওদাহর স্ত্রী হায়া আস সায়ারি ও এক পুত্র হিশাম গাড়ি দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করে। তারপর একই বছরের আগস্টের দিকে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন-এই খবর চাউর হয়। জানা যায়,তাবুক নগরীর কোন এক রমণীকে তিনি স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা প্রদান করেছেন। আব্দুল্লাহ আল আওদাহ নামে তার আরেকটি পুত্র রয়েছে।
সংস্কারের ডাক ও প্রথম কারাবরণ: সালমান আল আওদাহ ১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম সংস্কারের ডাক দিয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা করেন-এই আন্দোলনে সঙ্গে পান সাফার আল হাওয়ালি,আয়েজ আল কারনী এবং নাসের আল ওমরের মতো যুগসচেতন আলেমেদ্বীনকে।
তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো,একটি ইসলামি কাঠামোর অধীনে আইনগত, প্রশাসনিক, সামাজিক ও মিডিয়া সংস্কারের দাবি বাস্তবায়ন। দ্বিতীয় উপসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধে যেসব আলেম যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তাকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন-ডক্টর সালমান আল আওদাহ তাদের অন্যতম ছিলেন।
রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক ভেবে সেই ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই তিনি এবং সাফার আল হাওয়ালি জনসম্মুখে ভাষণ ও খুৎবা দেয়ার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হন।
গণজাগরণের উত্থানের অভিযোগ এনে ১৯৯৪ সালের আগস্টে সৌদি প্রশাসন ব্যাপক গ্রেফতারাভিযান চালায়-সেই অভিযানে আটক করা হয় সালমান আল আওদাহকে। কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে অনেকদিন অত্যাচারিত হন তিনি।অবশেষে ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে জামিনে মুক্তি লাভ করেন।
ফের আন্দোলন: মুক্তির পরে বক্তৃতা ও ভাষণের অনুমতি প্রদান করা হলেও সালমান আল আওদাহর উপর রাজনৈতিক আলোচনায় নিষেধাজ্ঞারোপ বহাল থাকে।
এরপরেও ২০১৩ এর মার্চে সরকার এবং বিশেষকরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে সম্মোধন করে জনসম্মুখে কঠিন জ্বালাময়ী এক ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি ঐসব ব্যক্তিদেরকে মুক্তির দাবী জানান,যারা সঠিক কথা বলার কারণে কারাবন্দী হয়েছিলেন।
সরকারকে পরামর্শমূলক অনেক কথাও তিনি বলেছিলেন বক্তৃতায়। এরপরে সালমান আল আওদায় অনেক সৌদি আলেম-ওলামা,বুদ্ধিজীবী এবং ধর্মীয় স্কলারদের ব্যাপক সমর্থন আদায় করে নেন।
-এটি