সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


এক অলরাউন্ডার প্রতিভাধারী আলেমের গল্প

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মোস্তফা ওয়াদুদ : মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। এক সময় কথাটি অনেক শোনা গেলেও বর্তমানে আলেমগণ এ ট্যাগ মুছতে পেরেছেন শতভাগ। এখন শুধু দেশের মসজিদেই না; বরং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থান সংসদেও মোল্লাদের দৌড় লক্ষ করা যায়। বিদেশের রাজা-বাদশাহদের বাসভবনের প্রধান মেহমানও হোন এখন মাদরাসা পড়ুয়া আলেম। দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্বের বড় বড় কাজগুলোর প্রধান কর্মকর্তাও এখন টিনঘরের চার দেয়ালে বেড়ে উঠা উলামায়ে কেরাম।

আজ এমনি একজন আলেমের গল্প শোনাবো। যিনি সব বিষয়ে অলরাউন্ডার। যেনো প্রতিভারা নিজে থেকে ধরা দেয় তাঁর কাছে। তিনি একাধারে আলেম, ইমাম, খতীব, বক্তা, লেখক, ডাক্তার, ধর্মপ্রচারক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অনুবাদক, বিচারক, রাজনৈতিক ও সমাজসেবক। এতকিছুর পরেও যে পরিচয়টি তাঁর সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় সেটি হলো, তিনি একজন আলেম।

বহুগুণের প্রতিভাবান এ মানুষটিকে অনেক ষড়যন্ত্রের বেড়ী পার করতে হয়েছে। চরম নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। কঠিন বিপদের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে জীবনের সোনালি অধ্যায়গুলো।

তাঁর একটার পর একটা লাগাতার সফলতা দেখে এক শ্রেণির মানুষ হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যেতো। হিংসার আগুণে পুড়াতে চাইতো অলরাউন্ডার এ আলেমকে। কিন্তু কুদরতের ওসিলায় বেঁচে যাওয়া মানুষটির সাথে না পেরে নিজেরাই নিজেদের আগুণে আত্মহুতি দিয়ে বলতো, ওকে সৃষ্টিই করা হয়েছে এক নাম্বার করে।

বহু প্রতিভাধারী এ মানুষটির নাম 'মাওলানা আব্দুল করিম ইবনে মুসাব্বির'। বাবার নাম মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মুসাব্বির। তিনি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার কালিজুরী গ্রামে ১৯৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম কমলা বেগম। দাদার নাম আলহাজ্ব আব্দুর রশীদ। তাঁর দাদা তৎকালীন জমিয়ত নেতা ছিলেন।

মাওলানা আব্দুল করিমরা তিন ভাই, এক বোন। তিনি মেঝো। সম্ভ্রান্ত বংশের রমনি নাসিমা বেগমের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। তাঁর সন্তানাদি পাঁচজন। তিন ছেলে আরাফাত করিম, শাহরিয়ার করিম ও আদিল করিম। দুই মেয়ে আবিদা করিম ও সাজিদা করিম।

মেধাবী এ আলেম শিশুবেলা থেকেই অত্যান্ত নম্র-ভদ্র ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি তাঁর পিতার হাত ধরে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ, জামিয়া ইসলামিয়া বুধবারী বাজার কওমি মাদরাসায় ভর্তি হোন। তৎকালীন সময়ে সিলেটের আযাদ দীনি বোর্ডে পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি।

এরপর তিনি জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম দেউলগ্রামে ভর্তি হোন। সেখানে কয়েকবছর পড়ালেখা করে চলে আসেন সিলেটের উত্তর রানাপিং আরাবিয়া হুসাইনিয়া মাদরাসায়। সেখানে ১৯৮৯ সালে অত্যন্ত সুনামের সাথে তাকমিল ফিল হাদীস সমাপণ করেন। তিনি শায়খুল হাদীস আল্লামা রিয়াসাত আলী রহ. থেকে বুখারীর সনদ নেন। আর ইলমে তাসাউফের সনদ নেন শায়খুল হাদীস আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা.বা. থেকে।

কওমী মাদরাসায় পড়াশোনাকালীন তিনি ফুলবাড়ী আজিরিয়া আলিয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে দাখিল, আলিম ও সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন তিনি।

পড়াশুনা শেষ করলে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর আহবানে 'জাতীয় সংসদ মসজিদ' এর ইমাম ও খতিব হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই ওয়াজ নসিহতের সাথে যুক্ত ছিলেন। সে সুবাদে খুব অল্প সময়েই সবার দৃষ্টি কাঁড়তে সক্ষম হোন। ১৯৯৬ সালে তিনি এক মাদরাসার মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন।

খ্যাতিমান লেখক 'হুমায়ূন আহমেদ' তার লেখালেখি জীবনে মাত্র একজন আলেমকে নিয়ে একটি বইয়ের কয়েকটি পৃষ্ঠা লিখেন। বইয়ের নাম, 'শ্রাবণ মেঘের দিন'। আর আলেমের নাম হলো 'মাওলানা আব্দুল করিম'। এছাড়া বিখ্যাত ঔপন্যাসিক কাসেম বিন আবু বকরও ১৯৯৬ সালে 'ধনির দুলালী' নামে লেখা বইটি তার নামে উৎসর্গ করেন।

তিনি তখনকার সময়ে সবগুলো জাতীয় দৈনিকে লিখতেন। তাঁর লেখাগুলো সরল ও প্রাঞ্জল। তিনি বেশি লিখেন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখা।

লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সমাজসেবাও করেন অনেক। তিনি নিজেও ডাক্তারী বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মানুষের সেবার নিমিত্তে তিনি তাঁর পিতা 'মাওলানা আব্দুল মুসাব্বির' নামে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প শুরু করেন। এগুলোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে দেশের খ্যাতনামা ডাক্তারদের আহবান করেন। তাঁদের মাঝে রয়েছেন ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী ও ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল।

জনসেবার মধ্যদিয়ে সহজ-সরল ও সাদা মনের মানুষ মাওলানা আব্দুল করিম সবার প্রিয় ও আপন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে উঠেন।

তিনি ২০০১ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন। সাংবাদিকতার শীর্ষ পরিচয়পত্র 'প্রেসকার্ড' লাভ করেন স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয় হতে। এরপর জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো, যুগান্তর, জনকণ্ঠসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া অনেক টিভি চ্যানেলেও ইসলামী অনুষ্ঠানের আলোচনায় অংশ নিতেন তিনি।

তিনি ২০১২ সালে সিলেট উত্তর রানাপিং আরাবিয়া মাদরাসায় এলাকাবাসীর অনুরোধে মুহতামিম হিসেবে যোগদান করেন। সে সময় মাদরাসার অবস্থা ছিলো খু্বই দূর্বল।বোর্ডিংঋণ, উস্তাদদের বেতন বাকিসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত ছিলো। এরপর তিনি ধীরে ধীরে মাদরাসাকে উন্নতির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দেন।

তিনি অনেক সমাজসেবা মূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। সিলেট শহরের বিখ্যাত মসজিদ নুরপুর জামে মসজিদের মুতাওয়াল্লী ছিলেন তিনি। এছাড়া জালালাবাদ ক্যান্টনম্যান্ট বোর্ড স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য ও হযরত শাহ পরাণ রহ. মাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ছিলেন।

মাওলানা আব্দুল করিম জীবনে অনেক দেশ সফর করেছেন। কোনো দেশে সরকারী খরচে গিয়েছেন। কোথাও বা দীন প্রচারে নিজের ঘাটের পয়সা খরচ করে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁর পেছনে সব সময় শত্রুদের নজর ছিলো। শত্রুরা সব সময় তাঁকে হত্যা করতে চাইতো। কিন্তু আল্লাহ যাকে রক্ষা করবেন তাঁকে কে মারবে?

তেমনি ২০১৪ সালে তিনি ফ্রান্স ভ্রমণে গেলে তাঁকে ধারাণপ্রসূত জঙ্গি আখ্যা দেয়া হয়। সে সময় তাঁর ও পরিবারের উপর চালানো হয় নির্যাতনের স্ট্রিমরোলার। ২০১৬ সালে ফরাসী ক্রুসেডার বাহিনী তাঁর ফ্যামিলির ৬ সদস্যকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। তার শরীরে হাই টেকনোলজির অস্ত্র দিয়ে মাংসপেশীতে অনু ঢুকিয়ে নির্যাতন করা হয়। ইলেক্ট্রিক হেলমেট দিয়ে তাকে ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু তিনি আল্লাহর মেহেরবানীতে শেষ রক্ষা পান। তাঁর বৃদ্ধ পিতার দুআর বরকতে তিনি তাঁর পরিবারসহ এখনও বেঁচে আছেন।

মাওলানা করিমকে সিজদারত অবস্থায় যে ক্রুসেডার লাথি মেরেছিলো সে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।

এছাড়াও তিনি কাদিয়ানী বিরোধী সংগঠন 'আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুয়াত' এর কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তৎকালীন সভাপতি ছিলেন বায়তুল মুকাররমের খতীব আল্লামা উবায়দুল হক রহ.। বর্তমানে তিনি স্বপরিবারে ফ্রান্সেই বসবাস করছেন। তিনি তাবলিগ জামায়াতের পুরানো সাথী। বিশ্ব ইজতেমা মাঠে বিদেশী আলেমদের জন্য ইংলিশ, উর্দু ও আরবী বয়ানের বাংলা অনুবাদক তিনি।

তিনি ১৯৯৭ সালে ঢাকা-সিলেট বিমান দুর্ঘটনায় আল্লাহপাকের রহমতে বেঁচে যান। ২০০১ সালে ইন্ডিয়ার বিএসএফরা তাঁকে ধরে নিয়ে গুলি করে মারতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাদের কামান থেকে গুলি বের হয়নি। ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড এর পাতায়া সিটিতে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায়ও আল্লাহর অশেষ করুনায় বেঁচে যান তিনি। এরকম আরো অনেক বিপদ থেকে আল্লাহ এ মেধাবী অলরাউন্ডার আলেমকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ