চলছে রমজান মাস। ‘ইসলাম ও রমজান ভাবনা’ নিয়ে ও জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া মুহাম্মাদপুর এর নায়েবে মুফতি সাঈদ আহমদ এর মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ার ইসলাম আয়োজিত ‘লেখালেখি ও সাংবাদিকতা কোর্স’ এর শিক্ষার্থী হুযাইফাহ কাসিম । সাক্ষাৎকারটি আওয়ার ইসলাম পাঠকদের জন্য পরিবেশন করা হলো।
আওয়ার ইসলাম: রমজান মাসকে এবাদতের বসন্তকাল হিসেবে আমরা জানি। এ মাসে কোন কোন আমল বেশি করা দরকার?
মুফতি সাঈদ আহমাদ: হাদিসে সকল নফল ইবাদতের কথাই বেশি পরিমাণে করার কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন, বেশি পরিমাণে নফল নামাজ পড়া। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা। দান সদকা করা। দূর্বল ও অসহায়ের প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ করা। সম্ভব হলে উমরা করা। বেশি বেশি ইস্তিগফার করা। গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া ও জান্নাতের আর্জি পেশ করা। জিকর ও তাসবীহ বেশি পরিমাণে করা। আর এসকল ইবাদতের পাশাপাশি সর্ব প্রকার গুনাহ থেকে বিরত থাকার বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া।
আওয়ার ইসলাম: রমজান এলে সমাজের যুবক, বৃদ্ধ ও শিশুরা সবাইমিলে মসজিদমুখী হয়। রমজান গেলে তাদের এ স্রোত থেমে যায় কেনো? রমজানের বাইরেও তাদের মসজিদে ধরে রাখার জন্য করণীয় কী?
মুফতি সাঈদ আহমাদ: রমজান মাসে অধিক সংখ্যক লোকের ইবাদতমুখী হওয়ার মূল কারণ হল রোজা ও রমজান। কেননা মানুষকে ইবাদত বিমুখ করে মূলত মানুষের নফস ও শয়তান। রুহানী শক্তি দূর্বল হলে মানুষ শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে ইবাদত ছেড়ে দেয় ও পাপ কর্মে উদ্বুদ্ধ হয়। রোজার মাধ্যমে নফস নিয়ন্ত্রিত থাকে ও রমজানে শয়তান শিকলবন্দী থাকে। ফলে বান্দার রুহানী শক্তি তাকে ইবাদতমুখী করে দেয়। কিন্তু রোজা ও রমজান চলে গেলে এ শত্রু সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে। যার কারণে দূর্বল ঈমানদাররা আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।
রমজানের পরে তাদের ইবাদত বন্দেগীর সে আগ্রহকে ধরে রাখতে ও মসজিদমুখী করতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে সৎসঙ্গকে। যাকে পবিত্র কুরআনে ‘كونوا مع الصادقين’ (তোমরা সাদেকীনদেরে সাথে থাকো) দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে। আর সাদেকীনের অর্থ হল, দ্বীনদার পরহেজগার ব্যক্তিবর্গ। এর প্রথম শ্রেণী হল হক্কানী উলামায়ে কেরাম। সাদেকীনের সংস্পর্ষে থাকলে মানুষের আত্মা শক্তিশালী হয়। নেক সোহবতের কারণে মানুষ ইবাদত বন্দেগীতে স্বাদ ও আগ্রহ অনুভব করে।
আর পরোক্ষভাবে সর্বদা নেক লোকদের সােহবতে জুড়ে থাকা চাই। যারা সৎসঙ্গ অবলম্বন করে তারা সর্বদাই সৎ থাকতে চেষ্টা করে। সততা ও দ্বীনদারীর অন্বেষায় থাকে। আর যারা সৎসঙ্গকে অবহেলা করে তারা মসজিদে এসেও মসজিদের পরিবেশ নষ্ট করে। সাধারণ মুসলমানদের গতি-প্রকৃতির গভীর পর্যবেক্ষণ করলে এ সত্যটি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আওয়ার ইসলাম: মসজিদ কেন্দ্রীক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও ইমামদের কী ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত?
মুফতি সাঈদ আহমাদ: মসজিদ মূলত ইবাদতের স্থান। প্রয়োজনীয় দীনি শিক্ষা মসজিদ থেকে হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ দীনি শিক্ষা যেমন বর্তমানে মসজিদ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। তেমনি সকল সামাজিক কর্মকাণ্ডের বাস্তবায়নও মসজিদে সম্ভব নয়। আজকাল গরু-ছাগল হারানোর বিজ্ঞপ্তি, পোলিও টিকা খাওয়ানো ও স্মার্টকার্ড বিতরণের ঘোষণা দেওয়ার জন্যও লোকেরা মসজিদে আসে। এগুলো সামাজিক বিষয় বটে, কিন্তু মসজিদে করা শরীয়তসম্মত নয়।
মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা বলতে আমাদের বুঝতে হবে এমন সমাজ ব্যবস্থা যার নেতৃত্ব মসজিদ কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে। এর জন্য আবশ্যক সমাজের সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার মত যোগ্য ইমাম ও খতীব। আর তাঁকে সাহায্য করার মতো যোগ্যতা ও মানসিকতা সম্পন্ন মসজিদ কমিটি। আর সে নেতৃত্ব গ্রহণ করার মত দীনি চেতনা সম্পন্ন মানবসমাজ।
বর্তমানে অনেক সমাজে এ তিনটির কোনটিই নেই। কোন সমাজে একটি থাকলে অপরটি নেই। এ অবস্থায় মসজিদ কেন্দ্রীক সমাজ ব্যবস্থা এমন একটি স্বপ্ন যার বাস্তবতা সুদূর পরাহত। কোন মসজিদের ইমাম সাহেব যদি বিজ্ঞ আলেম হন। তাঁর মধ্যে যদি দাওয়াতী মেজাজ থাকে। ত্যাগ ও মেহনতের জযবা থাকে। তিনি যদি কোন বুযুর্গের পরামর্শে চলায় অভ্যস্ত হন। তাহলে তাঁর দ্বারা সমাজের ভাল প্রকৃতির লোকেরা প্রভাবিত হয়ে থাকে। সমাজের বেশী সংখ্যক না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকেরা তাঁকে নেতৃত্বের আসনে স্থান দেয়। তাঁকে শ্রদ্ধা ও মান্য করে।
এজন্য মসজিদ কেন্দ্রীক সমাজ গড়তে হলে প্রথম কাজ হলো উপযুক্ত গুণাবলী সম্পন্ন ইমাম নির্বাচন করা। দ্বিতীয় কাজ হলো দীনদার ও সততার বিবেচনায় সমাজের শ্রেষ্ঠ লোকদের মসজিদ পরিচালনার জন্য মনোনীত করা। অর্থ-বিত্ত, পেশীশক্তি ও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বকে অগ্রাধিকার না দেয়া। অতঃপর সমাজের সকল মুসলমানের জন্য ফরযে আইন পরিমাণ ইলমে দীন শেখার ব্যবস্থা করা।
এমডব্লিউ/