ইফতেখার জামিল
ধর্মীয় পেশাজীবীতার মধ্যে শুধু ইমামতি বা মাদরাসার শিক্ষকতাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মানবিক শাখার শিক্ষকতা, ওয়ায়েজ, বিচারক, আইনজীবী ( শুধু তার তর্কের কাজটা ধর্মীয় নয় ) বা ধর্মীয় বইয়ের লেখক, সবাই ধর্মীয় পেশাজীবীতায় অন্তর্ভুক্ত।
১) ধর্মীয় পেশাজীবীতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেন। ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে প্রশ্ন তুলার সুযোগ আছে। শ্রম ও উৎপাদনের বিনিময়ে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে পবিত্র। ধর্মীয় পেশাজীবীর চেয়েও অর্থনৈতিকভাবে দেখলেও দেখবেন, ধর্মীয় শ্রম উৎপাদনে বিশেষ কিছু যোগ করে না, তারচেয়ে বড় কথা, ধর্মকে বিনিময়ের মাধ্যম বানানোর সংশয়ও তৈরি হয়।
মুশকিল হচ্ছে, ইসলামি ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অর্থনৈতিক সংস্থান ছাড়া ধর্মীয় চর্চায় ত্রুটি তৈরি হচ্ছে। ফলে যেসব ধারা একে অপছন্দনীয় মনে করতো, তারাও পরবর্তীতে এর অনুমতি দেন।
ইসলামি অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মীয় চর্চা অব্যাহত রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সেখান থেকেই ব্যক্তিগতভাবে কারো কাছ থেকে পারিশ্রমিক নেবার প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতা নেই বলে একে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে।
তবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দুর্বলতা ও পতনের পর সমাজ রাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে ধর্মীয় চর্চা জারি রাখার স্বার্থে পারিশ্রমিকের দায়িত্ব নিতে পারে, এ নিয়ে প্রায় সব তাত্ত্বিকের ঐক্যমত রয়েছে। ঐক্যমত বা প্রাসঙ্গিকতা সত্ত্বেও সংশয় থেকে যায়।
২) তবে এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ধর্মীয় পেশাজীবীতার মধ্যে শুধু ইমামতি বা মাদরাসার শিক্ষকতাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মানবিক শাখার শিক্ষকতা, ওয়ায়েজ, বিচারক, আইনজীবী ( শুধু তার তর্কের কাজটা ধর্মীয় নয় ) বা ধর্মীয় বইয়ের লেখক, সবাই ধর্মীয় পেশাজীবীতায় অন্তর্ভুক্ত।
শুধু মাত্র শিল্প বা দক্ষতা মূলক শিক্ষকতা এর আওতার বাইরে। ইসলামের কাছে ধর্মের সংজ্ঞা অনেক প্রসারিত। নিছক ধর্মীয় ইবাদত বা টেক্সটের শিক্ষকতাতেই ধর্ম সীমিত নয়। মানবিক জ্ঞান, আইনচর্চা, বিচার বা ধর্মীয় লেখালেখি, এগুলো মৌলিকভাবে ধর্মীয় কাজের অন্তর্ভুক্ত।
ফলে একজন ইমামের বিষয়ে প্রশ্ন তুললে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক শাখার শিক্ষক বা আদালতের বিচারকের বিষয়েও প্রশ্ন তুলতে হবে। লেখক বিষয়েও প্রশ্ন তুলতে হবে। মুশকিল হচ্ছে, ধর্মের অর্থকে সেকুলার অর্থে গ্রহণ করে সেকুলার পরিমণ্ডলে সংযুক্ত থেকে ইমামতি বা শিক্ষকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলাটা খুবই অমানবিক ও হাস্যকর।
দেখা যাচ্ছে, আপনি নিজে ঠিকই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অংশ হিসেবে উপকৃত হয়ে ধর্মকে সীমিত বানিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে প্রশ্নটা তুলছেন, নিজেকে প্রশ্নের আওতায় আনার সাহসটা করতে পারছেন না।
৩) তবে শুরুতেই যেমন বলেছি, মুসলিম রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্বলতার পর এটি একটি বড় সঙ্কট আকারে হাজির হয়েছে। ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন, ধর্মীয় পেশাজীবীতা দীর্ঘমেয়াদীভাবে সমাজে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রভাব কমিয়ে দেয়। ধর্মকে শ্রেণী পরিসরে নিয়ে আসে এবং খালদুনের ব্যাখ্যা মতে এই ধর্মীয় শ্রেণী কখনোই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, সম্মানী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হতে পারেন না।
ভুল করবেন না। এ ধর্মীয় শ্রেণীতে ইমাম থেকে শুরু করে বিচারক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সবাই আছেন। তারা আসলেই নির্দিষ্ট পরিসরে আটকে যান।
এর পাশাপাশি খালদুন দেখিয়েছেন, সভ্যতা টিকে থাকার জন্য এই পেশাজীবীতার বিকল্প নেই। এর সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের কথাও তুলে ধরেছেন, এর সমাধান কী? বিস্তৃত অর্থের ধর্মীয় পেশাজীবীতার আসলে কোন বিকল্প নেই।
তবে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে এর ওপর নির্ভরশীলতা কমানো জরুরী। সম্পূর্ণ বের হয়ে যেতে পারলে ভালো। তবে সেটা অনেকক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে অনেক রাব্বানী আলেম যেটা করতেন, সেটা হচ্ছে, যতদূর না হলেই নয়, ততদূর পেশাজীবীতা করতেন, বিলাসিতা ও বিনোদন বর্জন করতেন এবং অধিকাংশ সময় পেশাহীন চর্চায় জড়িত থাকতেন। আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তৌফিক দিন।
লেখক: সম্পাদক ফাতেহ টোয়েন্টিফোর
-এটি