রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই: তারেক রহমান জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেন শায়খ মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন আগামীকাল মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে চরমোনাই পীরের শোক প্রকাশ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী রহ.-এর বর্ণাঢ্য জীবন কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে: নাছির বড় ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা আইফোনে ‘টাইপ টু সিরি’ ফিচার যেভাবে ব্যবহার করবেন  স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা আল্লাহকে পেতে হলে রাসূলের অনুসরণ অপরিহার্য: কবি রুহুল আমিন খান

শায়খ মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ.: উপমহাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কারের পথিকৃৎ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ ইমরান
তরুণ আলেম ও গবেষক

শায়খ আহমদ সিরিহিন্দি। পিতা শায়খ আবদুল আহাদ। শায়খ আবদুল আহাদ ছিলেন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা.-এর ষড়বিংশ বা সপ্তবিংশতম অধস্তন পুরুষ। মুজাদ্দিদে আলফে সানী ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। হিফজুল কুরআনের মাধ্যমে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি। প্রাথমিক শিক্ষা পিতার নিকট সমাপ্ত করেন।

শিয়ালকোটে মাওলানা শাহ কামাল কাশ্মীরীর নিকট দর্শন, তর্কশাস্ত্র, কালামশাস্ত্র, ও উসূলে ফিকহের ওপর গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন। শায়খ ইয়াকুব কাশ্মীরি থেকে হাদীসের জ্ঞান লাভ করেন। শায়েখ বাহলুল বদখশানী থেকে তাফসীর ও ফিকাহ শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। পিতার নিকট চিশতীয়া ও কাদরিয়া তরিকা চর্চা করেন এবং পূর্ণ কামালিয়্যাত অর্জন করে শাহ সিকান্দার ও শাহ কামাল থেকে খিলাফত লাভ করেন। তৎকালীন নকশবন্দিয়া তরিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক খাজা বাকী বিল্লাহ থেকে খেলাফত লাভ করেন।

শায়খ খাজা বাকিবিল্লাহ রহ.-এর নিকট থেকে নকশবন্দিয়া তরিকায় খেলাফত লাভ করার পর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।
একদিন তিনি স্বীয় হুজরার মধ্যে ফজরের নামাজের পর মোরাকাবায় মশগুল। এমন সময় রাসূলে কারীম সা. রূহানীভাবে সমস্ত আম্বিয়া, অসংখ্য ফেরেশতা এবং আওলিয়ায়ে কেরামসহ সেখানে তাশরিফ আনেন।

তারপর নিজ হাতে তাঁকে খিলআত অর্থ্যাৎ স্বীয় প্রতিনিধিত্বের প্রতীক স্বরূপ এক বিশেষ পোষাক পরিয়ে দেন এবং বলেন, শায়খ আহমদ! মুজদ্দিদের প্রতীকস্বরূপ আমি তোমাকে এই খিলআত পরিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের জন্যে তোমাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম।

উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর চরম দুর্দিনে এক সংকটময় মুহুর্তে তার আগমন। বহু ধর্ম অনুসারীদের আবাসভূমি ভারতে ক্ষমতার সিংহাসনকে নিস্কণ্টক করে তোলার জন্য প্রচলিত সকল ধর্মের উপাদান মিশ্রিত করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মের উপাদানকে প্রধান্য দিয়ে বাদশাহ আকবর দীনে এলাহী নামে নতুন একটি মতবাদ চালু করেন।

এসময় ইরানি শিয়াদের প্ররোচনায় কুরআন সুন্নাহর শিক্ষাকে গ্রিক দর্শনভিত্তিক শিক্ষাধারায় রূপান্তরিত করেন। দরবারি মোল্লারা বাদশার মনোরঞ্জনে লিপ্ত হওয়ায় জনসাধারণ প্রকৃত ইসলামি কালচার ও শিক্ষাচ্যুত হয়ে প্রাচ্যের বাতিল দর্শন ও হিন্দুয়ানী দর্শনের মিশ্রণে এবং বিদআত ও কুসংস্কারে লিপ্ত ছিল।

তাসাউফ, যা মূলত কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিতে প্রবর্তিত ছিল। প্রাচ্যদেশীয় বিভিন্ন ধর্মদর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সকল ধর্ম ও দর্শনের কিছু কিছু বিষয় আত্মস্থ করে এমন এক নতুন ধারা উদ্ভব ঘটে যা কুরআন সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত ধারায় চলাকে জাহেরি শরীয়ত থেকে বেশি গুরুত্ব দিত। ফলে সুফীদের কাছে জাহেরি শরিয়তের বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। যোগসাধনা, রিয়াজত, মুজাহাদার পিছনে লোকেরা মত্ত থাকত।

মারিফতিরা জাহেরি শরিয়তের ওপর চলাকে ব্যঙ্গ করত। তারা বলত, এরা মারিফত সম্পর্কে অজ্ঞ, বাহ্যপূজারী। এমন অবস্থায় মানুষ একদিকে প্রকৃত আত্মসাধনা থেকে বিচ্যুত হতো, অন্যদিকে মনগড়া নানা সূফীবাদী ফেরকার উন্মেষ ঘটে। সে সময় আলেমগণ বিদআত কে হাসানা ও সাইয়িআহ এই দুভাগে ভাগ করত। মনগড়া নানা নতুন বিধানের উদ্ভব ঘটিয়ে হাসানা নামে চালিয়ে দিত। তাই রুসুমাতে ভরপুর ছিল সমাজ।

মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ. আগ্রায় শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজকীয় ফেতনা-ফাসাদ ও কুসংস্কারের বিষয়টি অনুধাবন করেন। তারপর আগ্রা থেকে তিনি স্বদেশে ফিরে যান। সেখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝে সংস্কারের কাজ শুরু করেন।

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মূল দর্শন ছিল সম্রাট পরিবর্তনের মাঝে সফলতা নেই- যদি না সম্রাটের মানসিকতার পরিবর্তন হয়। তাই তিনি সম্রাট বদলের আন্দোলনের পথে অগ্রসর না হয়ে সম্রাট ও তার সভাসদদের মানসিকতার পরিবর্তন করে দেয়ার পথে অগ্রসর হওয়াকে কার্যকর মনে করতেন।

১. তিনি মনে করতেন, রাজা ও রাজার অমাত্যবর্গের সংশোধন ছাড়া সাধারণ মানুষের এই ব্যাপক বিকৃতির সংশোধন করা খুব সহজ হবে না।

২. রাজা ও প্রজার সম্পর্ক হলো, আত্মা আর দেহের ন্যায়। সুতারাং রাজার আত্মার সংশোধন হলে প্রজারূপী দেহ এমনিই সুস্থ হয়ে উঠবে।
কুসংস্কার ও বিদ'আত উচ্ছেদে তিনি ব্যতিক্রম নীতি অবলম্বণ করতেন। তা হলো, সরাসরি বিদআতের বিরোধিতায় না গিয়ে সকল ক্ষেত্রে ব্যাপকহারে নববী সুন্নতের প্রচলন ঘটাতেন। এজন্য তিনি সুন্নাতের অনুসরণের গুরুত্ব সমাজের সামনে পরিস্কারভাবে তুলে ধরেন এবং বিদআতের ভয়াবহতা ও পরিণতি সম্পর্কে উম্মতকে সচেতন করেন।

তথাকথিত সূফীবাদের ভ্রান্ত ধারণার অপনোদনের জন্য তিনি শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন কাজের গুরুত্ব কতটুকু এবং কোনটি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হবে এবিষয়টি পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

তাঁর মতে সর্বপ্রথম আকাইদ ও বিশ্বাসের পরিশোধন অপরিহার্য। অতপর শরিয়তের হালাল হারাম, ফরজ-ওয়াজিব ইত্যাদি বিধি-বিধান সম্পর্কে সতর্ক হওয়া এবং সে অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক। এরপর হলো তাযকিয়্যাহ বা আত্মশুদ্ধির স্থান।

দীনে এলাহীর প্রভাবে আক্বীদা, বিধি-বিধান ও আইন কানুনের এবং আমলী ইনহিতাত ও নৈতিক অবক্ষয়। দরবারি আলেমদের সৃষ্ট কুসংস্কার ও বিদাআতে হাসানার নামে ইসলামের গন্ডীভূত করে সাধারণ মানুষকে সুন্নাত থেকে বিচ্যুত করা। প্রাচ্যদেশীয় বিভিন্ন ধর্মের ভ্রান্ত দর্শনের প্রভাব ও সুফীদের জ্ঞানগত দীনতার কারণে ইসলামের আধ্যাত্মদর্শন ভ্রান্তির শিকার।

যেমন মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবীর ওয়াহদাতুল উজুদ বা সর্বেশ্বরবাদী ভ্রান্ত ধারণা। যার মূল কথা হলো, সকল সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টা সন্নিহিত, স্রষ্টার পৃথক কোনো অস্তিত্ব নেই। ভাববাদী দর্শনের নামে আত্মপ্রকাশ করল আরেক নতুন ফিতনা। যারা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে লাগল, সকল ধর্মের সারকথা একই। সুতরাং ধর্মে ধর্মে ব্যবধান উঠিয়ে দিয়ে সকলে এক ধর্মাবলম্বী হয়ে ভারত মাতার কোলে আশ্রয় নেব।

তারা বলত, হিন্দুদের রাম আর মুসলমানদের রহীমের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। এছাড়া আকবরের যুগে কালিমা, সব ধর্মমত ত্যাগ করে দীনে এলাহী কবুল করা, নক্ষত্র, বৃক্ষ, বানর ইত্যাদির পূজা করা, পুনর্জন্মবাদ, আল্লাহর নামের সাথে আকবরের নাম সংযোগ, সালামের পরিবর্তে আল্লাহু আকবর বলা এবং উত্তরে জাল্লা জালালুহু বা আকবারা শানুহু বলা।

মৃত ব্যক্তিকে মাথা পূর্বদিকে এবং পা পশ্চিমদিকে, কবরে সূর্য আলো প্রবেশে জানালা রাখা, চেহারা খোলা রাখার আবশ্যকতা, মদ হালাল, ব্যভিচার ও বেশ্যাবৃত্তির বৈধতা; বাঘ ভাল্লুক বিড়াল কুকুরকে হালাল করে গরু মহিষ উট বকরিকে হারাম করা- এগুলো ছিল বাদশাহ আকবরের প্রকাশ্য গোমরাহি ও খোদাদ্রোহিতা।

তৎকালীন ভাববাদীরা আকবরকে দীনে এলাহী প্রতিষ্ঠার প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। আর এ ফেতনাটি ভয়াবহ একটি ফেতনার রূপ নেয়। কারণ বহুশ্বরবাদী হিন্দুধর্ম ও একেশ্বরবাদী ইসলাম মিশ্রিত করে কৌশলে মুসলমানদের মাঝে শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। তাদের স্লোগান ছিল, ধর্মের ভেদাভেদ উঠিয়ে শান্তিময় এক সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা।

শায়খ মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ. এর প্রতিরোধে কোনোরূপ বিদ্রোহ ছাড়াই সর্বপ্রথম জনসাধারণের মাঝে শ্বাশত দীনের ব্যাখ্যা তুলে ধরলেন: হক বাতিলের পার্থক্য, সুন্নাত ও বিদাআতের রূপরেখা, সুন্নাতের অনুসরনের উপকারিতা ও বিদআতের ভয়াবহতা, বনী আদমের উন্নতি আল্লাহর হাতে- কোনো শক্তিধরের হাতে নয়, সিজদা কেবল আল্লাহরই প্রাপ্য- কোনো সম্রাট বা রাজাধিরাজের নয়; এ বিষয়গুলো সামনে রেখে তার সংস্কার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

তিনি বক্তৃতা ছাড়াও সমকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তি, আলেম ওলামা ও আমীর উমারাদের নিকট ব্যাপকহারে চিঠিপত্র লিখতেন এবং এতে তিনি ইসলামের পুনর্প্রতিষ্ঠার দাওয়াত ও সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরতেন।

মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহ.-এর আন্দোলন যখন ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগল তখন রাজদরবারে তার ভীষণ প্রভাব পড়ে। নানান উস্কানি আসতে থাকে নানান শ্রেণী থেকে। আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর নিজে লেখেন, ‘শায়খ আহমদ নামক জনৈক ধোঁকাবাজ সেরহিন্দে ধোঁকা ও প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে। বহু অন্তসারশূন্য, জাহির পুরুস্ত, স্থুলদৃষ্টিসম্পন্ন লোক তার খপ্পরে পড়ে গেছে। প্রতিটি শহর ও পল্লীতে সে আপন মুরীদদের এক একজনকে খলীফা বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।

নুরজাহান তার প্রতি ভীষণ ক্ষ্যাপা ছিলেন, তিনি তার জামাতাকে সম্রাচের পর ক্ষমতার মসনদে বসাতে চেয়েছেন। তা মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ.-এর আন্দোলনের কারণে হয়ে উঠছে না। এছাড়া সুফীগোষ্ঠী ও শাহী দরবারের চাটুকার আলেমরা নানা কারণে তার প্রতি ভীষণ ক্ষ্যাপা ছিলেন। বিশেষ করে শিয়া ধর্মাবলম্বীরা তার প্রতি ভীষণ ক্ষ্যাপা ছিল। কারণ তিনি শিয়া ধর্মমতের অসারতা প্রমাণ করে একটি গ্রন্থ প্রণয়ণ করেছেন।

শায়খ সেরহিন্দ রহ.-কে হাসান আফগানী নামে এক মুরীদের সাথে অপর মুরীদের একটি অপ্রীতিকর ঘটনায় দায়ী করা হয়। দরবারের চাটুকারদের উস্কানিতে জাহাঙ্গীর তাকে ডেকে পাঠান। তিনি দরবারে এসে হাজির হন। তিনি দরবারের অর্ধ-শতাব্দীর প্রচলিত নীতি ভঙ্গ করেন। সম্রাট সিজদার করার প্রথাকে লঙ্ঘিত করে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে প্রবেশ করেন রাজদরবারে। তার এ আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে সম্রাট তাকে বন্দি করে পাঠিয়ে দিলেন গোয়ালিয়র দূর্গে এবং তার সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন।

জেলের বন্দিজীবনে তিনি সেখানে কয়েদিদের মাঝে ইসলামের অমিয় বাণী প্রচার করতে লাগলেন। ইসলামের সঠিক ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার কথা ব্যাখ্যা করে বোঝালেন তাদেরকে। এভাবে আস্তে আস্তে পুরো জেলের সমস্ত কয়েদি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অল্পদিনে পাল্টিয়ে দেন তাদের জীবনের গতিধারা।

এদিকে তাকে জেলে বন্দি করার কারণে সারা দেশে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাকে মুক্ত করার জন্য দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়।
দূর্গপতি সমট্রাট একটি পত্র প্রেরণ করেন। তাতে লেখেন, নবাগত এই বন্দীর প্রভাবে এখানকার পশুগুলোও মানুষে পরিণত হয়েছে আর মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হয়েছে। এ রিপোর্ট শুনে সম্রাট ঘাবড়ে গেলেন। সাথে সাথে তাকে মুক্তি দিয়ে স্বসম্মানে দিল্লি নিয়ে আসার হুকুম দিলেন। যুবরাজ শাহজানকে পাঠালেন তাকে সংবর্ধনা দিয়ে এগিয়ে আনার জন্য। দরবারে পৌঁছলে সম্রাট তাকে স্বাগত জানালেন।

শায়খ সেরহিন্দ রহ. পূর্বের মতো সিজদা ছাড়া নববী পদ্ধতিতে দরবারে প্রবেশ করলেন এবং মতবিনিময় করেন। সম্রাটের সাথে মতবিনিময়কালে তিনি সম্রাটকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সকল অনাচারের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারী করেন এবং কিছু দাবি উপস্থাপন করেন:

১. সম্রাটকে সিজদা করার রীতি বন্ধ করতে হবে।
২. মুসলমানদের গরু জবাইয়ের অনুমতি দিতে হবে।
৩. বাদশাহ ও সভাসদের সাবাই জামাতে নামাজ আদায় করতে হবে।
৪. শরীয়াহ বিভাগ পুনঃপ্রতিষ্ঠাও কাজীর পদ পুনর্বহাল করতে হবে।
৫. সকাল প্রকার বিদআত ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
৬. ইসলামবর্হিভূত সকল আইন রহিত করতে হবে।
৭. ভগ্ন ও বিধ্বস্ত মসজিদসূমহ পুন: সংস্কার ও সেগুলো আবাদ করতে হবে।

সম্রাট তার এসকল দাবি মেনে নিয়ে তৎক্ষণাত এ মর্মে শাহী ফরমান জারী করেন। সম্রাট তার দাবি মেনে নিয়েছেন বটে এবং তার প্রতি সম্রাটের অগাধ ভক্তিও আছে। তবে মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ.-এর কারণে দরবারে চাটুকারদের মিশন দিন দিন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে দেখে দরবারীরা সম্রাটকে বোঝাতে লাগল যে, লোকটির প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তাই এ মুহর্তে যদি তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সে যে কোনো মুহূর্তে বিদ্রোহ করতে পারে। অতপর স¤্রাট তাদের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে তাকে রাজঅতিথি হিসেবে সেনা ছাউনীতে নজরবন্দি করে রাখেন।

এটাকে মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ. সংস্কারনীতির মূল সুযোগ ও উপযোগী সময় মনে করলেন। প্রতিদিন বাদশার সাথে বৈঠক হতো তার। আলাপচ্ছলে ইসলামের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ, নিয়মনীতি, আচার, অনুষ্ঠান, আধ্যাত্মদর্শন এমনকি সুফিবাদের জটিল বিষয়াদি তিনি তুলে ধরতেন সম্রাটের সামনে।

তার এক পত্রে স্ত্রীপুত্রের নিকট লেখেন যে, এখানকার অবস্থা সন্তোষজনক। কারণ বিচিত্র মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয়। কোনো লৌকিকতা ও কৃত্রিমতা ছাড়া সকল বিষয়ে এখানে আলোচনা করছি। যেমন একটি আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের বিধি-বিধান, শরিয়তের বোধগম্যতা কেবল জ্ঞানের ও আকলের ওপর নির্ভরশীল নয় বরং আখেরাতের বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল।

তাছাড়া আল্লাহর দীদার, নবুয়াতের সমাপ্তি, প্রত্যেক যুগে মুজাদ্দিদ ও খোলাফায়ে রাশীদীনের অনুসরণ প্রয়োজনীয়তা, তারাবীহ নামাজের সুন্নত হওয়া, জন্মান্তরবাদের অসারতা, জ্বীন পরী ও শাস্তি-পুরস্কারসহ বহু বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কুতুব, ওলী, আবদালের বৈশিষ্ট নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

দরবারে থাকাকালে সেনাপ্রধান ও দরবারের আমির উমারাদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়। একপর্যায়ে তার আদর্শ ও চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তারা তাঁর হাতে বায়আত হয়। এদের প্রত্যেকে জাহাঙ্গীরের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।

মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহ. তাদেরকে বিদআত সম্পর্কে এই বলে বোঝান, বিদআতে হাসানা বলতে কোনো কিছু নেই। হাদীসে সকল বিদআতকে গোমরাহি বলা হয়েছে। অতএব কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াসের ভিত্তিতে যে আমল প্রতিষ্ঠিত তা-ই সুন্নাত। আর চার মূলনীতির বাইরে সব কিছু বিদআত। অতএব সুন্নতকে আঁকড়ে থাকা ও তা থেকেই দলিল প্রমাণ গ্রহণ করে আমল করা বিদআতের চেয়ে উত্তম। সে যুগে ফরজের চেয়ে নফলের গুরুত্ব বেশি ছিল। এ কারণে তিনি শরিয়তের কোন আমলে গুরুত্ব কতটুকু তা পরিস্কারভাবে ব্যক্ত করেছেন।

তিনি রাসূল সা.সুন্নাতকে দুভাগে ভাগ করেছেন

১. যা তিনি ইবাদত হিসেবে আদায় করেছেন।
২. যা তিনি দেশাচার ও সমাজিক প্রথা ও অভ্যাস হিসেবে করেছেন।

যা তিনি ইবাদত হিসেবে করেছেন তার বিপরীত করাকে তিনি বিদআত মনে করতেন। আর যে সব আমল দেশাচার, সমাজিক প্রথাও অভ্যাস হিসেবে করেছেন তাকে তিনি বিদআত বলতেন না। তবে একথা বলতেন, রাসূল সা. দেশাচার বা অভ্যাসবশত যা করেছেন এমন সুন্নতের অনুসরণও সফলতা দান করে নিঃসন্দেহে।

আধ্যাত্মিক সাধকরা বহু প্রকারের সাধনা ও মুজাহাদা করে থাকেন। তাদের সাধনা যদি শরীয়ত মুতাবিক না হয় তাহলে তা অবশ্যই নিষ্ফল ও ব্যর্থ হবে। আর এই কঠিন সাধনার ফলে তাদের কিছু প্রতিদান লাভ হলেও তা পার্থিব।

শরিয়তের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তিনি বলেন, কোনো মুস্তাহাব কাজের প্রতি লক্ষ রাখা এবং মাকরুহে তাহরিমি থেকে বিরত থাকা; এমনকি মাকরুহে তানজিহি থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা যিকির, ফিকির ও মুরাকাবার চাইতে বহুগুণে উত্তম। তবে সুন্নাত ও মুস্তাহাব আদায় করার পর যদি যিকির ফিকির ধ্যান-সাধনার আমল করা হয় তাহলে সে নিঃসন্দেহে সফলকাম।

বস্তুত শরিয়তের নির্দেশ মুতাবেক যে পরিমাণ আমল করা হয় সে পরিমাণ খাহেশাতে নফসানীর পতন ঘটে। শরিয়তের একটি বিধানের অনুসরণ হাজার হাজার বছর মুজাহাদা চেয়ে উত্তম।

রাজার পরিবর্তন না করে রাজা ও রাজদরবারের সভাসদের চিন্তা-চেতনাকে পরিবর্তন করে প্রকৃত ইসলাম অভিমুখী করে দেয়ার যে সুক্ষ্ম কৌশলে তিনি মিশন পরিচালনা করেছিলেন তাতে তিনি এতোটাই সফল হয়েছিলেন যে, বাদশাহ আরোঙ্গজেব পর্যন্ত রাজা ও রাজকর্মচারীরা নকশবন্দিয়া তরিকার মুরীদ ছিলেন।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ