মাসউদুল কাদির ।।
মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ.। ছিলেন রাজধানীর চৌধুরীপাড়া মাদরাসার মুহতামিম। দেশে অন্যতম শীর্ষ আলেম। তবে তাঁর সত্তাজুড়ে ছিল লেখালেখি। তিনি দুই হাঁটু গেড়ে লিখতেন। এক হাঁটু ব্যথা হয়ে গেলে আরেক হাঁটু গেড়ে বসতেন। ঘণ্টাখানেক পরপর চৌধুরীপাড়া মাদরাসার দোতলার (পুরনো ভবন) বারান্দায় চলে আসতেন। হাঁটতেন।
আমার আট বছরের এই দীর্ঘ সময়ে দেখেছি, ইসহাক ফরিদী রহ. লিখতে লিখতে পায়ে ব্যথা অনুভব করলে সে সময়টা হাঁটতেন। ওই সময়টাও নষ্ট করতেন না। হাঁটতেন ঠিকই। বারান্দায় কাউকে পেলেই সেদিনের কোনো হাদিস তাকে শোনাতেন। লিখতে গিয়ে বা পড়তে গিয়ে কোনো হাদিস পেলেই তিনি বারবার এই হাদিসের চর্চা করতেন।
দেখতাম, ছোট নেই বড় নেই, উস্তাদ-শাগরেদ নেই, সবার কাছেই তিনি ওই হাদিস বা কুরআনের কোনো আয়াতের তরজমা, ব্যাখা নিয়ে কথা বলতেন। এটা ছিল তাঁর ভ্রাম্যমাণ জ্ঞান চর্চার এক জাদুকরি দর্শন। এ দর্শনে বিশেষত শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে আসক্ত হতো। হয়তো নিচে কোথাও গিয়েছিল একটু নাস্তা আনতে কিন্তু হুজুর পথে পেয়ে তাকে একটি হাদিস মুখস্ত করিয়ে দিয়েছেন। এটা তখন আদতে খারাপ লাগলেও পরে ঠিকই ভালো লেগেছে।
হজরত কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ., মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ও মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমী দামাত বারাকাতুহুম লাজনাতুত তালাবা বাংলাদেশ নামে লেখালেখি ও মানুষ গঠনের যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন ইসহাক ফরিদী রহ. ছিলেন এর অন্যতম সিপাহসালার।
লাজনাকে কেন্দ্র করেই প্রচুর পরিমাণ লেখক তৈরিতে যে ভূমিকা রেখেছেন তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজকের দিনে শীর্ষ লেখকদের অনেকেই সেই ফরিদাবাদ, মালিবাগ, বারিধারা ও চৌধুরীপাড়ার ফারেগিন। লাজনার ছোঁয়াতেই তারা লেখক হয়েছেন।
আমাদের উস্তাদগণ, বিশেষত ইসহাক ফরিদী রহ. কেউ কিছু লিখলে তাকে বিপুল উৎসাহ দিতেন। আর এই উৎসাহের কারণেই একজন তরুণ চলার মতো পাথেয় পেয়ে যেতো।
আমার মনে পড়ে, ২০০৪ সালে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রাতুলের রঙধনু’ প্রকাশিত হলো। আমাদের লেখালেখি বা সংস্কৃতিচর্চার সব সাফল্যই আমরা হুজুরকে দেখাতাম। আমাদের সামান্য কর্মচেষ্টাকে এমনভাবে প্রশংসা করতেন, এমন করে বলতেন মনে হতো হুজুর নিজেই ওটা লিখেছেন। নিজের মনে করে তিনি প্রশংসা করতেন।
‘রাতুলের রঙধনু’ বইটা হুজুরকে দিলে বইয়ের অনেক অংশ সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে ফেললেন। আমি বিস্মিত হলাম। আপ্লুত হলাম। তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি, একজন শিক্ষার্থীকে কতটুকু ভালোবাসলে এতো ব্যস্ত একজন মানুষ আমার মতো একজন তরুণের বই এভাবে পড়তে পারেন। হ্যাঁ, আমিতো হুজুরের ছাত্র। ছাত্র আর ছেলের তফাৎটা একেবারেই ছিল না হুজুরের কাছে।
ইসহাক ফরিদী রহ. ‘রাতুলের রঙধনু’ পড়তে পড়তে এক জায়গায় মুফতি আবদুর রাজ্জাক আল হোসাইনীর নাম পেয়ে গেলেন। তিনিও আমার উস্তাদ। লেখক। ইসহাক ফরিদী রহ.-এর খুবই ঘনিষ্ঠজন, সহচর। সঙ্গে সঙ্গে আবদুর রাজ্জাক সাহেব হুজুরকে সালাম জানালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চলে এলেন।
ইসহাক ফরিদী রহ. আবদুর রাজ্জাক সাহেবকে মিষ্টি খাওয়ানোর কথা বললেন। হুজুর বললেন, আপনার নাম ইতিহাসে চলে এসেছে, মাসউদের বইয়ে চলে এসেছে। আপনাকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে। আবদুর রাজ্জাক সাহেব হুজুর চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী মুখে রুমাল গুজে দিয়ে হাসতে শুরু করলেন। হুজুরের হাসি থামানোই যাচ্ছে না।
এই দৃশ্য ইসহাক ফরিদী রহ.-এর খুবই ভালো লাগতো। হুজুরও হাসলেন। আমি দেখলাম, উস্তাদরা আমার সামান্য একটি বই নিয়ে কী পরিমাণ আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। একজন শিষ্যের প্রতি উস্তাদের এই কোমল ভালোবাসা কোনো কিছু দিয়েই তুলনীয় হবে না।
ইসহাক ফরিদী রহ.-এর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি লেখক ছিলেন। শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি কী পরিমাণ উজ্জলতর একজন আদর্শ ছিলেন তা আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। আমরা শিষ্যরা একটি ছোট্ট কথা বলে থাকি, হুজুর সবাইকে ভালোবাসতেন। কিন্তু প্রতিটি ক্লাসের শিক্ষার্থীরা মনে করতো, হুজুর আমাকে বেশি ভালোবাসেন।
হুজুরের কাছে আসা যাওয়া করে আর ওই ছেলের লেখালেখি ভালো লাগে না এটা বিরল। একজন চা পান করাবে, হুজুর লেখা অবস্থাতেই। একটু নাস্তা করাবে, তাও হুজুর লেখা বন্ধ করেই নাস্তা করতেন। ক্লাসে যেতেন তাও লেখা বন্ধ করে ক্লাসে যেতেন। আবার এসেই সংযুক্ত হতেন লেখায়। সেই রাতে যখন বাসায় ফিরতেন, একেবারে দশটার পর তখনো তিনি লেখালেখির খাতা বন্ধ করেই বাসায় ফিরতেন।
এককথায় বলা চলে, লেখালেখিটা হুজুরের নেশা ও পেশার রূপ ধারণ করেছিল। সহজ, সরল প্রকৃতির আমার এই উস্তাদ লিখতেন সাদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাওয়ার জন্যই।
যেদিন ইসহাক ফরিদী রহ. সড়ক দুর্ঘটনায় শাহাদত বরণ করেন সেদিনও হজরত নানুপুরী রহ.-এর উদ্দেশে একটি তাসাওফের বই লিখে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মরণেও লেখালেখিই সঙ্গে ছিল হুজুরের। এই পুস্তক আর পুস্তকের পুণ্যবানে ইসহাক ফরিদী রহ.-এর কবরকে আল্লাহ তায়ালা উজ্জ্বলতর করে দিন। আমিন।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আমার বার্তা
[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত সাময়িকী ‘লেখকপত্র’ এর সৌজন্যে]
এমএম/