সাজিদুল ইসলাম সাজিদ
হস্ত বা ইলাস্ট্রেশন ব্যবহারের মাধ্যমে অক্ষর সাজানোর যে শৈল্পিক প্রক্রিয়া দর্শকের দৃষ্টির সাথে সাথে চিত্তকেও প্রফুল্ল করে, সেই নান্দনিক শিল্পের নামই হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। এ ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রাচীন আমাদের বাংলা ক্যালিগ্রাফির ইতিহাসও।
বাংলা ক্যালিগ্রাফির নিদর্শন মেলে প্রাচীন মুদ্রা বা প্রস্তরখণ্ডে। সে আমলে বাংলা লেখা হতো সংস্কৃতি ও ব্রাহ্মী লিপিতে।
সুলতানি মুঘল আমলে বাংলা লিপিতে পরিবর্তন সাধিত হয়। বাংলা হরফের উচ্চারণের সুবিধার্থে ও আরবি ভাষার সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে সূচনা হয় বাংলা লিপির। পরবর্তীতে ক্ষেত্র বিশেষে সংযোজন বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমান বর্ণমালার উদ্ভব ঘটে।
বাংলা ক্যালিগ্রাফির সংজ্ঞা প্রদানে ক্যালিগ্রাফি গবেষক মোহাম্মদ আব্দুর রহীম বলেন, ‘শিল্পকলার শর্ত মেনে যে হস্তলিপি করা হয়, তাকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি বা বাংলা লিপিকলা বলা হয়।’ বাংলা ক্যালিগ্রাফির বিস্তারিত সংজ্ঞা প্রদান করেন বাংলা ক্যালিগ্রাফি গবেষক আরিফুর রহমান স্যার। তিনি বলেন, 'ক্যালিগ্রাফি হল ছন্দোবদ্ধ অক্ষরনৃত্যের বহিঃপ্রকাশ।
বর্ণ বা বর্ণমালা দিয়ে বিন্যাসিত সুন্দর হাতের লেখা বা হাতের লেখার বিদ্যাই হলো ক্যালিগ্রাফি। আর বর্ণমালা বাংলা হলে বাংলা ক্যালিগ্রাফি,আরবি হলে আরবি ক্যালিগ্রাফি' কিংবা চীনা ভাষায় হলে 'চায়নিজ ক্যালিগ্রাফি।
একই মত পোষণ করে আধুনিক বাংলা ক্যালিগ্রাফির প্রবক্তা ‘মাহাবুব মুর্শিদ’ বলেন, ‘ক্যালিগ্রাফি হল অক্ষর বা কতগুলো সত্যাশ্রয়ী বাক্যকে সুন্দর ও নিখুঁতভাবে সাজানো। যার প্রতিটি অক্ষরের সৌন্দর্য, নান্দনিকতা ও দৃষ্টিনন্দন বর্ণবিন্যাস এক অনাবিল আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আর আধুনিক ক্যালিগ্রাফি চর্চায় ক্যানভাসে অক্ষরের রেখা ও রঙয়ের দারুণ ছন্দ তৈরী করে।
অল্প শব্দ ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ অর্থ প্রকাশের শৈল্পিক মাধ্যম বাংলা ক্যালিগ্রাফি। বাংলা ভাষার শব্দশৈলী, শব্দের ঝংকার এবং এর নান্দনিক প্রকাশের মাধ্যম যে এতো বিচিত্র হতে পারে তা বাংলা ক্যালিগ্রাফি ছাড়া অনুধাবন করা সম্ভবপর নয়।
বাংলা ভাষার সৌন্দর্য, কল্পনা, হৃদয়াবেগ ও সমাজ জীবনের শিল্পময় রসঘন সত্যাশ্রয়ী বাক্য সম্ভারকে নান্দনিক শৈলীতে প্রকাশ ও প্রচার করাই এর উদ্দেশ্য। বাংলা ক্যালিগ্রাফি নিছক চোখের সৌন্দর্যই নয়। বরং ইসলামের শাশ্বত বাণী প্রচারেও রয়েছে এর অনেক ভূমিকা।
মুঘল আমলে অনেক মসজিদ মাদরাসার ফলকে কুরআন হাদিসের মর্মার্থ বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেই গৌরবের ধারাবাহিকতায়ই যেন বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে ঝুকছেন আজকের তারুণ্য।
তাদের বিশ্বাস শুধুমাত্র আরবি হরফের ক্যালিগ্রাফি হলেই যে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি হবে, আর বংলা বর্ণমালায় হলে হবে না এমনটা নয়।
তাদের সেই বিশ্বাস যে শতভাগ সত্য তার প্রমাণ মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী, আর মহান আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে (একটি নিদর্শন হলো) আসমান ও জমিন সৃষ্টি এবং মানুষের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। এর মধ্যে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য উপদেশ রয়েছে। (সুরা রূম : আয়াত : ২২)
এছাড়াও নবিজির মাতৃভাষার অনুরাগের কথা কে না জানেন? তিনি বলেছেন আরবি ভাষাকে আমি তিনটি কারণে ভালোবাসি, সেই তিন কারণের এক কারণ হচ্ছে আরবি নবিজির মাতৃভাষা।
আর মাতৃভাষায় দীনের দাওয়াত প্রচারে অধিক ফলপ্রসূ বলেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সব নবি রাসুলদের মাতৃভাষায় সু বক্তা করে পাঠিয়েছেন। সুতরাং বাংলা ক্যালিগ্রাফিও হতে পারে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি, যদি তার মধ্যে মূল উপজীবী থাকে কুরআন, হাদিস বা উপদেশমূলক সত্যশ্রয়ী বাক্য।
বলা বাহুল্য আমাদের অধিকাংশ বাংলা ক্যালিগ্রাফিই এই গুণে গুণান্বিত। তাই ইসলামের প্রচার ও প্রসারেও বাংলা ক্যালিগ্রাফির গুরুত্ব অপরিসীম ।
কেন না বাংলা বর্ণমালার নান্দনিকতায় নন্দিত ইসলামী ক্যালিগ্রাফির বাক্যসমূহ ভাবগম্ভীর, তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি অশ্লীলতা মুক্ত। আর এই সুন্দরের চর্চাকে রাসূল সা. প্রসাংশাও করেছেন।
তিনি বলেন, কিছু কিছু বর্ণনা তো যাদুর মতো। (আবু-দাউদ) অর্থাৎ কোনো কোনো ক্যালিগ্রাফির ক্যানভাসের ভাষার বর্ণনা যাদুর মতো আকর্ষন করে। যে আকর্ষণ মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথে আহবান করে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এই সুন্দরে কোনোভাবেই যেন অসুন্দরের দাগ না লাগে।
কেন না নবিজি বলেছেন, যে (ক্যালিগ্রাফির) বাণীকে বিন্যস্ত করা হয়েছে কিন্তু এর মাঝে কোন চিন্তা-চেতনাকে কাজে লাগানো হয়নি, সেই বাণী তার কারিগরকে নিক্ষেপ করবে এমন এক দোজখের মধ্যে, যার পরিধি ও ব্যাপ্তি পূর্ব এবং পশ্চিমের ব্যবধানকেও হার মানায়।' (বুখারি,মুসলিম)
-এটি