শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসানের ইন্তেকালে খেলাফত মজলিসের শোকপ্রকাশ কাল ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে বিএনপি মহাসচিবের শোক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ যেসব সুপারিশ সংস্কার কমিশনের বাংলাদেশিদের সুখবর দিলো ইতালি, পুনরায় ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা ও তার দোসরদের পুনর্বাসনে কোনো সাফাই নয়: সারজিস মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে সিলেট মহানগর জমিয়তের শোক পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৩ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু দাবি পূরণে ৭ দিনের আল্টিমেটাম ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের

শতাব্দীর চিঠি: ইতিহাসে ধারাবদলের মন্ত্র

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ফজলে এলাহী মামুন

শতাব্দীর চিঠি নামক রচনাটির কয়েক পর্ব পড়েছিলাম ফেসবুকে। সম্ভবত ২০১৭ সালে। তখনই একটি আলাদা মাধুর্য টপকাচ্ছিলো লেখাটিতে। কবি, দার্শনিক মুসা আল হফিজের এই রচনা আমার চোখে ছিলো বিশেষ কিছু । তাকে বার বার তাড়া দিয়েছি, অন্যসব কাজের ভিড়ে এই রচনা যেন অবহেলিত না হয়। একে পূর্ণতা দিয়ে বই আকারে যেন নিয়ে আসা হয়।

বিলম্ব হচ্ছিলো। কিন্তু অবশেষে তা বই আকারে এসেছে। এটা খুবই আনন্দের বিষয়। কারণ আমার কাছে, এ বই অন্য দশটি বইয়ের মতো নিছক কোনো বই নয়। লেখক স্বয়ং একই কথা বলেছেন। তার ভাষায়, ‘এ নিছক কোনো গ্রন্থ নয়। বাংলাদেশের যে অতীত হারিয়ে গেছে, যে অতীত হারানোর ফলে আমরা নিজেদের চিনতে পারি না, যে অতীতকে বুঝিনি বলে আজকের সঙ্কটকেও বুঝতে পারি না, এ চিঠি সে অতীতের দাস্তান।’

অতএব আমরা বইটির প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে পারি না। সৃষ্টিশীল লেখকদের প্রতিটি বই গুরুত্বের দাবি রাখে। তবে কিছু বই আলাদা আবেদন নিয়ে আমাদের চেতনায় নাড়া দেয়। কারণ সে বইগুলো আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলনামূলকভাবে বেশি। মুসা আল হাফিজের বই আমাদের জন্য সমৃদ্ধির বার্তা বহন করে। তার রচনায় আমাদের হারানো আত্মপরিচয় হিরের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। এ ধারার যেসব রচনা তিনি আমোদের উপহার দিয়েছেন, আমার মতে, শতাব্দীর চিঠি এর মধ্যে সেরা। একে তিনি ইতিহাস বর্ণনার জন্য লিখেননি। ইতিহাস বদলানোর জন্য লিখেছেন।

এ কথা সত্য যে, ইতিহাস বদলানো যায় না। তাহলে একটি বই কীভাবে ইতিহাস বদলাবার কাজ করে? এ প্রশ্নে জবাব সম্ভবত, এভাবে দেয়া যায়, একটি জাতির ইতিহাস যখন পরাজয়ের ও অবনমনের পথে ধাবিত হয়, তখন কিছু লেখকের কলম গতিপরিবর্তনের জন্য সক্রিয় হয়। জাতীয় ইতিহাস থেকে তারা খুঁজে বের করেন চলমান সঙ্কটের ধারা ও চরিত্র। ইতিহাস থেকে তারা নিয়ে আসেন দলিলপত্র। তাদের হাতে তখন রচিত হয় কালজয়ী কিছু বই। এসব বইয়ে অতীতের উল্লেখ থাকলেও বর্তমানের সঙ্কট ও করণীয় ইত্যাদি সেখানে না বলেই বলে দেয়া হয়। সে সব ঐতিহাসিক রচনা পরাজয়ের ধারার বিপরিতে বিজয়ের ধারায় জাতিকে পথপ্রদর্শন করে। এ বইগুলো আসলে ইতিহাস বর্ণনার বই নয়, ইতিহাস বদলানোর বই।

মুসা আল হাফিজ বাংলাদেশে মুসলিম জাতিসত্তার যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর স্বরূপ বুঝাতে চান, এক্সরে করতে চান। প্রেসক্রিপশন দিতে চান। এ জন্য তিনি এদেশের ইতিহাস ১৪১০-১০১৪ ও এর সমসাময়িক ঘটনাচক্রকে বেছে নিয়েছেন। যখন মুসলিম জাতিসত্তা ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছিলো এদেশে। এ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা এতাই ছিলো, এর মোকাবেলা করতে না পারলে এ দেশে মুসলিমদের অস্তিত্ব আর থাকতো না।

সেই সংকট কেন এসেছিলো? কীভাবে এসেছিলো? কাদের মাধ্যমে এসেছিলো? সংকটের ধরণ ও প্রকৃতি কেমন ছিলো? সংকটের বহি:প্রকাশ ও ফলাফল কেমন ছিলো? ইত্যাদির বিবরণ তিনি এমনভাবে দিয়েছেন, যার মধ্যে বর্তমানের ছবি দেখা যায়। ফলে বইটিকে মনে হয় একটি চলমান প্রতিবেদন।

এ সংকটের মোকাবেলায় ভূমিকা রেখেছিলেন মুসলিম বহু মনীষী। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহান মুজাদ্দিদ নুর কুতবুল আলম। একদিকে নুর কুতবুল আলম, অপরদিকে রাজা গণেশ। লড়াই আর লড়াই। প্রকাশ্য-গোপন কার্যক্রম। একদিকে চরম পরাজয়, অপরদিকে পরম বিজয়। বীরত্ব, কূটকৌশল, প্রতারণা, অভিযান, কান্না-হাসি, আত্মত্যাগ। একের পর এক দৃশ্য সামনে আসতে থাকে। ঘটনার ঘনঘটায় থাকে থ্রিল। ছোট-বড় বহু চরিত্রের সমাহার। একেবারে উপন্যাসের মতো।

সব কিছুর কেন্দ্রে নুর কুতুবুল আলম। তিনি এমন এক মুজাদ্দিদ, যিনি আজকের বাংলায় অপরিচিত মনে হলেও তিনি অপরিচিত নন। গোটা ভারতের তিনি ছিলেন নেতৃপুরুষ। তার জীবনবৃত্তান্ত লিখেছেন দিল্লির আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ, তার যোগ্যতায় বিস্ময় প্রকাশ করেন নিজাম উদ্দীন আওলিয়া রহ. তার সংস্কার ও সংগ্রামে প্রেরণা পান স্বয়ং শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি রহ.।

তার সময়টা ছিলো খুবই ভয়াবহ। তখন জাতিগতভাবে তখন বাঙালি মুসলমান পরাজিত। রাজা গণেশের হাতে মুসলিম জাতিসত্তা উচ্ছেদের সব আয়োজনই হয়ে যায় সম্পন্ন। সে পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে এই জাতিসত্তা কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখলো? সেই সংগ্রামের ইতিবৃত্ত কী? সেই ইতিবৃত্তের সাথে আজকের কোনো যোগসূত্র আছে কি না।

মুসা আল হাফিজ সেসব বিষয় খতিয়ে দেখেছেন বইটাতে। নিজেদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মশালকে হাতে নিয়ে আজকের সঙ্কট উজাতে দিশা প্রদর্শন করেছেন। বাঙালি ও বাংলাদেশের যে ঐতিহাসিক পর্বকে দাফন করা হয়েছে খুবই নিরবে। দাফন করা সেই ঐতিহ্য উদ্ধারের চেষ্টার নাম শতাব্দীর চিঠি।

বইটি সম্পর্কে খ্যাতিমান গবেষক প্রফেসর ড. রিজাউল ইসলামের মূল্যায়ন যথার্থ। তিনি লিখেছেন - ‘১৪৯২ সালে উন্দুলুসিয়ায় মুসলিম সভ্যতার যে কবর রচিত হয়, সে কবর বাংলাদেশে রচিত হয়েছিলো ১৪১০-১৪১৪ সালে। কবর কেন রচিত হয়? কীভাবে রচিত হয়? কী ছিলো এর মর্মমূলে? সে কবর থেকে উন্দুলুসিয়া জেগে উঠতে পারেনি, বাংলাদেশ পেরেছিলো। কেন পেরেছিলো? কীভাবে পেরেছিলো? কাদের মাধ্যমে পেরেছিলো? - এসব প্রসঙ্গ বাংলার মুসলিমের ইতিহাস ও জ্ঞানতত্ত্বে অনুপস্থিত।

বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের গোড়ায় থাকার কথা ছিলো যে ঐতিহ্যিক তত্ত্ব, সে তত্ত্ব তৈরী করে দিয়েছিলো ১৪১০-১৪১৪ সালের বাংলাদেশ। সেই হারানো সত্যকে খুঁজে পেলাম দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন ঐতিহাসিক মুসা আল হাফিজের শতাব্দীর চিঠি গ্রন্থে। লেখক একটি বইয়ে চলমান বুদ্ধিবৃত্তিক আবহাওয়ার বিপরিতে একটি প্রতিচিন্তা, প্রতিতত্ত্ব, প্রতিইতিহাস ও প্রতিমূল্যবোধ উপস্থাপন করেছেন। যেখান থেকে পথ পেতে পারে বাংলাদেশ, বাঙালি মুসলমান।’

শতাব্দীর চিঠি বাংলা ও বাঙালির একটি নিখোঁজ প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনের মধ্যে রয়েছে আপন অস্তিত্বের গোপন সূত্র। পুরো বইটি একটি চিঠি। নুর কুতবুল আলমের প্রতি লেখা। এই চিঠির ওসিলায় তখনকার গোটা বাংলার জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাসের পরিক্রমায় একেবারে আয়নার মতো ভাসতে থাকে। বইটি ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষক, গবেষকের জন্য যেমন সহায়ক, তেমনি সাধারণ পাঠকের জন্য স্বাদে, মাধুর্যে উপাদেয় এক পাঠ্য।

লেখক: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ