আবদুল্লাহ তামিম
ইশতিয়াক আহমদ। ঔপন্যাসিক, লেখক ও সম্পাদক। পাকিস্তানে এ নামেই তিনি খ্যাত। যিনি আট শতাধিক কিশোর গোয়েন্দা কাহিনির জনক। তার হাত ধরেই পাকিস্তানে সূচনা হয়েছিলো কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাসের পথচলা। পাকিস্তানের ইসলামি পাঠক মহলে ইশতিয়াক আহমদের রয়েছে আরও এক পরিচয়—আবদুল্লাহ ফারানি।
এটি তার ছদ্মনাম। যিনি জীবনের মাঝ বয়সে এসে ইসলাম নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। শিশু-কিশোরদের জন্য তাঁর কলম শানিত হয় ইসলামের সৌন্দর্য বর্ণনায়। ইসলামের ইতিহাস, সাহাবিদের জীবনগল্প শিশুসাহিত্যে তুলে আনেন উর্দুভাষায়।
সম্পাদনা করেন শিশুতোষ সাপ্তাহিক ম্যাগাজি ‘বাচ্চুঁ কা ইসলাম’। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এ পত্রিকাটির সম্পাদনা করেন। তার সম্পাদনায় ম্যাগাজিনটি বিরল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। লক্ষ কপি ছাড়িয়ে যায় সার্কুলেশন।
জীবনপথের যাত্রা: মরহুম আবদুল্লাহ ফারানির জন্ম ভারতের পানিপতে। ১৯৪১ সালে। দেশভাগের সময় পরিবারের অন্যদের সাথে পাকিস্তান হিজরত করেন। সেই থেকে তিনি পাকিস্তানে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। লেখাপড়া। কর্মজীবনে তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। বেড়ে ওঠেন দেশের জং শহরে।
না-ফেরার দেশে যাত্রা: ২০১৫ সালে আবদুল্লাহ ফারানি করাচি বইমেলায় নিজের সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘ইমরানের ফেরা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান উপলক্ষে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে করাচি বিমানবন্দরে হার্টঅ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।
পড়াশোনা: আবদুল্লাহ ফারানি এফএসসি পর্যন্ত পড়াশোন করেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবনগল্প’ বইয়ে তিনি লেখেন, আলোর ব্যবস্থা না-থাকায় রাস্তার পাশের লাইটের আলোতে পড়াশোনা করেছি’।
‘বাচ্চুঁ কা ইসলামে’র সম্পাদনা: ‘বাচ্চুঁ কা ইসলাম’ পাকিস্তানের দৈনিক ইসলামের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক প্রকাশনা। এ ম্যাগাজিনটি ২০০৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। আবদুল্লাহ ফারানি শুরু থেকেই এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন।
তার অধীনে ম্যাগাজিনটির সাত শ’ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশনাটি শিশু-কিশোর ছাড়াও বড়দের মাঝেও জনপ্রিয় ওঠে। উর্দুভাষার শিশুসাহিত্যেও রয়েছে ম্যাগাজিনটির বড় অবদান। ২০১৪ সাল পর্যন্ত আবদুল্লাহ ফারানি ‘বাচ্চুঁ কা ইসলামে’র সম্পাদনা করেন।
গোয়েন্দা উপন্যাস: ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম আবদুল্লাহ ফারানির গোয়েন্দ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বইটির জনপ্রিয়তাই তাকে প্রতি মাসে একটি করে গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে বাধ্য করে।
এভাবেই ৪২ বছরের লেখক-জীবনে আবদুল্লাহ ফারানি ৮ শতাধিক বই উপহার দেন। তাঁর প্রতিটি গল্পেই পাঠক নিজেকে গল্পের একজন চরিত্র হিসেবে ভেবে নিতেন। তাঁর উপন্যাসগুলো অন্তত দুই প্রজন্মের পড়ার সুযোগ হয়েছে।
ইসলাম নিয়ে লেখালেখি: আবদুল্লাহ ফারানি মূলত কিশোর গোয়েন্দা কাহিনি লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আলেমদের সাথে ওঠাবসার ফলে তার চিন্তা ও কর্মধারায় অনেক পরিবর্তন আসে। লেখার মধ্যেও আসে আমূল পরিবর্তন। একসময় নিছক উপন্যাস লেখার ধারা বাদ দেন।
একটি আদর্শ সামনে রেখে তিনি উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। হকের পক্ষে, ইসলামের পক্ষে আর বাতিলের বিরুদ্ধে কলম চালনা শুরু করেন। এই কাজটি তিনি করেন গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে। এতে অনেকেই তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কাদিয়ানি, বিদআতিসহ অন্যান্য বাতিল ফেরকার লোকজন।
কিন্তু একমুহূর্তের জন্য তিনি আদর্শচ্যুত হননি। বাচ্চুঁ কা ইসলামে ধারাবাহিকভাবে ছাপাবার জন্য তিনি কিছু লেখা তৈরি করেন। লিখতে শুরু করেন নবি ও সাহাবিদের জীবনীসহ ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়। পরবর্তীতে সেগুলোই বই আকারে বের হয়।
এই সময় তিনি অন্যান্য বইয়ের সাথে লেখেন সিরাতুন নবি কদম বকদম, (নবিজি), সিরাতুল আমবিয়া কদম বকদম (নবিদের জীবনকথা), খেলাফতে রাশেদা কদম বকদম (২ খণ্ড) (খেলাফতে রাশেদা), আইম্মায়ে আরবাআ কদম বকদম (চার ইমামের জীবনকথা)।
উম্মাহাতুল মুমিনীন মাআ বানাতে আরবাআ কদম বকদম (মুমিনদের মা) রওশন সেতারে, রওশন কিনদিলেঁ, আযাদি কদম বকদম (৩ খণ্ড), উমরে সানি কদম বকদম, ওয়াকেয়াতে সাহাবা (২ খণ্ড), ইসলামি জঙ্গেঁ প্রভৃতি। কাসাসুল আমবিয়া সিরিজ লেখেন ৩০ খণ্ডে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও তার গ্রন্থ অনুবাদ শুরু হয়েছে।
বাংলাভাষায় অনূদিত তার বইয়ের মধ্যে আছে আহসান ইলিয়াস অনূদিত আলোর দিশারি, এক যে ছিল বীর ও নবিজি। আবদুল্লাহ ফারানি বিশ্বসাহিত্যে চির অমর হয়ে থাকবেন বাংলাভাষায় অনূদিত এ বই কটি সে কথাই বলে।
-এটি