কৌশিক পানাহী: তখন জুলাই মাস, বর্ষার দুপুর। সদ্য স্কুল পাশ করে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে কলেজে ভর্তি হতে গিয়েছিল ১৬ বছরের ছেলেটি। ফেরার সময় ছিল তুমুল বৃষ্টি। রাস্তা দেখা যায় না এমন অবস্থা।
ওই সময় চাকার তলায় পড়ে যায় একটি গর্ত। উল্টে যায় মোটরসাইকেল। আঘাত পেয়ে মাথার ভেতরে প্রবল রক্তক্ষরণ ঘটায় হেমারেজেই মারা যায় ছেলেটি। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায় চাচাতো ভাই।
২০১৬ সালের ৮ জুলাই এই দুর্ঘটনা ঘটে, যা বদলে দেয় বছর চল্লিশের দাদারাও ভিল্লোরের জীবন। দুর্ঘটনায় মৃত রাম ভিল্লোর নামের ওই ১৬ বছরের ছেলেটির বাবা যে তিনি!
রাস্তার গর্তের কারণে দাদারাও ভিল্লোর দুর্ঘটনায় হারিয়েছিলেন একমাত্র সন্তানকে। তারপর থেকে গর্তই শত্রু তার। তবে এ শত্রুতার প্রকাশ ইতিবাচক।
সেদিন থেকেই দাদারাও শপথ নেন, আর কোনো সন্তানের প্রাণ যাতে গর্তের জন্য খোয়া না যায়, সে জন্য আজীবন চেষ্টা চালাবেন তিনি।
যেমন ভাবা তেমনই কাজ। পথ সংস্কারের কাজ শুরু করেন ভারতের আন্ধেরি প্রদেশের দাদারাও। চলার পথে, বাড়ির আশপাশে, আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে, যেখানেই দেখেন রাস্তার ক্ষত, পাথর-বালি-সিমেন্ট জোগাড় করে লেগে যান সংস্কারে। একাই।
গ্রীষ্মের খররোদ বা বর্ষার ঝুম বৃষ্টি বা কনকনে শীতের সন্ধ্যা– দাদারাও গর্ত দেখলেই লেগে যান সংস্কারে।
দাদারাও বলেন, ‘কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না ছেলেটার চলে যাওয়া। কী করব, তাও বুঝতে পারতাম না। শুধু মাথায় ঘুরতো, রাস্তার একটা গর্ত আমার ছেলেটাকে ছিনিয়ে নিল! তার পর থেকে আশপাশে গর্ত বা ভাঙাচোরা রাস্তা দেখলেই অস্বস্তি হতো। কী এক তীব্র কষ্ট হতো।
এক দিন, আশপাশ থেকে মাটি-নুড়ি-পাথর খুঁজে এনে নিজেই সারলাম একটা গর্ত। সমান করলাম রাস্তাটা। দেখলাম, একটু শান্তি লাগলো। এই করেই শুরু করলাম। একাই। কোথাও গর্ত দেখলে, সেটা না সারানো পর্যন্ত স্বস্তি পাই না।’
তার ভাষ্য, ‘পুত্রশোকের অতল পারাবারে একমাত্র খড়কুটো এই কাজটিই। সরকার-প্রশাসনের দারে দারে ঘুরে ঘুরেও কোনও বিচার পাইনি ছেলের মৃত্যুর। কাউকে বোঝাতেই পারিনি, রাস্তার এই গর্ত সড়ক দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ হয়ে উঠছে শহরে। বিশেষ করে বর্ষাকালে মুম্বাইয়ের রাস্তাঘাট যেন মারণফাঁদ হয়ে ওঠে এই গর্তের কারণেই।’
রাস্তা সংস্কার করতে গিয়ে কারও সাহায্য না পেলেও পেয়েছেন বাধা। দাদারাও দাবি করেন, কাজ বন্ধ করার শর্তে মুম্বাই সরকার নোটিশ পাঠায় তাকে। তার ‘মর্জিমাফিক’ সংস্কার করা রাস্তায় নাকি খুঁত থেকে যাচ্ছে! এতে নাকি হিতে-বিপরীত করছেন তিনি! রাস্তার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রভাব পড়ছে এতে!
ক্ষোভে ফেটে পড়ে দাদারাও বলেন, ‘যে ইঞ্জিনিয়ারিং একটা ছেলের প্রাণ কেড়ে নেয়, সে ইঞ্জিনিয়ারিং আমি মানি না।’
মানসিক তাড়না আর তৃপ্তির যুগলবন্দি আজও ঘরে বসে থাকতে দেয় না দাদারাওকে। তার স্ত্রীরও বিশ্বাস, এতেই হয়তো শান্তি পাবে তাদের মৃত ছেলে। প্রায়ই বিভিন্ন নির্মাণস্থলের আশপাশে ঘুরতে দেখা যায় দাদারাওকে। শুধু পাথর দিয়ে নয়; আজকাল চেয়েচিন্তে জোগাড় করেন ফেলে দেওয়া পাথর, সিমেন্ট। তাই দিয়ে গর্ত ভরেন।
মুম্বাইয়ের লোকজনের কাছে ‘পটহোল ম্যান’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন দাদারাও। হিসাব নেই, তবে তার সারিয়ে তোলা গর্তের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে গত দুই বছরে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে প্রকাশ, ‘ইংরেজি প্রবাদ বলে, ইফ ইউ ওয়ান্ট দ্য চেঞ্জ, বি দ্য চেঞ্জ। দাদারাওয়ের প্রথাগত শিক্ষার দৌড় হয়তো খুব বেশি নয়। কিন্তু এই ইংরেজি প্রবাদকে নিজের জীবন দিয়ে সত্যি করে চলেছেন ‘পটহোল ম্যান’।
৩০ বছর ধরে স্বেচ্ছায় রাস্তা ঝাড়ু দেন জয়পুরের শাকিল