মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব
কোনো কোনো ব্যবসায়ী আছেন, যাদের কাছে মাল মজুত থাকে না, তারা নিজেদের কাছে মালের নমুনা রাখেন মাত্র। গ্রাহককে নমুনা দেখিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করেন। পারস্পরিক ক্রয়-বিক্রয় করার পর ক্রেতার কাছ থেকে মূল্য নিয়ে অন্য আড়তদার থেকে মাল ক্রয় করে ক্রেতাকে সরবরাহ করেন।
যেমন জনৈক ব্যবসায়ী এক ব্যক্তির কাছে ২ লাখ টাকার বিনিময়ে এক হাজার গেঞ্জি নমুনা দেখিয়ে কয়েক দিন পর হস্তান্তর করার চুক্তিতে বিক্রি করেছেন এবং বেচাকেনার সময়ই তার মূল্য গ্রহণ করে নিয়েছেন।
কিন্তু তার কাছে বেচাকেনার সময় ওই গেঞ্জি ছিল না। তিনি কোনো ফ্যাক্টরিতে অর্ডার দিয়ে তা তৈরি করে ক্রেতাকে হস্তান্তর করবেন- এ হচ্ছে তার নিয়ত।
অথবা একজন আমদানিকারক, যিনি বিদেশ থেকে বিভিন্ন মালামাল আমদানি করেন। বিভিন্ন বিদেশি পণ্যের নমুনা এনে দেশীয় কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে তিনি শুধু নমুনা দেখিয়ে দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে মূল্য নির্ধারণপূর্বক বেচাকেনা সম্পন্ন করেন এবং অগ্রিম টাকাও নিয়ে নেন। এরপর বিদেশি বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করেন।
বিদেশি বিক্রেতার কাছ থেকে মাল ক্রয় করে দেশীয় কোম্পানিকে হস্তান্তর করেন। এ ধরনের নানা ব্যবসায়িক পদ্ধতি আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে। জানার বিষয় হলো, এভাবে নমুনা দেখিয়ে অগ্রিম মাল বিক্রি করা জায়েজ হবে কি না?
আধুনিক মাসায়েল জানতে সংগ্রহ করুন এ বইটি
সামগ্রিকভাবে এই প্রশ্নের জবাব আসে না। এ ধরনের ব্যবসা জায়েজ নয়। কেননা এজাতীয় ব্যবসায় যে পণ্যটি বিক্রেতার মালিকানায় নেই সেরকম একটি পণ্যকে বিক্রি করা হয়। আর কোনো পণ্যকে নিজের মালিকানায় হস্তগত করার আগে ওই পণ্য বিক্রি করা জায়েজ নেই।
যদিও এ বিষয়ে মাজহাবের ইমামদের মাঝে কিছুটা মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। যেমন- ইমাম শাফেঈ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর কাছে পণ্য খাদ্যদ্রব্য হোক বা অন্য বস্তু হোক, স্থাবর হোক বা অস্থাবর, হস্তগত করার আগে তা বিক্রি করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। (তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম ১/৩৩৮; আলমুগনী ৪/১১৩)।
ইমাম আবু হানিফা রহ. ও ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, অস্থাবর জিনিস, চাই তা খাদ্যদ্রব্য হোক বা অন্যকিছু, হস্তগত করার আগে বিক্রি করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। তবে স্থাবর জিনিস হস্তগত করার আগে বিক্রি করা জায়েজ।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, শুধু খাদ্যদ্রব্য হস্তগত করার আগে বিক্রি করা নাজায়েজ।
ইমাম মালেক রহ. খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে ওজন-পরিমাপিত ও পরিমাণ-পরিমাপিত বস্তু হস্তগত করার আগে বিক্রি করা নাজায়েজ।
এ মতবিরোধের মূল কারণ হলো, হস্তগত করার আগে কোনো জিনিস বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত হাদিসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত পেশ করেছেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, যেহেতু হাদিসে খাদ্যদ্রব্যের কথা উল্লেখ রয়েছে, কাজেই খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গেই নিষেধাজ্ঞা নির্দিষ্ট। খাদ্যদ্রব্যের বাইরে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। সুতরাং খাদ্যদ্রব্য ছাড়া বাকি জিনিস হস্তগত করার আগে বিক্রি করা বৈধ।
ইমাম মালেক রহ. এর ব্যাখ্যা হলো, হাদিসে খাদ্যদ্রব্যে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, কেননা তা ওজন-পরিমাপিত বা পরিমাণ-পরিমাপিত বস্তু। সুতরাং ওজন-পরিমাপিত ও পরিমাণ-পরিমাপিত জিনিস ছাড়া অন্য বস্তুর ক্ষেত্রে হস্তগত করার আগে বিক্রি জায়েজ হবে।
আসল ব্যাপার হলো, এখানে শরিয়তের বড় একটি মূলনীতি রয়েছে- কোনো জিনিস থেকে লাভবান হওয়ার জন্য ওই জিনিসটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মালিকানায় ও তার দায়িত্বে থাকতে হবে। দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া মুনাফা লাভ শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের ওইসব জিনিস বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন, যা আমাদের মালিকানায় বা জিম্মায় নেই। নিষেধাজ্ঞার কারণ ও মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যে জিনিস এখনও জিম্মায় বা দায়িত্বে আসেনি, তার ওপর মুনাফা গ্রহণ করা বৈধ নয়।
জিম্মায় আসার অর্থ হলো, যার জিম্মায় থাকবে মাল নষ্ট হলে সে-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন- করিম থেকে রাশেদ একটি মোবাইল ফোন কিনেছে। কিন্তু এখনও সে তা হস্তগত করেনি বা তার জিম্মায় আসেনি। এ অবস্থায় মোবাইল ফোনটি চুরি হয়ে গেলে করিম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পক্ষান্তরে রাশেদের হস্তগত করার পর অর্থাৎ মোবাই ফোনটি তার জিম্মায় আসার পর যদি চুরি হয়ে যায়, তাহলে রাশেদই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাশেদ এ কথা বলতে পারবে না, আপনার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে যাওয়ার সময় তা চুরি হয়ে গেছে। কাজেই আমার টাকা ফেরত দিন।
এ মূলনীতির সারকথা হলো, মুনাফা তখনই গ্রহণ করা যাবে, যখন সে তার জিম্মাদারি নেবে। লাভ-লোকসানের ঝুঁকি নেবে। হস্তগত করার আগে বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ার মূল কারণ হলো, জিম্মাদারি বা দায়িত্ব গ্রহণের আগে বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়া।
কারণ হস্তগত করার আগে কোনো জিনিসের ওপর জিম্মাদারি বা দায়িত্ব বর্তায় না। এটা শরিয়তের একটি বড় মূলনীতি। এ নীতির আলোকে অসংখ্য মাসআলা উদ্ভাবিত হয়।
মোটকথা, নিজের মালিকানায় যে পণ্য এখনও আসেনি, শুধু নমুনা দেখিয়ে সে পণ্য বিক্রি করা জায়েজ নয়।
কেননা এ ব্যাপারে সরাসরি হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হাকিম ইবনে হিযাম রা. বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করি। এর কোন পন্থাটি হালাল, কোনটা হারাম?
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, যখন তুমি কোনো পণ্য ক্রয় করবে, তখন তা হস্তগত করার আগে অন্যত্র বিক্রি করবে না। (মুসনাদে আহমদ : ১৫৩১৬)।
ওমর রা. বলেন, যখন তুমি কোনো বস্তুতে সালাম-চুক্তি করবে, তখন তা হস্তগত হওয়ার আগে অন্যত্র বিক্রি করবে না।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা : ১১/৩২; মুসনাদে আহমদ : ৩/৪০২; হেদায়া : ৩/৯৭; ফাতহুল কাদির : ৬/১৩৫; বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৯৭)।
আরেকটি হাদিসে এসেছে, আবুল ওয়ালিদ রা. ইবনে ওমর রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘খাদ্য খরিদ করে কেউ যেন তা হস্তগত করার আগে বিক্রি না করে।’ (বোখারি : ৩৪৩)।
অতএব মালিকানায় মাল বা পণ্য না থাকলে নমুনা দেখিয়ে বিক্রি করা জায়েজ হবে না। তবে জায়েজ হওয়ার বিকল্প একটি পদ্ধতি হতে পারে। তাহলো, যখন কেউ মালের অর্ডার নেবে, তখন ক্রয়-বিক্রয় চূড়ান্ত করবে না, বরং অ্যাগ্রিমেন্ট টু সেল বা ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিশ্রুতি নেবে মাত্র।
এ অ্যাগ্রিমেন্ট টু সেলের পর যখন মাল আড়তদার থেকে ক্রয় করে কিংবা নিজে তৈরি করে, অথবা অন্য কারও দিয়ে তৈরি করিয়ে হস্তগত করবে, তখন প্রকৃত ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি নতুন করে সম্পন্ন করবে। এক্ষেত্রে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো লক্ষণীয়।
১. অ্যাগ্রিমেন্ট টু সেলের দ্বারা যে ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি হয়, এর দ্বারা মালের মালিকানা ক্রেতার কাছে হস্তান্তর হয়ে যায় না।
২. অ্যাগ্রিমেন্ট টু সেলের পর মালের ক্ষতিপূরণের জিম্মাদারি ক্রেতার ওপর চলে আসে না, বরং তা বিক্রেতার মালিকানায়ই থেকে যায়।
৩. যদি অ্যাগ্রিমেন্ট টু সেলের পর মাল অন্য কোথাও বিক্রি করে ফেলে, তাহলে বিক্রয় শুদ্ধ হবে; কিন্তু তা নৈতিকতার পরিপন্থি হবে।
৪. যদি অ্যাগ্রিমেন্ট টু সেলের পর বিক্রেতা (আল্লাহ না করুন) দেউলিয়া হয়ে যান, তাহলে ক্রেতা এ কথা বলতে পারবে না যে, যেহেতু আমি মাল ক্রয় করে ফেলেছি, সেহেতু তা আমাকে দিয়ে দিন। (তিরমিজি : ১/২৩৩; মেশকাত : ৬/৭৮; আদ্দুররুল মুখতার : ৫/৫৮-৫৯; উমদাতুল কারি : ৮/৪৩৪; ফয়জুল বারি : ৩/২২৩; ফাতহুল বারি : ৪/৩৫২; ইনআমুল বারি : ৬/২৪৬; তাকরিরে তিরমিজি : ১/১১৮)।
লেখক: সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন আলহেরা ও সহকারী মুফতি, জামিয়া রহমানিয়া সওতুল হেরা, টঙ্গী, গাজীপুর
-আরআর