মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুম
সহকারী মুফতি, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ
যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই তা সঠিকভাবে আদায় করা জরুরী। নামায যেমন সঠিকভাবে আদায় করতে হয়। তেমনি যাকাতও সঠিকভাবে আদায় করতে হবে। আদায়ে ভুল বা ত্রুটি যেন না হয়। এখানে যাকাত আদায়ে বহুল প্রচলিত কিছু ভুল-ত্রুটি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। যেন আমরা এসব ভুল থেকে সহজে বেঁচে থাকতে পারি। এর সাথে যাকাত বিষয়ে চিন্তাগত কিছু ভুলও উল্লেখ করা হয়েছে।
১. যাকাতবর্ষ কবে পূর্ণ হয় তা যথাযথভাবে হিসাব না রাখা। শুধু প্রতি রমযানে যাকাত আদায় করা। এটি ঠিক নয়। কারণ, বাস্তবে যদি রমযানের আগেই আপনার যাকাতবর্ষ পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে রমযানের আগের দিনগুলোর যাকাত অনাদায়ী থেকে যাবে। তাই করণীয় হল, চিন্তা-ভাবনা করে হিসাব করে চন্দ্র বর্ষ অনুাযয়ী যাকাতবর্ষ ঠিক করা।
২. যথাযথ হিসাব না করে অনুমান করে যাকাত আদায় করা। এটিও ঠিক নয়। নামায যেমন অনুমান করে পড়া যায় না। তেমনি যাকাতও অনুমান করে আদায় করা যায় না। এতে যাকাত অনাদায়ী থেকে যেতে পারে। তাই যথাযথ হিসাব করে যাকাত আদায় করা জরুরী।
৩. অনেকের ধারণা, নগদ ক্যাশের যাকাত আদায়ে স্বর্ণের নেসাব ধর্তব্য হবে। সুতরাং সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণের মূল্যে নগদ ক্যাশ না পৌঁছলে যাকাত দিতে হবে না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। নগদ ক্যাশে রূপার নেসাব ধর্তব্য হয়। এমনকি সাড়ে সাত ভরির কম স্বর্ণের সাথে যদি নগদ ক্যাশ থাকে তাহলে সেক্ষেত্রেও স্বর্ণের নেসাব ধর্তব্য নয়; বরং রূপার নেসাব ধর্তব্য হবে। হাঁ, কারো কাছে যদি কেবল স্বর্ণ থাকে, এর সাথে যাকাতযোগ্য অন্য কোনো সম্পদ না থাকে তাহলে কেবল সেক্ষেত্রে স্বর্ণের নেসাব ধর্তব্য হবে।
৪. অনেকের ধারণা, প্রতি টাকায় এক বছর অতিক্রান্ত হতে হবে। এটি অত্যন্ত ব্যাপক একটি ভুল ধারণা। যাকাত আদায় আবশ্যক হওয়ার জন্য প্রতি টাকায় স্বতন্ত্র এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়। যেদিন যাকাতবর্ষ পূর্ণ হবে সেদিন হাতে নগদ টাকা যা থাকবে সবগুলোর আড়াই পার্সেন্ট যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে। এমনকি একদিন আগে যে টাকা হাতে এসেছে এরও যাকাত দিতে হবে।
৫. যাকাত হিসাবে বাজরে প্রচলিত যাকাতের শাড়ী ও লুঙ্গী আদায় করা। এটি মোটেও ঠিক নয়। প্রথমত, যাকাত হিসেবে নগদ ক্যাশ আদায় করা নিয়ম। কারণ এর মাধ্যমে যাকাত গ্রহীতা তার সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এসব শাড়ী হয়ে থাকে খুবই নি¤œমানের। খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। অতএব এ থেকে বিরত থাকা উচিত।
৬. অনেকের ধারণা যাকাত আদায় করলে সম্পদ হ্রাস পায়। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সুদ সম্পদ বৃদ্ধি করে এ ধারণা যেমন সঠিক নয়, তেমনি যাকাত সম্পদ হ্রাস করে এটিও ঠিক নয়। সম্পদের মালিক আল্লাহ সুবহানাহু। তিনিই আমাদেরকে সম্পদ দান করেন। তিনি স্বয়ং ঘোষণা দিয়েছেন-যাকাতে সম্পদ হ্রাস হয় না;বরং বৃদ্ধি হয়।
৭. বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে যাকাত প্রদান। এটি ঠিক নয়। এতে যাকাতের উপযুক্ত কাউকে মালিকানা প্রদান করে যাকাত আদায় করা হয় না। অতএব এভাবে যাকাত দিলে তা আদায় হবে না।
৮. মসজিদের দান বাক্সে বা নির্মাণ কাজে যাকাত প্রদান। এটিও ঠিক নয়। এভাবে যাকাত আদায় হবে না।
৯. মাদ্রাসার নির্মাণ কাজ, মাদ্রাসার উস্তাযদের বেতন-ভাতা এসব খাতেও যাকাত প্রদান করা যাবে না।
১০. রমযানের হাফেযদেরকে হাদীয়ার নামে যাকাতের অর্থ প্রদান। এটিও ঠিক নয়। কারণ, হাফেয সাহেব যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত নাও হতে পারেন। উপয্ক্তু হলেও এতে পারিশ্রমিকের গন্ধ আছে। তাই তারাবীহের নামায পড়ানোর উপলক্ষ্যে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। অবশ্য যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হলে রমযানের আগে পরে দেয়া যাবে।
১১. অনেক নারী তাদের ব্যবহৃত স্বর্ণ/রূপার অলংকারের যাকাত আদায় করে না। এটি মোটেও ঠিক নয়। এ ব্যাপারে পূর্বে হাদীস উল্লেখ হয়েছে যে, যেসব নারী স্বর্ণ/রূপার অলংকারের যাকাত প্রদান করে না তাদেরকে কেয়ামতের দিন আগুনের অলংকার পরিধান করানো হবে। অতএব এ ব্যাপারে নারীদের পাশাপাশি পিতা ও স্বামীদের সচেতন হওয়া আবশ্যক।
১২. কাজের বুয়াকে যাকাত প্রদান। এটিও ভুল। অনেকে ঈদের সময় যাকাতের টাকা থেকে তাদের বেতন বাড়িয়ে দেয়। তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হলেও তা বৈধ নয়। কারণ পারিশ্রমিক বাবদ যাকাত আদায় করা যায় না। তাদেরকে যাকাত দিতে হলে বেতন-বোনাস বাদ দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে দিতে হবে। (যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়)
১৩. ঋণ হিসাবে সুদের অংশও বিয়োগ করা। এটি ভুল। ঋণ বা দেনা হিসাবে সুদ থাকলে সেটা বিয়োগ দেয়া যাবে না। যেমন, কেউ কারো থেকে এক লক্ষ টাকা সুদে করজ নিয়েছে। তাকে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা শোধ করতে হবে। তাহলে সে যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে কেবল এক লক্ষ টাকা বিয়োগ দিতে পারবে। বিশ হাজার নয়।
১৪. সুদী উপার্জন বা উপার্জনের পুরোটাই সুদী। যেমন, সুদী ব্যাংকে চাকরী করা। যদিও সুদের অর্থে যাকাত নেই। এর পুরোটাই সওয়াবের নিয়ত ছাড়া দানযোগ্য। তদুপরি পুরোটা দান সম্ভব না হলে যাকাত আদায় করে যাওয়া উচিত। এতে কিছু হলেও দান হবে।
১৫. যাকাত আদায়ে নিজ আত্মীয়দের মাঝে যারা উপযুক্ত তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে যাকাত দেয়া উচিত। অনেকেই এ ব্যাপারে অবহেলা করেন।
১৬. অনেকে লোক দেখানোর জন্য গরীবদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি প্রদান করে। এটি মোটেও ঠিক নয়। যাকাত একটি ইবাদত। সব ইবাদতই একমাত্র আল্লাহর জন্য করতে হয়। অন্য কারো জন্য নয়।
১৭. যেকোনভাবে খরচ করা যাকাত আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়। কোন কোন বিত্তশালী ভাই মনে করেন, আমরা তো বিভিন্ন উপলক্ষ্যে খরচ করে থাকি। অসহায় লোকদেরকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকি। অফিসের কোন কর্মচারী অসুস্থ হলে চিকিৎসা খরচ বহন করি। এভাবে পুরো বছর বহু আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। সুতরাং আমাদের জন্য আলাদাকরে যাকাত দেয়ার প্রয়োজন নেই ।
এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ও খামখেয়ালি। মনে রাখতে হবে, যাকাত একটি ইবাদত। এটি আদায়ের জন্য খোদ রাব্বুল আলামীন এর নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কী ধরনের সম্পদ থেকে কী পরিমাণ যাকাত দিতে হবে এবং কোথায় কাদেরকে দিতে হবে সবই নির্ধারিত। এসব নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান অনুসরণ করে যাকাতের নিয়তে সম্পদ খরচ করাকে যাকাত বলে। নিজের খুশিমত জন-কল্যাণমূলক কোন কাজে খরচ করা বা ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আর্থিক সহায়তা দেয়া এটি ইখলাসের সাথে হলে নিঃসন্দেহে তা বড় সওয়াবের কাজ। কিন্তু যাকাত আদায়ের জন্য যাকাতের মাসায়েল অনুসারে পাই-পয়সার হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে।
১৮. অনেকে যাকাত আদায়ের দিন কেবল মোটা অংকের নগদ ক্যাশে হিসাব করে। জামার পকেটে বা মানি ব্যাগে যে ভাংতি কিছু টাকা থেকে যায় তা হিসাবে নিয়ে আসা হয় না। ফলে দেখা যায়, এই খুচরা টাকাগুলোর যাকাত অনাদায়ী থেকে যায়। অথচ যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে নিয়ম হল, পাই পাই হিসাব করে যাকাত আদায় করা।
১৯. যাকাতকে ট্যাক্স মনে করা। যাকাতকে ট্যাক্স মনে করা সম্পূর্ণ মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। যাকাতের সাথে ট্যাক্সের বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। এ দুটির মাঝে মৌলিক পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ-
- যাকাত একটি খালেস ইবাদত।
-যাকাত আদায়ের খাত সুনির্ধারিত। যা ট্যাক্সে নেই।
-যাকাতের খাত ফকীর-মিসকীন। অথচ ট্যাক্সের সুবিধা ভোগ করে সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ।
-ট্যাক্স আসে ইনকামের উপর (ইনকাম ট্যাক্স)। অথচ যাকাত আসে যাকাতযোগ্য সম্পদের মূলে।
২০-যাকাতের মাধ্যমে আখলাকের পরিশুদ্ধি ও সম্পদের পবিত্রতা অর্জন করা উদ্দেশ্য হয়। এর সাথে ট্যাক্সের কোন মিল নেই। মোটকথা, যাকাত ও প্রচলিত ট্যাক্স মোটেও এক নয়। এ দুটির মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
২১-যাকাত দাতা হওয়া ও সাহেব নেসাব হওয়া দুটির মঝে পার্থক্য আছে। সাহেবে নেসাব হওয়ার পর বছর অতিক্রান্ত হলেই তিনি যাকাত দাতা হন। কিন্তু হাওল হওয়ার আগে সাহেব নেসাব থাকাকালীন তিনি যাকাত নিতে পারেন না।
যাকাত গ্রহণ না করার উপযুক্ত হওয়ার মাণদন্ড একটু ভিন্ন, সাহেব নেসাব হওয়াই যথেষ্ট যাকাত গ্রহণ করতে না পারার জন্য।
শুধু তাই নয়, বরং এক্ষেত্রে নেসাব হয় প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ দিয়ে। সোজ কথা, সাদাকাতুল ফিতর, কোরবানীর যে নেসাব সেটা মূল। এটা থাকলে যাকাত নিতে পারে না। যদিও তার উপর যাকাত দেয়া জরুরী নয়।
এছাড়া যাকাত আদায়ে আরো অনেক ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে। আমাদের উচিত প্রথম কয়েক বছর বিজ্ঞ কোনো আলেমের সাথে বিস্তারিত পরামর্শ করে যাকাত আদায় করা। তাহলে অনেক ভুল-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকা যাবে ইনশাআল্লাহ।