[২/৪/২০১৮ ইংরেজি রোজ সোমবার, বাদ ইশা জামি‘আতুল আবরার, বছিলা, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা-এর “মসজিদে আবরার”-এ জামি‘আর আসাতিযায়ে কেরাম এবং দাওয়াত ও তাবলীগের সাধারণ সাথীদের এক জোড়ে শাইখুল হাদিস মুফতী মনসূরুল হক এর বয়ানের পরিমার্জিত সারসংক্ষেপ।
উল্লেখ্য, এ সিদ্ধান্তের উপর দেশের শীর্ষ মাদরাসার ফতোয়া বিভাগগুলো একমত পোষণ করে এবং সাক্ষর করে। নিচে স্বাক্ষরসম্বলিত কাগজ যুক্ত করা হলো ]
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, তাঁর রাসূলের, এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখতেয়ারীধারী, তাদেরও”। [সূরা নিসাঃ ৫৯]
এ আয়াতে পাকে আল্লাহ তা‘আলা তিন সত্ত্বার “ইতাআত” বা অনুসরণ করতে বলেছেন-
১. আল্লাহ তা‘আলার অর্থাৎ কুরআনে কারীমের।
২. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অর্থাৎ তাঁর সুন্নাতের [এবং সুন্নাতের ধারক-বাহক সাহাবায়ে কেরামের]।
৩. উলামায়ে কেরাম এবং মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় নেতার। [আয়াতের মধ্যে “এখতেয়ারীধারী” দ্বারা এ দু’শ্রেণিই উদ্দেশ্য।
[দ্রষ্টব্য: তাফসীরে ইবনে কাসীর; সূরা নিসাঃ আয়াত ৫৯]
তবে তৃতীয় শ্রেণির ব্যক্তিদের অনুসরণের জন্য শর্ত হলো, তারা “হক” [সত্য ও সঠিক পথ ও মত]-এর উপর থাকতে হবে। যদি তারা হকের উপর না থাকে, কোনো ভ্রান্তির শিকার হয়ে যায়, কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো নাজায়িয কাজের হুকুম দেয়, তবে সে উলামায়ে কেরাম এবং রাষ্ট্রীয় নেতার “ইতাআত”ও বৈধ নয়।
সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় [হাদীস নং ৪৩৪০] এসেছে, নবীজি এক আনসারী ব্যক্তিকে একটি ছোট দলের আমীর বানিয়ে প্রেরণ করলেন এবং লোকদেরকে তাঁর অনুসরণ করতে বললেন। উক্ত ব্যক্তি অধীনস্থ সাহাবায়ে কেরাম থেকে তার “ইতাআত”-এর স্বীকৃতি নিয়ে লাকড়ি জমা করতে এবং আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দিলো।
ঘরে বসে কিনুন ফাযায়েলে সাদাকাত
যখন আগুন জ্বালানো হলো, তখন ওই ব্যক্তি অধীনস্থ সাহাবায়ে কেরামকে আগুনে প্রবেশ করার আদেশ প্রদান করলো! কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম এ “ইতাআত” থেকে বিরত থাকলেন এবং বিষয়টি নবীজির কাছে গিয়ে উত্থাপন করলেন।
তখন নবীজি বললেন, “যদি তোমরা আগুনে প্রবেশ করতে, তবে কেয়ামত পর্যন্ত আর তা থেকে বের হতে পারতে না। “ইতাআত” কেবল পুণ্যের মধ্যে [বৈধ আছে]”।
সারকথা, উল্লিখিত আয়াত এবং হাদীস দ্বারা কয়েকটি বিষয় বুঝে আসে-
(১) কোনো স্থানের “ইতাআত” বৈধ নয়। যদিও তা অনেক বরকতময় হোক না কেন। কেননা, তা উল্লিখিত তিন শ্রেণিসত্ত্বার অন্তর্ভুক্ত নয়।
(২) কোনো জাহেল বা অজ্ঞ ব্যক্তির অনুসরণ বৈধ নয়।
(৩) কোনো আলেমের “ইতাআত” ততক্ষণ বৈধ হবে, যতক্ষণ সে হকের উপর থাকবে।
বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলীগে যে ফেতনা হচ্ছে, আমাদের এক শ্রেণির ভাইয়েরা তিনটি ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন-
ক. তাঁরা বলছেন, “আমরা নিযামুদ্দীনের ইতাআতে আছি এবং থাকবো”। এ কথাটি সম্পূর্ণরূপে উক্ত আয়াতের বিরোধী এবং গোমরাহীর রাস্তা। কেননা, কোনো স্থান, কখনো কাউকে হিদায়াত দিতে পারে না; হ্যাঁ, ব্যক্তি হিদায়াতের মাধ্যম হতে পারে, যতক্ষণ সে হকের উপর থাকবে।
আর এ কথাটির অর্থ যদি এটা হয় যে, “মাওলানা ইলিয়াস রহ. যেহেতু নিযামুদ্দীন থেকে এ মোবারক মেহনত শুরু করেছেন, কাজেই নিযামুদ্দীনের নেতৃত্বে যেই আসবে, আমরা তাঁর অনুসরণ করবো” তবে এ অর্থও নিঃসন্দেহে ভ্রষ্টতা।
কেননা, নবীজি তো দীনের দাওয়াত শুরু করেছিলেন মক্কা-মদীনায়, কিন্তু তাই বলে কি কুরআনে কিংবা হাদীসে মক্কা-মদীনাকে স্থান হিসাবে এ মর্মে অনুসরণের বৈধতা দেওয়া হয়েছে যে, মক্কা-মদীনা থেকে যে যাই বলুক, যদিও তা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী হয়, তবুও তার অনুসরণ করতে হবে..! কখনোই নয়।
কাজেই “নিযামুদ্দীনের ইতাআতে আছি” এ কথাটি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত কথা এবং উক্ত আয়াতের বিরোধী।
খ. দাওয়াত ও তাবলীগ একটি দীনী কাজ হওয়া সত্ত্বেও তারা এক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের নেতৃত্ব মানছেন না। তাদের ধারণা হলো, দাওয়াত ও তাবলীগের এ কাজ প্রচার-প্রসার লাভ করার পেছনে উলামায়ে কেরামের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই; বরং পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, “আওয়ামের বা সাধারণ জনসাধারণের।
এ ধারণার কারণে তারা দীনী বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞলোকদের অনুসরণ করাকে “নিযামুদ্দীনের ইতাআত” নাম দিয়ে এটাকে শরীআতের অনুসরণ মনে করছে এবং উলামায়ে কেরামের উপর “বদগুমানী” [খারাপ ধারণা] করছে।
তাদের এ কর্মপন্থা নিঃসন্দেহে গোমরাহী! কেননা, এ কাজ উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে এবং তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় উৎকর্ষতা অর্জন করেছে এবং এখনও তাদের সমর্থন ও সহযোগিতার কারণেই তা টিকে আছে।
কোনো দীনী কাজ উলামায়ে কেরামের সমর্থন ছাড়া কখনোই টিকে থাকতে বা প্রসার লাভ করতে সক্ষম হয় না। মাওলানা ইলিয়াস রহ. নিজে আলেম ছিলেন, তিনি মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ., মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রহ. এর সোহবাতে ও থানভী রহ. এর প্রত্যক্ষ পরামর্শে এবং মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ., মুফতী কেফায়াতুল্লাহ রহ., মুফতিয়ে আজম শফী উসমানী রহ., দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা ক্বারী তাইয়েব সাহেব, দিল্লীর আব্দুর রব মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুহাম্মাদ শফী’ সাহেব, সাহারানপুর মাযাহিরুল উলূম মাদরাসার নাযিম মাওলানা আব্দুল লতীফ সাহেব, দারুল উলূম দেওবন্দের উস্তাদ মাওলানা ই’যায আলী সাহেব ও শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া সাহেব রহ. সহ সমকালীন সকল বুযুর্গানে দীনের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ কাজ শুরু করেছিলেন এবং তাদেরই পরামর্শ মত এ কাজের নকশা নির্ধারণ করেছেন।
মাওলানা ইলিয়াস রহ. নিজেই বলেছেন, এ কাজের বরকত মূলত হযরত [থানভী রহ.]-এর দু‘আরই ফসল! [বিস্তারিত দেখুন:দীনী দাওয়াত; পৃষ্ঠা.৫৭, ৮০, ১১৪,১১৫, ১২৬-১২৭], [তাজদীদে তা’লীম ও তাবলীগ : পৃ. ১৭৩]
বাংলাদেশেও এ কাজ শুরু হয়েছিল হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.[সদর সাহেব হুজুর], বড় হুজুর মাওলানা আব্দুল আজীজ রহ. এর মাধ্যমে। যদ্দরুন বাংলাদেশে তাবলীগের প্রথম মারকায ছিলো বড় হুজুরের গ্রাম বর্তমান বাগেরহাটের উদয়পুরে।
কাজেই তাবলীগের এ কাজ প্রচার-প্রসার লাভ করার পেছনে উলামায়ে কেরামের পৃষ্ঠপোষকতা নেই- এ কথা নিঃসন্দেহে গোমরাহী!
দ্বিতীয়ত, অন্ধ ব্যক্তি কখনো কাউকে রাস্তা দেখাতে পারে না। অন্ধকার কখনো অন্ধকার দূর করতে সক্ষম হয় না। মাওলানা ইলিয়াস রহ. বলে গেছেন, “এই সিলসিলায় একটি উসূল এই, স্বাধীনভাবে ও নিজের মনমত না চলা। বরং নিজেকে ওই সমস্ত বুযুর্গদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচালনা করা, যাদের উপর দ্বীনী বিষয়ে আমাদের পূর্ববর্তী আকাবির হযরতগণ আস্থা রেখে গেছেন।’’
এরপর হযরত বলেছেন, ‘‘দ্বীনের কাজে আস্থা রাখার জন্য বহুত সতর্কতা ও হুশিয়ারীর সাথে [অনুসৃত ব্যক্তি] নির্বাচন করা জরুরি। অন্যথায় অনেক বড় ধরনের গোমরাহীর আশঙ্কা রয়েছে”। [মনযূর নোমানী রহ. কৃত “মালফুযাতে হযরত মাওলানা ইলিয়াস”:১৪৩ নং মালফুয]।
কাজেই দাওয়াত ও তাবলীগের এ দীনী কাজে সাধারণ জনগণের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার অর্থ হলো, অন্ধের অনুসরণ করা, যা নিঃসন্দেহে গোমরাহী।!
গ. আরেকটি ভ্রান্তি হলো, আমাদের এক শ্রেণির ভাইয়েরা এখনও মাওলানা সা‘আদ সাহেবকে অনুসরণীয় জ্ঞান করছেন! অথচ সা‘আদ সাহেব থেকে এমন অনেক বক্তব্য এবং কর্মপদ্ধতি পাওয়া গেছে, যা নিঃসন্দেহে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী এবং সে বিতর্কিত বিষয়গুলো থেকে তিনি এখনও যথাযথভাবে ফিরে আসেননি। যদ্দরুন তাকে এ মুহুর্তে অনুসরণ করা শরীআতের দৃষ্টিতে নিষেধ!
মাওলানা ইলিয়াস রহ. যে মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন, সে দারুল উলূম দেওবন্দসহ পুরা বিশ্বের উলামায়ে কেরাম সা‘আদ সাহেবের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সা‘আদ সাহেব যথাযথভাবে সে ভুল থেকে ফিরে আসেননি।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে, মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে, কাজেই জীবিত কোনো মানুষের ব্যাপারে এমন ধারণা না করা যে, তার থেকে কোনো ভুল প্রকাশ পাওয়া অসম্ভব।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন- “তোমাদের কেউ যেন কারো এমনভাবে অনুসরণ না করে যে, সে [অনুসৃত ব্যক্তি] ইমান আনলে, সেও [অনুসরণকারী ব্যক্তিও] ঈমান আনে। সে কুফরী করলে সেও কুফরী করে। যদি কারো অনুসরণ করতেই হয়ে, তবে মৃত ব্যক্তিদের অনুসরণ করো, কেননা, জীবিতগণ ফেতনার আশঙ্কামুক্ত নন। [তবরানী কাবীর;হা.নং ৮৭৬৪ মাজমাউয যাওয়ায়েদ; হা.নং ৮৫০ হাদীসটির সনদ হাসান]
হাকীমুল উম্মাত মুজাদ্দিদুল মিল্লাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. “আন নূর” পত্রিকায় একটি কলাম এ জন্য বরাদ্দ করেছিলেন যে, যে বিষয়গুলোতে কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী দলীল-প্রমাণের আলোকে হযরতের ভুল ধরে দিবেন, হযরত উক্ত কলামে সে ভুল স্বীকার করে সংশোধনী দেবেন।
মাওলানা ইলিয়াস রহ. একবার নবাগত এক দাড়িহীন যুবকের চোয়ালে হাত বুলিয়ে দাড়ি রেখে দেওয়ার অনুরোধ করলে যুবকটি যখন হযরতের সোহবাতে আসা বন্ধ করে দিলো, তখন ইলিয়াস রহ. নিজের ভুল শিকার করে বললেন, “আমি ঠান্ডা তাওয়ায় মাছ ঢেলে দিয়েছি।” অর্থাৎ তাওয়া গরম হওয়ার পর তাতে মাছ দিলে তা ভুনা করা সম্ভব, অন্যথায় ভুনা হবে না।
আমি আমার লিখিত সকল কিতাবের ভূমিকায় এ কথা লিখে দিয়েছি যে, এ কিতাবকে ত্রুটিমুক্ত করতে আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। তদুপরি কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী ভাই যদি তাতে কোনো ভুল দেখতে পান, তবে আমাদের জানালে পরবর্তী সংস্করণে আমরা তা শুধরে নেবো।
কাজেই মানুষ থেকে ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু শরীআতের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, সে ভুলকে চলতে দেওয়া যাবে না; বরং ধরিয়ে দিতে হবে। কেননা, হাদীসে এসেছে যে, এক মুসলমান অপর মুসলমানের জন্য ‘আয়না’ স্বরূপ।
আর ধরিয়ে দেওয়ার পর ভুলের শিকার ব্যক্তির দায়িত্ব হলো, (ক) ভুল মেনে নেওয়া (খ) ভুল গোপনে করে থাকলে গোপনে আর প্রকাশ্যে করে থাকলে প্রকাশ্যে নিজের ভুলের স্বীকৃতি দিয়ে সঠিক বিষয়টার ঘোষণা করে দেওয়া।
সাহাবী হযরত মু‘আজ ইবনে জাবাল রাযি. কে নবীজি ওসীয়্যত করে বলেন, “তুমি প্রকাশ্যে [গোনাহ] হলে প্রকাশ্যে [তাওবা করো], গোপনে [গোনাহ] হলে গোপনে [তাওবা করো]। [তবরানী কাবীর; হা.নং ৩৩১, মাজমাউয যাওয়ায়েদ; ১৬৭৫৩]
(গ) যে ভুল ধরিয়ে দিয়েছে, তার শোকর আদায় করা যে, ভাই তুমি আমার ভুল ধরিয়ে দিয়ে উপকার করেছো, অন্যথায় যারা যারা আমার এ ভুলের উপর আমল করতো, তাদের সকলের দায়ভার আমার উপর আসতো!
মাওলানা সা‘আদ সাহেবের প্রতি উলামায়ে কেরামের আস্থা না থাকার মৌলিক কারণগুলো হলো-
(১) দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
(২) তাবলীগের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে তাবলীগ ব্যতীত দ্বীনের অন্যান্য মেহনতকে (যেমন, মাদরাসাশিক্ষা, তাসাওউফ ইত্যাদি) হেয় এবং গুরুত্বহীন সাব্যস্ত করা।
(৩) পূর্ববর্তী মুরব্বীদের কাজের উসূল থেকে সরে যাওয়া। এ তিনটি বিষয়ে উলামায়ে কিরাম বিস্তারিতভাবে তাদের অভিযোগ ও আপত্তি পেশ করেছেন।
সর্বশেষ উপমহাদেশের উলামায়ে কেরামের মাথার তাজ, দারুল উলূম দেওবন্দ- সা‘আদ সাহেবের ব্যাপারে তাদের সর্বশেষ যে অবস্থান তুলে ধরেছেন, তা সবিশেষ লক্ষণীয়- “এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। সেটা হলো, এই (মূসা আ. এর) ঘটনার বিষয়ে তো মাওলানা (সা‘আদ সাহেবে)-র রুজুকে সন্তোষজনক বলা যায়, কিন্তু তাঁর চিন্তাগত বিচ্যুতির ব্যাপারে দারুল উলুমের পক্ষ থেকে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিলো, সে আশঙ্কা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কারণ, কয়েকবার রুজুর পরও কিছুদিন পর পর তার এমন কিছু নতুন বয়ান আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে, যেগুলোর মধ্যে আগের সেই মুজতাহিদসুলভ আন্দায, ভুল প্রমাণপদ্ধতি এবং দাওয়াতের ব্যাপারে নিজের বিশেষ চিন্তার সাথে শরীআতের বক্তব্যকে অন্যায়ভাবে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা বিদ্যমান।
এ কারণে শুধু দারুল উলুমের দায়িত্বশীলগণই নন, বরং অন্যান্য হক্কানী উলামায়ে কিরামদের মাঝেও মাওলানা (সা‘আদ) সাহেবের ‘সামগ্রিক চিন্তার’ ব্যাপারে প্রচণ্ড রকমের অনাস্থা রয়েছে।
মাওলানা (সা‘আদ) সাহেবের এই অনর্থক ইজতিহাদ দেখে মনে হয় যে, আল্লাহ না করুন, তিনি এমন এক নতুন দল তৈরির দিকে চলছেন, যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, বিশেষ করে নিজেদের আকাবিরদের থেকে ভিন্ন রকমের হবে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে আকাবির ও পূর্বসুরীদের পথ ও পদ্ধতির উপর অটল রাখুন। আমীন।” [দ্রষ্টব্য : দারুল উলূমের ওয়েবসাইট www.darululoom-deoband.com]
কাজেই মাওলানা সা‘আদ সাহেবের প্রসঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো-
১. এ মূলনীতি মনে রাখতে হবে যে, ইসলামে স্থান পূজা করা নিষেধ। কোনো স্থান কখনোই অনুসরণীয় হতে পারে না। আর কোনো ব্যক্তি যখন হক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে, তখন তার ইতাআত কিছুতেই বৈধ নয়।
[মুফতি মনসূরুল হকসহ উলামায়ে কেরাম ও তাবলীগের বয়ান মোবাইলে পড়তে ইনস্টল করুন ইসলামী যিন্দেগী অ্যাপ]
২. যেহেতু বিষয়টি দীনী বিষয়, এবং এমন একটি বিষয়, যুগ যুগ ধরে যার পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন উলামায়ে কেরাম, কাজেই আমাদের উচিত হবে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উলামায়ে কেরামের পরামর্শ অনুযায়ী নিজেদের পরিচালিত করা।
৩. তৃতীয়ত, মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। কাজেই মাওলানা সা‘আদ সাহেব ভুলের উর্ধ্বে নন এবং বর্তমানে যেহেতু পুরা দুনিয়ার উলামায়ে কেরাম তার ভুল ধরেছেন, কাজেই নিযামুদ্দীনের নামে তার অনুসরণ করা নিষেধ।
তার অনুসরণ বৈধ হওয়ার জন্য তিনটি বিষয় আবশ্যক-
ক. মাওলানা সা‘আদ সাহেব সবধরনের বিতর্কিত বক্তব্যের ব্যাপারে প্রকাশ্যে, স্পষ্ট শব্দে ভুল স্বীকার করে বড় বড় মজমার মধ্যে সঠিক ব্যাখ্যা দিবেন এবং এ রুজুর উপর তিনি অটল-অবিচল থাকবেন।
খ. তাবলীগের পূর্ববর্তী তিন হজরতজীর “নির্দেশিত পন্থায়” তাবলীগের কাজ করবেন এবং এ জন্য নিযামুদ্দীনের প্রবীণ মুরব্বীদের নিযামুদ্দীনে ফিরিয়ে এনে তাদের চোখের সামনে রেখে দেখে দেখে, তাদের পরামর্শমত চলবেন।
গ. দারুল উলূম দেওবন্দসহ বিশ্বের হক্কানী উলামায়ে কেরামের জামা‘আত তাঁকে “আস্থাশীল” হিসাবে ঘোষণা দিবেন।
যতদিন পর্যন্ত তিনটি বিষয় না পাওয়া যাবে, ততদিন তাকে অনুসরণ করার অর্থ হবে একটি “ভ্রান্ত দল” সৃষ্টিতে সহায়তা করা।
৪. মাওলানা সা‘আদ সাহেবের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের এ সুস্পষ্ট অবস্থানের পরও দাওয়াত ও তাবলীগের যে সকল সাথী নিযামুদ্দীনের ইতাআতের নামে মাওলানা সা‘আদ সাহেবের ইতাআতের উপর থাকবে, তাদের ব্যাপারে হক্কানী উলামায়ে কেরাম ও তাদের মতাদর্শী সাথীদের [চরম পন্থায় না গিয়ে হিকমাতের সাথে] ভালো করে বুঝাতে হবে যাতে তারা ভ্রাান্তির দিকে না যায় কিংবা উলামাদের প্রতি বিদ্বেষ তৈরির অবকাশ না পায়।
৫. দাওয়াত ও তাবলীগের এ কাজ উলামায়ে কেরামের কাজ, তারাই এ কাজের পৃষ্ঠপোষক এবং মূল দায়িত্বশীল। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতেও তাদেরকেই এ কাজের “রাহবারের” ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ কারণে সকল মাদরাসা কর্তৃপক্ষের নিকট আমার বিনীত নিবেদন হলো, জামি‘আর এক/একাধিক উস্তাদকে দরস্-তাদরীসের ব্যস্ততা কম দিয়ে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের জন্য ফারেগ করে দিবেন। যেন তিনি জামি“আর পক্ষ হতে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন।
সর্বোপরি, সবসময়ের জন্য লক্ষ রাখতে হবে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মাওলানা সা‘আদ সাহেবের ইতাআত নিষেধ হলেও দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ বন্ধ করা যাবে না। বরং হক্কানী উলামায়ে কিরামের তত্ত্বাবধানে তা সর্বাবস্থাতেই চালিয়ে যেতে হবে।
এ ব্যাপারে কোন অলসতা করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন, আমীন ॥
জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া-এর আসাতিযায়ে কেরামের পক্ষে- (মুফতী মনসূরুল হক) শাইখুল হাদীস ও প্রধান মুফতী, জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া, আলী অ্যান্ড নূর রিয়েল এস্টেট, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা।
-আরআর
হজরতের আরেকটি লেখা: দাওয়াত ও তাবলীগের নীতি ও আদর্শ (১)