মোকতার হোসেন মন্ডল
কোলকাতা
এই পৃথিবীতে একজন বাবার কাছে সব চেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় নিজ সন্তানের মরা দেহ সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আর সেটা যদি কোনও সন্ত্রাসীর হাতে খুন হয় তবে সেটা আরও কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়।
একদিকে পুত্রশোক অন্যদিকে শত্রুরকে দেখে নেবার মানসিকতা-এক জটিল রসায়ন এখানে কাজ করে। কিন্তু সেই কঠিন সময়ে যদি ‘ক্ষমার আদর্শ’ নিয়ে কেউ মৃত পুত্রের দাফন সম্পন্ন করেন তবে তিনি হলেন মহানপুরুষ।
আজ কেউ তাঁকে পিতৃতুল্য বলে প্রণাম করতে চাইছেন, কেউ তাঁকে আরও বহু মানুষকে বিপদের থেকে বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। এই হিংসার রামনবমী বাংলার বদনাম করেছে।
কিন্তু আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমদাদুল্লাহ রশিদি আজ ভারত নয়, গোটা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের আন্দোলনের মুখ। রামনবমীর মিছিল থেকে উদ্ভুত হিংসায় নিজের ১৬বছরের মৃত পুত্রের জানাজায় ইমামতি করার সময় বৃহস্পতিবার রাতে তিনি আসানসোলবাসীর কাছে যে আবেদন রেখেছিলেন তা একটা ইতিহাস।
বাংলার ইমাম যে এতো মহান তা ফের প্রমান হয়েছে। মৃত সন্তানের দেহ সামনে নিয়ে মৌলানা ইমদাদুল রশিদি বলেন,‘কোনও প্রতিহিংসা নয়। প্রতিশোধ নিতে যদি কারোর মৃত্যু ঘটাও, তাহলে আমি এই শহর ছেড়ে চলে যাব। আমি তোমাদের সঙ্গে ৩০বছর ধরে আছি, আমাকে যদি তোমরা ভালোবাসো তাহলে আর কাউকে যেন এভাবে মরতে না হয়।’
ইমামের এই ভাষণ গোটা দুনিয়ায় সারা ফেলেছে। তিনিই ভারতের সম্প্রীতির মুখ। তিনিই ইমাম অর্থাৎ নেতা বা প্রধান। দাঙ্গাবাজ রাজনৈতিক নেতারা হিংসা ছড়াচ্ছে আর একজন ইমাম বুকের ব্যাথা চেপে রেখে শান্তির বার্তা দিচ্ছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন ইমাম রশিদি একজন হিরো। সারা দেশ থেকে প্রতিক্রিয়া আসছে। ট্যুইটারে, ফেসবুকে। ইমদাদুল রশিদির বক্তব্যের সংবাদ এবং ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মধ্যে বিপন্ন মানুষ যেন আলো দেখতে পাচ্ছেন তাঁর মনোভাবের মধ্যে।
তিনিই ভারতকে পথ দেখালেন। কেউ তাঁকে সেলাম জানাচ্ছেন, কেউ শোকজ্ঞাপন করে বলছেন, আপনি আমাদের পিতার মতো, আপনার মধ্যেই আমরা ভরসা খুঁজে পাচ্ছি। ইমাম জানিয়েছেন, ইসলামের শিক্ষা এটা যে, হিংসার বদলে হিংসা নয়।
রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত বাংলা। কিন্তু ইমামের বক্তব্যের মধ্যে অনেক শিক্ষা আছে। রামনবমী পালনকারীরা রশিদীর কাছ থেকে শিখতে পারেন। দেশের স্বার্থেই ইমামের পথে যেতে হবে সকলকে।
১৬ বছরের কিশোরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করায় বৃহস্পতিবার রাতে জানাজায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। একটা উত্তেজনা ছিলই। সব পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে ইমাম সাত আট মিনিটের বক্তব্য রাখেন।
হটাৎ উত্তেজনা যেন থেমে গেলো। চোখে জল নিয়ে ঘরে ফিরে যান সকলে। মহান এই পুরুষ, ভারতের স্বধীনতা ও সম্প্রীতির পাহারাদার ইমাম রশিদী সেদিন হাজার হাজার মুসলিমদের সামনে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ্ আমার সন্তানের যতদিন আয়ু রেখেছিলেন, ততদিন সে বেঁচেছে।
তাকে যারা হত্যা করেছে, আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দেবেন। কিন্তু, আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আপনাদের কারও নেই। আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য একটি মানুষের ওপরেও আক্রমণ করা চলবে না।
বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাট করা চলবে না। ইসলাম আমাদের নিরীহ কোনও মানুষকে হত্যা করতে শেখায় না। আমাদের আসানসোলে আজ শান্তিশৃঙ্খলার প্রয়োজন। আমি আপনাদের সঙ্গে ৩০বছর ধরে আছি।
আপনারা যদি আমায় ভালোবাসেন তাহলে শান্তি বজায় রাখবেন। আর যদি আপনারা শান্তি বজায় রাখতে না পারেন, তাহলে আমি আসানসোল ছেড়ে বরাবরের জন্য চলে যাব।’
একদিকে যখন ইমাম শান্তির বার্তা দিচ্ছেন তখন এই আসানসোলেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণের জন্য সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আসানসোলেরই সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়।
বৃহস্পতিবার উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় গিয়ে একদল বিক্ষোভকারীর উদ্দেশ্যে তিনি বলে এসেছেন, ‘চামড়া গুটিয়ে নেব।’ একজন শিল্পী, মন্ত্রী যা পারেননি, একই এলাকার একজন ইমাম তা পেরেছেন। ইমামের কাছ থেকে বাবুল সুপ্রিয়র অনেক শেখার আছে।
আসলে ওই ইমামই ভারতের মুখ। আমাদের বাঁচার আশা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলো, বাংলার এতো বড়ো একজন মহান লোকের সাথে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বা রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী-কেউ দেখা করে পাশে থাকার আশ্বাস দেননি! ভারতের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও নীরব! কেন নীরব আমরা জানিনা।
তবে রাষ্ট্রীয় শক্তি মিলনের এই মুখকে সম্মান জানাতে ফুল পাঠক আর না পাঠক- গোটা দেশ কিন্তু ইমাম ইমদাদুল রশিদি স্যালুট জানাচ্ছে। তিনি ভারতের রত্ন।
একুশ শতকের আধুনিক ভারত যাঁদের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে,ইমাম সাহেব তাঁদেরই একজন। তিনিই ভারতের অভিভাবক। আগামী প্রজন্ম তাঁর মনোনীত আদর্শের পথেই চলবে।
-টিডিএনবাংলা