শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মুফতি হিদায়াতুল্লাহ আদনান অনূদিত ‘প্রাচ্যবাদ ও প্রাচ্যবিদ’: একটি তাত্ত্বিক পাঠপর্যালোচনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা লিয়াকত আলী

সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবতাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, মুহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন, মুজাদ্দিদীন, মুসলিহীন ও সালাফে সালেহীন আল্লাহর কিতাব ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ চর্চা ও অধ্যয়ন, অনুধাবন ও হৃদয়ঙ্গম এবং জীবনের ক্ষেত্র ও পর্যায়গুলোতে প্রতিফলনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। পাশাপাশি ইসলামের বৈরি চক্রের চক্রান্ত সনাক্ত করা এবং বিভ্রান্ত মুসলিমদের সংশয় নিরসনে নিয়োজিত ছিলেন।

ইসলামের নীতিমালা ও আদর্শ, ভাবধারা ও দর্শন এবং বিধান ও নিয়মকানুনের সারবত্তা নিয়ে শত্রুদের কুটিল ধুম্রজাল সৃষ্টি কখনোই বন্ধ থাকেনি। তেমনি তা প্রতিরোধে ইসলামী মনীষীদের প্রচেষ্টায়েও কখনো ছেদ পড়েনি। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ ও পর্যায়ে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর উপর আক্রমণের নতুন নতুন কৌশল ও চাতুর্য ব্যবহারের নজির রয়েছে। আর তা মোকাবেলায় যথাযথ পন্থা ও উপায় অবলম্বন করেছেন ইসলামের ধারকেরা।

আধুনিক যুগে ইসলামের ওপর সুদূর প্রসারি সূক্ষ্ম আঘাত হানার বিদ্যায়তনিক একটি পরিভাষা প্রাচ্যবিদ্যা। আপাত নির্দোষ শব্দটির মাঝে কী বিষ লুকিয়ে আছে সেসম্পর্কে সচেতন হওয়া বর্তমানের মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণীর অতি জরুরি ও অপরিহার্য দায়িত্ব। আরববিশ্বের খ্যাতনামা মনীষী ডক্টর মুস্তফা সিবায়ীর নাতিদীর্ঘ পুস্তিকা ‘আলইসতিশরাক ওয়াল মুসতাশরিকুন’ সেই লক্ষ্যের এক মূল্যবান প্রয়াস। পুস্তিকাখানার অনুবাদ বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য অনন্য উপহার হবে ইনশাআল্লাহ।

বর্তমান মুসলিম বিশে^র শাসক ও পরিচালকশ্রেণীর মস্তিষ্কে বিরাজ করছে ইসলামের অতীতকালের ব্যাপারে কুধারণা, ইসলামের বর্তমান সম্পর্কে অসন্তুষ্টি, ইসলামের ভবিষ্যত সম্পর্কে হতাশা এবং ইসলামের নবী ও ইসলামী বিধান সম্পর্কে সন্দেহ ও দ্বিধা।

মুসলিম সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য তাদের চিন্তা ইসলামী আদর্শ ও বিধান সংস্কারের। এ শ্রেণীটির শিক্ষা ও দীক্ষা হয়েছে পাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের সান্নিধ্যে। ইসলাম সম্পর্কে এই মুসলিম শাসক শ্রেণীর শিক্ষা ও জ্ঞানের উৎস ও নির্ভরতা পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিরাই। পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবিরা ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চর্চা, গবেষণা ও অনুসন্ধানে নিজেদের জীবনের মূল্যবান অংশ ব্যয় করেছেন এবং ইসলামের বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরেছেন।

আর আমাদের মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণীর একটি অংশের কাছে ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের বক্তব্য চূড়ান্ত বলে গণ্য। ইসলাম ধর্মের সত্যতায় বিশ্বাসী না হয়েও এবং ইসলামের গণ্ডির মধ্যে না এসেও পশ্চিমারা কেন এই ধর্ম ও এই ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে এত গবেষণা ও অনুসন্ধান চালায়?

দৃশ্যত এটি তাদের জ্ঞান সাধনায় ব্যাপকতা ও উদারতার একটি প্রমাণ। তাই তারা এটিকে একটি একাডেমিক পরিভাষা ও শিরোনাম দিয়েছেন। আর তা হলো ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবিদ্যা। ওরিয়েন্টালিজম পাশ্চাত্যের গবেষকদের জন্য প্রাচ্যকে জানার, আবিষ্কার করার ও এই বিষয়ক জ্ঞানচর্চা পদ্ধতি।

ইউরোপ আমেরিকায় এটি সমাজবিজ্ঞানে সর্বাধিক পঠিত, আলোচিত ও অনুসৃত একটি চিন্তাধারা। এমনকি এটি বেশ কিছু একাডেমিক ডিসিপ্লিনেরও জন্মকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে পোস্ট কলোনিয়াম স্টাডিজের কথা বলা যায়। এটি গবেষককে মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথ দেখায়, বিশেষ করে যখন কেউ তার পরিচিত পরিমণ্ডল ছেড়ে অন্য গোষ্ঠী বা সমাজকে পাঠ করতে চায়।

কিন্তু এই জ্ঞানচর্চা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে। পশ্চিমা গবেষকরা প্রাচ্যের ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের মিশনে যারা নিয়োজিত ছিলেন সেই পাদ্রীদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ ছিল পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবিদের প্রাচ্য নিয়ে গবেষণা চালানোর পেছনে।

তারা চেয়েছেন ইউরোপের মানুষদের ধর্ম বা খ্রিস্টবাদকে প্রাচ্যের জনগণের ধর্মসমূহ, বিশেষকরে ইসলামের তুলনায় শ্রেষ্ঠ করে তুলে ধরতে। এজন্য ইসলাম নিয়ে গবেষণার নামে ইসলামের বিধানে ঘাটতি ও ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য তাদের চেষ্টা থাকে। আর খ্রিস্টধর্মের মহিমা তুলে ধরার মত কোন যুক্তি বা তথ্য তাদের কাছে না থাকলেও অন্তত ইসলাম নিয়ে মুসলমানদের গর্ববোধ শিথিল করার চেষ্টা ছিল।

এই বুদ্ধিজীবিদের ফলে পশ্চিমা সমাজবাদীরা যখন প্রাচ্যের দেশগুলোতে কলোনী স্থাপনে তৎপরতা চালায়, তখন প্রাচ্যবিদ গবেষকরা আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রুচি, রীতি ও ঝোঁক-প্রবণতা সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদীদের অবহিত হওয়ার এবং সেই অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদী কৌশল নির্ধারণে সহায়তা করেছেন।

পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রণোদনাও কম ছিল না। কেননা, এ নতুন ধরনের অনুসন্ধানী রচনাবলীর ব্যাপক বাজার ও চাহিদা ছিল পুনর্জাগ্রত পশ্চিমা সমাজে। তাই প্রকাশনা ব্যবসায়ে একটি লাভজনক প্রকল্প ছিল প্রাচ্যবিষয়ক গ্রন্থাদি। তারা একদল মেধাবী, পরিশ্রমী ও প্রতিভাবান জ্ঞানগবেষককে নিয়োজিত ও উৎসাহিত করেছেন একাজে।

ফলে অসাধু উদ্দেশ্য থাকলেও ব্যবসায়িক স্বার্থে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনাও বেরিয়ে এসেছে তাদের মাধ্যমে। আর তাতে সামগ্রিকভাবে মানবতার কিছু কল্যাণও হয়েছে। কিন্তু এই প্রাচ্যবিদদের জ্ঞান ও অনুসন্ধানের সীমাবদ্ধতাও অবাস্তব নয়। তাই তাদের রচনাবলী থেকে কোন তথ্য বা উদ্ধৃতি নেয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

উদ্দেশ্যের অসাধুতা ও জানাশোনার সীমাবদ্ধতা, এই দ্বিবিধ দুর্বলতার কথা স্মরণ রেখে প্রাচ্যবিদদের গবেষণাকর্ম আমাদের অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। প্রাচ্যবিদ্যা ও প্রাচ্যবিদদের সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের বাংলাভাষায় পুস্তকাদির দারুন অভাব।

ডক্টর মুস্তফা সিবায়ীর পুস্তিকাখানা বাংলায় প্রকাশিত হলে পাঠকদের অনেকটা চাহিদা মিটবে ইনশাআল্লাহ। হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর গ্রন্থ ‘আসসিরাউ বাইনাল ফিকরাতিল ইসলামিয়্যাহ ওয়াল ফিকরাতিল গারবিয়্যাহ’ তাতেও একটি অধ্যায় আছে এসম্পর্কে। যা খুবই মূল্যবান ও তথ্যবহুল। তেমনি ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের ‘তুলনামূলক সাহিত্যে’র অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাঈদের লেখা ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইয়েরও বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

আমাদের তরুণ গবেষক আলেম মাওলানা মুসা আল হাফিজের ‘প্রাচ্যবিদদের দাঁতের দাগ’ অত্যন্ত মূল্যবান রচনা। এগুলো থেকে আমরা এবিষয়ে আলো পেতে পারি।

তবে প্রাচ্যবিদ পশ্চিমা বুদ্ধিজীবি ও গবেষকদের শুধু সমালোচনা ও দোষারোপ পর্যন্ত আমাদের কর্মকাণ্ড সীমিত রাখলে চলবে না। পাশ্চাত্যের গবেষক ও লেখকদের এসব রচনা ও গবেষণাকর্ম অনুসন্ধানী ও যাচাইমূলক অধ্যয়নের জন্য আমাদের মুসলিমদের প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

প্রাচ্যবিদদের বিপরীতে আমাদের গড়ে তুলতে হবে একদল পাশ্চাত্যবিদ। প্রাচ্যের সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম নিয়ে পশ্চিমাদের গবেষণা ও রচনাবলীর এ সীমাবদ্ধতা সনাক্ত করা, সঠিক তথ্য ও তত্ত্ব পরিবেশন করা এবং বিভ্রান্তির উৎস চিহ্নিত করার মতো যোগ্য একদল আলেম তৈরি করা প্রয়োজন।

ইসলামের অনেক মৌলিক ও আকর গ্রন্থে টীকা-টিপ্পনি সংযোজন করেছেন প্রাচ্যবিদ পশ্চিমারা। বিপরীতে প্রাচ্যবিদদের রচনাবলীতে সংশোধনী টীকা সংযোজন করে প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আবার প্রাচ্যবিদদের গ্রন্থ প্রণয়ন ও রচনারীতি আকর্ষণীয়। তাদের এই পদ্ধতি ও কৌশল পাঠকদের সহজে আকৃষ্ট করতে পারে। এটাও আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত।

তবে তাদের এ পদ্ধতি সর্বক্ষেত্রে যে বস্তুনিষ্ঠ ও যথার্থ উপসংহারে নিয়ে যায় না, তা-ও আমাদের ধরিয়ে দিতে হবে। আমার স্নেহভাজন হাফেজ মাওলানা মুফতি হিদায়াতুল্লাহ আদনান প্রাচ্যবিদ্যা ও প্রাচ্যবিদদের সম্পর্কে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের অবগতির জন্য ড. মুস্তফা সিবায়ীর পুস্তিকাখানা অনুবাদ করেছেন।

তাঁর এ প্রয়াস আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন এবং তাঁকে এ ধরণের খেদমত আরো করার তাওফীক দিন। আর এসব ক্ষুদ্র প্রয়াস আমাদের নাজাতের অসিলা হোক, এই দোয়া করি।

লেখক
সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া-ঢাকা
শিক্ষাসচিব, মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর, ঢাকা

প্রাচ্যবাদ ও প্রাচ্যবিদ
মূল : শায়েখ মুস্তফা আসসিবায়ি
অনুবাদ : মুফতি হিদায়াতুল্লাহ আদনান
প্রকাশক : মাকতাবাতুল মাআরিফ
প্রচ্ছদ : সুলাইমান সাদী
মুদ্রিত মূল্য : একশ চল্লিশ টাকা

এসএস

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ