আব্দুস সাত্তার আইনী
লেখক ও অনুবাদক
মুহাম্মদ বিন সালমান যতদিন ক্ষমতায় আছেন, সৌদি আরবকে বহির্বিশ্বের চাপের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাপও সামলাতে হবে। এ অবস্থায় দেশটির ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে মুসলমানদের পুণ্যভূমি মক্কা ও মদিনা সৌদি আরবে অবস্থিত বলে দেশটির ভবিষ্যতের সঙ্গে বিশ্বের সব মুসলমানের ভাগ্য জড়িয়ে আছে
গেল ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ ও তার আঞ্চলিক ভূমিকা’ শীর্ষক একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিদেল এবং নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টমাস ফ্রিডম্যান। রিদেল মনে করেন, রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে যে বিরোধ তার পরিণতিতে সৌদি আরবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি সতর্ক করেছেন যে, সৌদির বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থার কারণে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান গুপ্তহত্যার শিকার হতে পারেন। ফ্রিডম্যান বলেন, রাষ্ট্র দুটিকে ‘কেউ হারবে না, কেউ জিতবে না’ নীতিতে সমঝোতায় পৌঁছা উচিত এবং তিনি সৌদি আরবের জন্য আমেরিকার দিকনির্দেশনার আহ্বান জানান।
ব্রুস রিদেল জর্জ ডব্লিও বুশ সিনিয়র থেকে নিয়ে বারাক ওবামা পর্যন্ত মোট চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ছিলেন। তা ছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটে মিডল ইস্ট পলিসি সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো। সিআইএ’র হয়েও কাজ করেছেন।
রিদেল ইয়ামেন যুদ্ধের জন্য মুহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ী করেন এবং বলেন, সৌদি আরব মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আস-সিসির ক্ষেত্রে ও পাকিস্তানে যে বিনিয়োগ করেছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কারণ দেশ দুটির পার্লামেন্ট ইয়েমেনে সেনাবাহিনী পাঠানোর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। তিনি সতর্ক করেন, যুবরাজ যদি তার বাবা বাদশাহ সালমানের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের বাইরে চলে যান, তাহলে গুপ্তহত্যার শিকার হতে পারেন। কারণ সৌদি আরবে যুবরাজের শত্রুপক্ষ অনেক শক্তিশালী এবং দেশটির ইতিহাসে কোনো শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য রাজনৈতিক পথ খোলা ছিল না।
যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উদ্যোগ ও তার বৈদেশিক নীতির মধ্যে স্ববিরোধ রয়েছে। কারণ, দেশটি ইয়েমেন যুদ্ধে প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা, তাতে ইরানকে জয়ীরূপে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
বস্তুত সৌদি আরব বর্তমানে একটি কঠিন সময় পার করছে। বিশেষ করে যখন যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পরিকল্পনা ও পরামর্শ অনুযায়ী দেশটির অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক পন্থার ওপর জোর দিয়েছেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে সৌদি আরব জনপ্রিয় রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে বিনষ্ট করে দিয়েছে।
অথচ তা আরবদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক এবং আরব-ইসরাইল সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করছিল। মুহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের যুবরাজ ও নেতা হয়ে ওঠার পর দেশটির রাজনীতি ‘এ’ থেকে ‘জেড’-এ মোড় নিয়েছে। রোমাঞ্চকর রাজনৈতিক বাস্তবতা শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ অবস্থাকেই পরিবর্তন করেনি, বরং গোটা আরব ভূখ-কে প্রভাবিত করেছে।
মুহাম্মদ বিন সালমান যে স্বপ্ন লালন করেন, তা বিদ্যমান রাজনীতির পরিণতি নয়; বরং এটি একটি পুরানো স্বপ্ন। এই স্বপ্নই লালন করে আসছিলেন ভূমধ্যসাগরীয় কয়েকটি দেশের নেতা।
ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, বিশেষ করে সৌদি আরবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতিকর হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখার ওপর এই স্বপ্ন নির্ভরশীল ছিল। এই স্বপ্নবাজ নেতারা ফিলিস্তিন সমস্যা থেকে তাদের হাত গুটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, কারণ এই সমস্যাকে তারা নিজেদের জন্য অহেতুক বোঝা ভাবছিলেন।
একইভাবে তারা ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক প্রীতিসুলভ সম্পর্ক স্থাপনে এবং এই দলখদার রাষ্ট্রটিকে একটি নৈতিক ভিত্তি প্রদানে মনোযোগী হতে চেয়েছিলেন।
আমেরিকা ও ইসরাইলের অভাবিতপূর্ব সমর্থন ও সহযোগিতায় মুহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের যুবরাজ পদে আসীন ও দেশটির যাবতীয় রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা হস্তগত করার পর এই স্বপ্ন আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক মাইকেল উলফ কিছুদিন আগে ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি : ইনসাইড দ্য ট্রাম্প হোয়াইট হাউস’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। এ বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে মুহাম্মদ বিন সালমানকে ক্ষমতায় বসিয়ে সৌদি আরবে শ্বেতবিপ্লব ঘটানোর কারিগরি খেলা খেলেছেন।
বিন সালমানের সঙ্গে যে ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে এ ঘটনা তারই ইঙ্গিত বহন করে। আরব ভূভাগের রাজনৈতিক চিত্রকে পরিবর্তন করতে হলে নতুন রাজনৈতিক নীতি অবলম্বন করতে হবে। এটাই করতে চান বিন সালমান।
মুহাম্মদ বিন সালমান দেশে ও দেশের বাইরে তার বিরোধীদের ওপর সরাসরি আঘাত হানা, বল প্রয়োগ করে তাদের তৎপরতাকে নিস্তেজ করে দেওয়া এবং বিরুদ্ধবাদী শক্তিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছেন।
তার এই নীতি থেকে আলেম-ওলামা ও রাজবংশের ব্যক্তিরাও রেহাই পাননি। কাতার, লেবানন, হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক তার নতুন গৃহীত নীতির সাক্ষ্য বহন করে। এই নীতির আওতায়ই সৌদি আরব কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিল।
রাজনৈতিক অভিজ্ঞাত ও পূর্বসূরিদের প্রজ্ঞা, ইসরাইলের সঙ্গে আরব জনগণের বিরোধের ইতিহাস, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সম্পর্কের তাৎপর্য, আরব ভূখ-ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ঔপনিবেশ ও চৌর্যবৃত্তি ইত্যাকার ব্যাপারগুলো না বুঝেই মুহাম্মদ বিন সালমান তার পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছেন।
বিন সালমান যেসব উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তার একটি হলো তায়েফে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র ও অর্থনৈতিক জোন হিসেবে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের একটি শহর গড়ে তোলা। শহরটির নাম হবে নিওম। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য এমন স্বপ্নদ্রষ্টাদের খুঁজছেন যারা নতুন ও চমকপ্রদ কিছু করার চিন্তা করেন।
১৯৮৫ সালে জেদ্দায় জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মদ বিন সালমান সৌদি যুবরাজের পদ অলঙ্কৃত করার উপযুক্ত ছিলেন না; এ পদের অধিকারী ছিলেন বাদশাহ সালমানের ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ বিন নায়িফ। বাদশাহ সালমান রাজপরিবারের সব নিয়ম লঙ্ঘন করে ২০১৭ সালের ২১ জুন যুবরাজের পদ থেকে মুহাম্মদ বিন নায়িফকে অপসারিত করেন এবং নিজের ছেলে মুহাম্মদকে এই পদে আসীন করেন।
বাদশাহ তার ছেলেকে মুক্তহস্তে ক্ষমতা দান করেন। সীমাহীন ক্ষমতা পেয়ে বিন সালমান সৌদি ভিশন-২০৩০ নামে একটি রূপকল্প উপস্থিত করেন। রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করার উদ্যোগ নেন। গোপনে ইসরাইল সফর করেন।
বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য এই যুবরাজ দেশে ও দেশের বাইরে সমালোচিত হয়েছেন। তিনি নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত একটি নিলাম ইতালির রেনেসাঁ যুগের শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা একটি চিত্রকর্ম ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে ক্রয় করেছেন।
সালভাতর মুন্ডি নামের চিত্রকর্মটি যিশুখ্রিস্টের প্রতিকৃতি। তাছাড়া তিনি ৫০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে একটি ইয়ট ক্রয় করেছেন এবং ৩০ কোটি ডলার দিয়ে ফ্রান্সের ‘শ্যাটো লুইস ফোরটিন’ নামের বাড়িটি ক্রয় করেছেন।
ব্রুস রিদেল মনে করেন, সৌদি যুবরাজ নিজের ভাবমূর্তিতে নতুন আমেজের প্রলেপ দিতে নিজেকে ভিন্ন ধারার বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন, তিনি ভিন্ন চরিত্রের মানুষ, একজন সমাজ সংস্কারক এবং দুর্নীতিবিরোধী। তবে এসব বিলাসী কেনাকাটা তার ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে একটি ভয়াবহ আঘাত।
মুহাম্মদ বিন সালমান যতদিন ক্ষমতায় আছেন, সৌদি আরবকে বহির্বিশ্বের চাপের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাপও সামলাতে হবে। এ অবস্থায় দেশটির ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে মুসলমানদের পুণ্যভূমি মক্কা ও মদিনা সৌদি আরবে অবস্থিত বলে দেশটির ভবিষ্যতের সঙ্গে বিশ্বের সব মুসলমানের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। আলোকিত বাংলাদেশ।
সূত্র : আলজাজিরা ও নুন পোস্ট