সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন: স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে খুব শিগগির জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশের (ডেভলপিং কান্ট্রি) মর্যাদার ‘স্বীকৃতিপত্র’ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের এক বার্তা।
আশা করা হচ্ছে, মধ্য মার্চে জাতিসংঘের ইকোনমিক ও সোস্যাল কাউন্সিলের (ইউএনসিডিপি) চার দিনব্যাপী ত্রিবার্ষিক সভায় বাংলাদেশের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। এর পরই বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেওয়া হবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতিপত্র। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী উন্নয়ন ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত উত্তরণ পর্বটি আমাদের জাতীয় জীবনে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ধরে নেওয়া যায়, এ ঘটনার পর উন্নয়নশীল বিশ্বের রোল মডেল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এ কারণেই এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়টি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার। এজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার পর বাংলাদেশ চলতি বছর উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বীকৃতি লাভ বাংলাদেশের জন্য অনেক মর্যাদার। এর ফলে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় দেশ এবং নতুন অবয়বে সারাবিশ্বের সামনে অভ্যুদয় ঘটবে বাংলাদেশের।
যতটা জানা গেছে, উন্নয়নকে টেকসই করতে মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রতি তিন বছর পর পর সূচক তৈরি করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। তারই ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলোকে ‘স্বল্পোন্নত দেশ’, ‘উন্নয়নশীল দেশ’ ও ‘উন্নত দেশ’-এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার তথ্যমতে, একটি দেশ এলডিসি থেকে বের হতে যে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়, তা আগেই সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। এই তিন শর্ত হলো-মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় তিন বছরের গড় হিসেবে ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়া। বাংলাদেশে এখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ১০০-এর মধ্যে ৬৬ বা এর বেশি অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৭০-এ। অন্যদিকে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার নিচে থাকার শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান ২৫.০৩-এ।
উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে ১০ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘জাতীয় টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে গত ৩ জানুয়ারি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের শ্রেণি থেকে উত্তরণের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া কার্যক্রম পরিবীক্ষণের জন্য সরকার ১০ সদস্যের একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করেছে। সাধুবাদ জানাই সংশ্লিষ্টদের।
বর্তমানে ৪৭টি দেশ স্বল্পোন্নত তালিকায় রয়েছে। যেগুলোকে এলডিসি বলা হয়। স্বাধীনতার পরপরই এর সদস্য হয় বাংলাদেশ। এই গ্রুপের সদস্য থাকলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। অসুবিধাও আছে। তা হলো, ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এসব দেশের রেটিংয়ে সমস্যা হয়। ২০২১ সালে মধ্য আয়ের ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যেতে চায় বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার পরও আরও ছয় বছর এলডিসির সুযোগ-সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের এই অর্জনে করণীয় হচ্ছে, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জনের জন্য আমাদের প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখনও বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আমাদের অর্থনীতি এখনও পুরোপুরি শিল্পায়িত হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আমাদের পরিস্থিতিনির্ভর অর্থনীতি থেকে উৎপাদনশীলতা নির্ভর অর্থনীতির দিকে যেতে হবে।
কথা আরও আছে, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেলেও বৈশ্বিক সম্প্রদায় আগামী ১৫ বছর বাংলাদেশের এই উত্তরণকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। বাংলাদেশের এই উত্তরণ হবে একমুখী প্রক্রিয়া। কেননা, ধারণাগতভাবে উত্তরণের পর আবার এলডিসিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হলেও যেসব দেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটির বেশি, সেসব দেশের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। তাই বাংলাদেশের আর পিছু ফেরার সুযোগ নেই। বলা যায়, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়া জাতির জন্য এক বিরাট অর্জন হলেও একই সঙ্গে এটি হবে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।যে চ্যালেঞ্জে আমার মাতৃভূমি হারবে না বলেই বিশ্বাস করি।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক