আবদুল্লাহ তামিম: গত অগাষ্ট মাস থেকে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে জীবন বাঁচাতে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের দিক থেকে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল।
বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন, রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে ফিরে যাবার চিন্তা না করে সেজন্য তাদের মনে ভীতি ছড়ানোর মহড়া দিয়েছে সে দেশের বাহিনী। তাই কত নাটকই করছে এখন বাংলাদেশ সীমান্তে।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলে সীমান্তের জিরো লাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রথমে ফিরিয়ে নেবার বিষয়টি বলেছিল বাংলাদেশ।
যেহেতু যেসব রোহিঙ্গা এখনো বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকেনি সেজন্য তাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন নেই। সেজন্যই তাদের প্রথমে ফিরিয়ে নেবার বিষয়টি তুলে ধরেছিল বাংলাদেশ।
কিন্তু সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের সরে যাবার নির্দেশনা দিয়ে মিয়ানমার বুঝিয়ে দিল প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা কতটা অনাগ্রহী এমটাই মনে করছেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান।
মি: মুনিরুজ্জামান বলেন, "মিয়ানমারের এ ধরনের পদক্ষেপ অসহযোগিতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা এমনিতেই মিয়ানমারে ফিরে যাবার ব্যাপারে ভীত। তার উপর এ ধরনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি তাদের মনে আরো ভয় তৈরি করবে।" গত অগাস্ট মাসে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর বাংলাদেশ নানা কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়েছিল।
যার ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে একটি দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
গত নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের পর সে চুক্তি হয়। চীনের আগ্রহ এবং কূটনীতিক মধ্যস্থতায় সে সমঝোতা হয়েছিল বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
কারণ চীন বরাবরই চেয়েছিল রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিকীকরণ না করে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়-ভাবে সেটি সমাধান করুক।
১৯৯০'র দশকে বলকান যুদ্ধের সময় বসনিয়ার মুসলমানদের জাতিগত নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল সার্বিয়ার বাহিনী।
প্রায় তিন বছর পর আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো সার্বিয়ার বাহিনীর উপর সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল।
অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান মনে করেন, পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে, যখন মিয়ানমারের উপর সামরিক হস্তক্ষেপই হতে পারে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান।
অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান মনে করেন, " যদি সামান্য পরিমাণও সামরি ক হস্তক্ষেপ করা যায় তাহলে এর মাধ্যমে মিয়ানমার বাহিনীকে বাধ্য করা যাবে।"
রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের দিক থেকে সীমান্তে সামরিক উস্কানি ছিল বলে বাংলাদেশ অভিযোগ করেছে।
মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে বাংলাদেশ।
এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, সীমান্তে সংঘাত তৈরির জন্য উস্কানি দিয়েছিল মিয়ানমার কিন্তু বাংলাদেশ সংযম দেখিয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী কতটা কঠোর অবস্থান নিয়েছে সেটি তাদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়।
বিবিসি'র বার্মিজ ভাষা বিভাগ বলছে 'নো ম্যানস ল্যান্ড' বা 'জিরো লাইন' শব্দগুলো যাতে ব্যবহার না করা হয় সেজন্য মিয়ানমারের গণমাধ্যমকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিবিসির বার্মিজ ভাষা বিভাগের বো মও ব্যাখ্যা করছিলেন, সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধির পেছনে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার যুক্তি তুলে ধরছে মিয়ানমার। বো মও বলেন, " বার্মার কর্তৃপক্ষ মনে করে সীমান্তে আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি) সদস্যরা অবস্থান নিয়েছে। "
মিয়ানমারের প্রতিবেশী চীন চেয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি দ্বিপক্ষীয়-ভাবে সমাধান হোক। চীন বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার যাতে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে চীন দ্বৈত নীতি নিয়েছে বলে ধারণা করেন অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান।
অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান বলেন, " চীনের পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে এ ধরনের আচরণ নতুন কিছু নয়। মানবাধিকারের প্রশ্নটি চীনের কাছে গুরুত্ব পায় না।.."
বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, রোহিঙ্গা সংকটের ছয়মাস পার হলেও এ সংকট সমাধানের কোন লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘাড়েই চেপে গেল কিনা সেটি নিয়েও অনেকে আশংকা প্রকাশ করেন। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে শেষ পর্যন্ত লাখ লাখ রোহিঙ্গা কী তাহলে বাংলাদেশেই থেকে যেতে হবে? তাদের ভিটে মাটি কী তাহলে আর ফিরে পাবে না?
সূত্র:বিবিসি