মুফতি এনায়েতুল্লাহ
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চের সামনে ছিল ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রোবটিকস প্রতিযোগিতা চলছিলো সেখানে।
মঞ্চের ওপর কাঠের সোফায় বসে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলেন। সোফার পেছনে ছাত্রছাত্রী, পুলিশ ও অজ্ঞাতনামা তিনজন দাঁড়ানো। সবাই ছিলেন উৎসবের আমেজে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ঠিক ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়েছিল ফয়জুর। বিকেল ৫টা ২৬ মিনিটে হঠাৎই দৃশ্যপট বদলে যায়। ফয়জুরের অতর্কিত ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হলেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল। এখন সিএমএইচ’এ তার চিকিৎসা চলছে।
চিকিৎসকরা আশা করছেন, তিনি শিগগিরই সেরে উঠে হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারবেন। আমরা আল্লাহ তায়ালার দরবারে তার সুস্থতার জন্য দোয়া করি, তিনি যেন দ্রুত সেরে উঠতে পারেন।
৩ মার্চ উৎসবমুখর পরিবেশে সন্ত্রাসের যে ঘটনাটি ঘটলো, তা ভালোভাবে ভেবে দেখার মতো একটি বিষয়।
৪ মার্চ র্যাব-৯ এর অধিনায়ক আলী হায়দার আজাদ সংবাদ সম্মেলনে জানান, ফয়জুর জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হয়েই অধ্যাপক জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা চালান। তিনি নিজেই এসব কথা জানিয়েছেন।
এ ধরনের হামলায় সাধারণত কয়েকজনের সম্পৃক্ততা দেখা যায়, কিন্তু এ দফায় ঠিক কতজন হত্যা চেষ্টায় অংশ নিয়েছে, সে ব্যাপারে জানা যায়নি।
ফয়জুর দাবি করেছেন, তিনি একাই ছিলেন। সিএমএইচ’এ চিকিৎসাধীন থাকায় ফয়জুরকে খুব বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি বলেও জানান র্যাব-৯ এর অধিনায়ক আলী হায়দার আজাদ।
উল্লেখ্য, ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেধড়ক পেটান ফয়জুরকে। সংকটাপন্ন অবস্থায় প্রথমে তাকে জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালে এবং পরে সিলেটে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে হামলার শিকার হওয়ার পর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্ত্রী ইয়াসমিন হককে ফোন করে উদ্বিগ্ন হতে নিষেধ করেন।
ক্যাম্পাসে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামাল দেওয়ার কথাও স্ত্রীকে বলেন তিনি। মারাত্মক আহত অবস্থায়ও তিনি যে কর্তব্যজ্ঞানের পরিচয় দিলেন, বর্তমান সময়ে তা দুর্লভ। এটা তার মহত্বের পরিচয়।
ঘটনার পর সবার মনেই প্রশ্ন, কে এই ফয়জুর? কোন উদ্দেশে সে হামলা করেছে? পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, হরেক রকম মন্তব্যও করা হয়েছে।
প্রকাশিত খবরের সূত্রে জানা গেছে, ফয়জুর রহমানের বাবা আতিকুর রহমান সিলেটের একটি মহিলা মাদরাসার শিক্ষক। এলাকায় তিনি নিরীহ হিসেবেই পরিচিত।
ফয়জুর সুনামগঞ্জ, দিরাইয়ের একটি দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করেন। সেখানে ধল গ্রামে লজিং থেকে লেখাপড়া করতেন। ফয়জুরের বাবা ১৫ বছর আগে সপরিবারে সিলেট চলে গেলেও ফয়জুর মাঝে-মধ্যে গ্রামে আসতেন এবং গ্রামের বাজারে ফেরি করে লুঙ্গি-গামছা বিক্রি করতেন। এর বেশি কিছু তার সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ ফয়জুর সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নেবে এবং আমরা হামলার মোটিভ ও প্রকৃত তথ্য জানতে পারবো। হামলার ঘটনায় যে বা যারা প্রকৃত দোষী তাদের উপযুক্ত শাস্তি আমাদের কাম্য। কারণ এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত এখানে ফয়জুর সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত কিছু বিষয়ের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
ফয়জুর সম্পর্কে রিপোর্ট করতে গিয়ে কেউ কেউ শিরোনাম করেছেন- ফয়জুরের বাবা কওমি মাদরাসার শিক্ষক। আবার কেউ লিখেছেন চাচাদের কারণে সে সালাফি মতাদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়েছে।
অনেকে উল্লেখ করেছেন, সে আহলে হাদিসের অনুসারী। হামলার ঘটনার সঙ্গে তার বাবার পেশা, কিংবা তার মাজহাবের সম্পর্ক কী? দেশে কওমি মাদরাসা নিষিদ্ধ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, আর মাজহাব মানাও আইনবিরুদ্ধ কাজ নয়।
তাছাড়া ফয়জুরের বাবা তাকে ছুরি মারতে পাঠায়নি। আর মাজহাব অনুসরণ করলেই কাউকে ছুরি মারা বৈধ- এটা কি কোথাও বলা আছে?
মাজহাব পালন প্রসঙ্গে বলা যায়, কিছু মুস্তাহাব বিষয় নিয়ে ধর্মীয় মতপার্থক্য তো কোনো নতুন বিষয় নয়, এমন মতবৈচিত্র্য অতীতে ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। গবেষণার ক্ষেত্রে এই মতবৈচিত্র্য তো কাউকে হামলা করতে বলে না। ছুরি মারা শেখায় না। তাহলে অনভিপ্রেত আলোচনাগুলো কেন?
এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, স্বার্থসিদ্ধির অভিপ্রায় থেকে কেউ কেউ এই আলোচনাগুলো করে আসল বিষয় থেকে দৃষ্টি সরাতে চাইছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের কথা হলো- বিভ্রান্তি সৃষ্টির বদলে বরং তদন্তের সুষ্ঠু প্রক্রিয়াকে সবার সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অপরাধীর অপরাধমাত্রা বিবেচ্য, অন্যকিছু নয়।
এটা স্বীকৃত যে, প্রকৃত অপরাধ স্বেচ্ছায় হয়ে থাকে। ভীত হয়ে অপরের ইচ্ছা ও নির্দেশে অপকর্ম করা প্রকৃত অপরাধ নয়। ফয়জুর সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন যেসব কথা গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে সে নিজ ইচ্ছায় অপকর্মটি করেছে। তাহলে এখানে ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা কেন?
আমরা মনে করি- অপরাধী নয়, অপরাধকে সবাই ঘৃণা করলে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। তাছাড়া সন্ত্রাস একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটা আমরাও মোকাবিলা করছি। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকার নানাভাবে কাজ করছে, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতারাও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে উচ্চকিত।
আমরা দেখি যখন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন অপরাধীকে আটকের, শাস্তি প্রদানের আনুষ্ঠানিকতার খবরগুলোতে ধূম্রজাল ছড়ানো হয়। এর ফলে বিচারের বাণী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরবে কাঁদে। এটা নিয়ে রাজনীতি হয়। ফয়জুরের ক্ষেত্রেও এটা হলো। বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করা দরকার।
লেখক: সিনিয়র বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম- বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
আরও পড়ুন: জাফর ইকবালের উপর হামলা এবং তসলিমা নাসরিনের উস্কানি