হাওলাদার জহিরুল ইসলাম
সাব এডিটর
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশাল অংশ নারী। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নারীর অবস্থার উন্নয়নের বিকল্প নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে নারীর অবস্থানগত উন্নতি সাধনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সূচকে পরিবর্তন এসেছে।
সরকারি এক হিসেব মতে গত ২৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকরা গিয়েছেন সাড়ে তিন লাখের বেশি। যারা মূলত সেখানে কাজ করেন গৃহকর্মী হিসেবে।
বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে, ২০১০ অনুযায়ী দেশে মোট ৫.৪১ কোটি শ্রমিক বিভিন্ন পেশায় কর্মরত রয়েছেন; এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১.৬২ কোটি। সরকারিভাবে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। নারীরা যে গৃহস্থালি কর্মকাণ্ড করেন তার অর্থমূল্য আনুমানিক আড়াই লাখ কোটি টাকা। সে হিসাবে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের নারীরা এখন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বপ্নময় ভবিষ্যত বিনির্মাণের লক্ষ্যে বিদেশে চাকরি করতেও উৎসাহিত হচ্ছেন। সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, গত ১০ বছরে গড়ে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন পেশায় চাকরি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শ্রমিকও রয়েছেন। বর্তমানে ১৬০ দেশে প্রায় ১ কোটির কাছাকাছি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন।
সরকারিভাবে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, নারী-পুরুষ ভেদে বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কাজের সুযোগের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। নারী শ্রমিকেরা সাধারণত হাউজকিপার, গার্মেন্টসকর্মী, মিডওয়াইফ, বেবি সিটার, কেয়ারগিভার, ডে কেয়ার কর্মী, নার্স ও বিউটিশিয়ান পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন।
যে কোনো পেশায় বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীদের বিপদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ভাগ্যান্বেষণে দূরদেশে গিয়ে কাজ করতে চাইলে পাচার কিংবা যৌন নির্যাতনের মতো কিছু বিশেষ পরিস্থিতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি কেবলমাত্র নারীদেরই থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা অনেক সময় বিদেশে যাওয়ার আগে লাভক্ষতি বিচার না করেই অপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে তারা বিভিন্ন সময় নানা সমস্যা ও প্রতারণার মুখোমুখি হন।
এক কথায় বলা যায়, বিদেশগামী নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি অরক্ষিত ও অসহায় অবস্থায় থাকেন। অপরিকল্পিত উপায়ে ও নিয়ম না মেনে বিদেশে গেলে প্রতিটি ধাপেই ঝুঁকি রয়ে যায়। সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে নারীরা সঠিক পেশা নির্ধারণ এবং নিরাপদ বাসস্থান বা অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেন না। তারা প্রায়ই পাচারকারীর হাতে পড়েন।
অনেক সময় যৌনকর্মীর মতো অনিচ্ছুক ও মাদক কেনাবেচার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কাজ করতে বাধ্য হন। অনেকে দালালদের দ্বারা আর্থিক প্রতারণার শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে অত্যধিক শ্রমের বিনিময়েও অনেকের ভাগ্যে খাবার, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা জোটে না।
আরব নিউজের সূত্রমতে, সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া সরকার তাদের দেশের নারীদের গৃহকর্মের ভিসায় বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ স্থগিত করেছেন। তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন, গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীরা বেশি সংখ্যায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন যা মৌলিক মানবাধিকার পরিপন্থী। সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
বিদেশে অন্যান্য পেশার তুলনায় গৃহকর্মী নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) একটি রিপোর্টে আরব আমিরাতে নারী শ্রমিকের উপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একটি ঘটনায় নিয়োগদাতা নারী প্রতিবাদী নারী শ্রমিককে বলেন, ‘তোমাকে আমরা কিনেছি, অভিযোগ করবে না’।
দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা বেশ কিছু নারী শ্রমিকের উপর ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (আইওএম) একটি স্টাডি রিপোর্ট করেছেন। তাতে দেখা যায়, প্রতি ৩ জনে ২ জন অভিবাসী নারী শ্রমিক তাদের নিয়োগকর্তা দ্বারা কোনো না কোনো প্রকার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি।
মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ না থাকলেও ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা শিকার হন আসমা নামের এক নারী শ্রমিক। তিনি বিবিসির এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘সাত দিনের মধ্যে পর পর দুই রাত দুই বাসায় তারা আমাকে রেপ করার চেষ্টা করে। আমি বলি আমারে কাজ দেন নাইলে দেশে পাঠায়ে দেন।’ আসমাকে সেখানে দেহব্যবসার কাজে লাগাতে চেয়েছিল তার প্রেরণকারী।
এক সপ্তাহ পর ওমান থেকে দেশে ফিরে আসেন আসমা। কিন্তু দেহব্যবসার করার অভিযোগে তার স্বামী আর তার সাথে থাকতে চাচ্ছেন না। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে যে হাজার হাজার নারী শ্রমিক পাড়ি জমায় তার একটা বড় অংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
এছাড়া নারীদের বিদেশের কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার যে ক’টি কারণ রয়েছে তার মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য হল, তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব ও জীবনদক্ষতার উপর প্রশিক্ষণ না থাকা।
অন্যদিকে, এজেন্সি, লেবার উইংস ও দূতাবাসসমূহের চরম গাফিলতির কারণেও অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন নারীদের মতে, জরুরি সময়ে এজেন্সি ও দূতাবাসসমূহ প্রয়োজনীয় সেবা দিতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
শুধুমাত্র বিদেশে নয়, দেশে ফিরে আসার পরও একজন নারী শ্রমিককে প্রায়ই সমাজে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে যারা প্রতারিত হয়ে ফিরে আসেন তাদের নিয়ে সমাজের কেউ কেউ উপহাস বা হাস্যরসের জন্ম দেয়। আবার কারও অর্থিক উন্নতি দেখলে বলা হয়, অবৈধ উপায়ে টাকা আয় করেছে।
যারা অসুস্থ হয়ে ফেরত আসেন তাদের সম্পর্কেও সমাজে নেতিবাচক ধারণা থাকে। প্রতিবেশিরা তাদের সঙ্গে সামাজিকভাবে মেলামেশা করতে চান না। উল্লিখিত অপবাদ একজন নারী শ্রমিকের জন্য পীড়াদায়ক ও মানসিক নির্যাতন। ফলে এ ধরনের ঘটনা তার স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়। তিনি সমাজে হেয় হন। বিপদে পড়লে সহায়তার জন্য তাদের পাশে কেউ এগিয়ে আসতে চায় না। এমনও দেখা যায় যে, সামাজিক কাজে তাদের কেউই ডাকে না।
আমাদের যে বিষয়টি সর্বাগ্রে খেয়াল করতে হবে তা হল, সঠিক নিয়মে নারীদের বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বিশেষ করে যে মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছেন তারা, সেটি বিশ্বস্ত ও সরকারি তালিকাভুক্ত কিনা দেখা দরকার। অপরিচিত মাধ্যমে বিদেশে গেলে পাচারসহ নানাভাবে প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
বিদেশে নারী শ্রমিক প্রেরণ ও তাদেরে সার্বিক বিষয়ে সচেতন বর্ষীয়ান আলেম ড. আল্লামা মুশতাক আহমদের কাছে জানতে চাইলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, দেশের জতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীদের অংশ গ্রহণ অবশ্যই ইতিবাচক। একটি জাতির উন্নয়নের জন্য কেবল পুরুষদেরই অবদান থাকে না। আর সরকারের পুরুষদের পাশাপাশি বিদেশে নারী শ্রমিক রপ্তানি একটি ভালো উদ্যোগ।
তবে এক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি পর্যায়ে নারী শ্রমিক বা চাকরিজীবিদের জন্য নিরাপদ ও অশ্লীলতামুক্ত শরিয়তসম্মত জাতিয় ড্রেস কোড নির্ধাণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের জন্য মর্যাদা স্বীকৃৃত থাকতে হবে। পর্দার বিধানের আওতায় থেকে দেশের নারীরা দেশের জন্য পরিবারের জন্য ভূমিকা রাখতে পারেন।
বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারকে সুনির্দিষ্ট শর্ত ও সুরক্ষা আইন করতে হবে। ইসলাম নির্দেশিত পর্দা ও শালীনতা বজায় রাখলে কর্ম ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন বা যৌন হয়রারনি বন্ধ হবে বলে আমরা বিশ্বস করি। বিদেশে শ্রমিক রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারকে আরো জোরালো ভূমিকা রাখা চাই। জাতীয় সুরক্ষা শ্রমিক আইন প্রণয়ন করাও জরুরি।
চলমান পরিস্থিতিতে বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানো শরিয়ত সমর্থন করে কিনা জানতে চাইলে শায়খ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বলেন, ইসলামে মাহরাম ছাড়া নারীদের দূবর্তী সফর করা বৈধ নয়। নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে স্পষ্টতই শরিয়ত নির্ধারিত পর্দার বিধান লংঘন। তাছাড়া নারীরা বিদেশে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন। আর এ নির্যাতনের অধিকাংশই যৌন ও শারীরিক। যা আমরা বিভিন্ন সময় জাতীয় দৈনিকগুলোতে দেখতে পাই। আর এগুলো প্রচলিত মানবাধিকারেরও স্পষ্ট লংঘন।
ইসলাম কখনই নারী অধিকারের বিপক্ষে নয়। বরং ইসলামের শুরু যুগে মুসলিম নারীদের ব্যবসা বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ ইতিহাস স্বীকৃত। বুখারি শরিফের অনেক হাদিসেও এর আলোচনা এসেছে। আমরা মনে করি আমাদের দেশের নারীরাও জাতীয় অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখবে।
তবে তা হতে হবে নারীদের নিরাপত্তার সাথে। এ ব্যাপারে আমাদের সরকারকেও ভূমিকা রাখতে হবে। নারীদের জন্য দেশের মধ্যেই নিরাপদ ও শরিয়ত সম্মত পরিবেশে অধিকহারে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হব। অামাদের দেশের নারীদের শ্রম ও মেধা দেশের মধ্যেই কাজে লাগাতে পারলেই আমরা সর্বাধিক লাভবান হবে।
তিনি বলেন, আমরা দেখি দেশে একজন নারী ঘরে বসে কুটির শিল্পে বা অন্য লাভজনক কাজ করে যতোট স্ববলম্বী হন বিদেশে গিয়েও অন্য নারী ততোটা ভালো থাকতে পারেন না। সুতরাং বিদেশে পাঠিয়ে তাদের শুধুই কষ্ট আর হয়রানি করার কোন মানে হয় না।