আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম
গত ১৬ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় মারা গেছেন দেশের শীর্ষ আলেম ও শিক্ষাবিদ আল্লামা আবদুল বাছিত বরকতপুরী রহ.। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি ও কাসিমুল উলুম সিলেট দরগাহ মাদরাসার দীর্ঘদিনের মুহাদ্দিস এ আলেমের মৃত্যুতে সিলেটসহ সারা দেশের উলামায়ে কেরামের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তারা মনে করছেন, এমন বিরলপ্রজ প্রতিভার বিদায়ে দেশ ও উম্মাহের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
আল্লামা বরকতপুরীর ইন্তেকালে দেশের প্রায় সব শীর্ষ আলেমই শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। এবার আওয়ার ইসলামে তাদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন দেশের প্রথম সারি দুই আলেম। তারা হলেন, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের যুগ্ম মহাসচিব ও জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক এবং কাসিমুল উলুম সিলেট দরগাহ মাদরাসার শিক্ষা সচিব এবং আল্লামা বরকতপুরী ছাত্র ও পরবর্তী সহকর্মী মাওলানা আতাউল হক।
তার স্নেহমাখা হাসি আমাকে মুগ্ধ করতো
মাওলানা মাহফুজুল হক
সারা দেশের উলামায়ে কেরামের মধ্যে আল্লামা আবদুল বাছিত বরকতপুরী রহ. এর বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। সিলেট অঞ্চলের আলেম সমাজের উপর তার বিশেষ মূল্যায়ন ও প্রভাব ছিলো। ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো। আমাকে তিনি স্নেহ করতেন। দেখা হলেই হাসি দিয়ে কথা বলতেন। তার হাসি দেখলেই যে কারো মন ভালো হয়ে যেতো।
হজরতের সঙ্গে আমার পরিচয় বেফাকের এক বৈঠকে। বেশ কয়েক বছর আগে আজাদ দ্বীনী এদারায়ে তালিম ও বেফাককে একীভূত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন অন্যান্য মুরব্বিদের সঙ্গে আমি সিলেট যাই। সেখানেই তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম পরিচয়েই আমি তার জ্ঞানের গভীরতা ও মনের উদারতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করি।
আমার পিতা হজরত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. কে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। আব্বার পরিচয়ের জন্য তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন বলে মনে হয়েছে।
আল্লামা বরকতপুরী রহ. সিলেটের আঞ্চলিক মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড আজাদ দ্বীনী এদারায়ে তালিম বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের মহাসচিব ছিলেন। আঞ্চলিক বোর্ড হলেও এর কার্যক্রম খুব পরিপাটি ও গোছালো। সু-শৃঙ্খল। আজাদ দ্বীনী এদারাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন আল্লামা বরকতপুরী।
আমার জানা মতে, দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি আজাদ দ্বীনী এদারাকে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা এবং বোর্ডের পরিধি বিস্তৃত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। বিশেষত সিলেবাসের আধুনিকায়ন ও সিলেবাসভূক্ত পাঠ্য পুস্তক রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। পুরো অঞ্চলে ইসলামি শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নে তার অনন্য অবদান রয়েছে বলেই আমি জানি।
এ ছাড়াও জাতীয় ও ধর্মীয় ইস্যুতেও তিনি সামনে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন হেফাজতে ইসলাম সিলেট মহানগরের সভাপতি ছিলেন।
আল্লাহ তায়ালা তার দীনী খেদমতসমূহ কবুল করেন এবং তাকে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দান করেন।
সুযোগ পেলেই আমাদের সামনে এগিয়ে দিতেন
মাওলানা আতাউল হক
আমি যখন সিলেট দরগাহ মাদরাসায় কাফিয়া জামাতে পড়ি আল্লামা আবদুল বাছিত বরকতপুরী সিলেট গহরপুর মাদরাসা থেকে দরগাহ মাদরাসায় যোগদান করেন। আমি হুজুরের কাছে একাধিক কিতাব পড়েছি। তার মধ্যে সহি মুসলিম অন্যতম।
আল্লামা বরকতপুরী দরগাহ মাদরাসায় প্রায় দুই যুগ ধরে সহি মুসলিমের পাঠ দিয়েছেন। তার পাঠদানের ভিন্ন ধরন ছিলো, যা ছাত্ররা খুব পছন্দও করতো। তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। যারা তার দরসে বসেছে তারা তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়েছে।
আল্লামা বরকতপুরী রহ. ছিলেন খুব উদার মনের মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুব স্বচ্ছল ছিলেন না কিন্তু খুব উদার জীবনযাপন করতেন। তার আপ্যায়ন, মেহমানদারি ও পরিবার প্রতিপালন দেখলে কেউ বলতে পারবে না তার জীবনে আর্থিক অস্বচ্ছলতা ছিলো।
আল্লামা আবদুল বাছিত বরকতপুরী রহ. অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। দরগাহ মাদরাসার প্রিন্সিপালও বলেছেন, মাদরাসার ব্যাপারে পরামর্শ হলে উনি খুব ভালো পরামর্শ দিতেন। জটিল সমস্যার সহজ সমাধান করার বিশেষ যোগ্যতা ছিলো তার।
তিনি ছিলেন সিলেট অঞ্চলের আলেমদের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী। গ্রহণযোগ্যতায়ও ছিলেন শীর্ষে। তার আত্মমর্যাদা ছিলো অত্যন্ত প্রখর।
তিনি এক যুগ সিলেট আজাদ দ্বীনী এদারায়ে তালিম বোর্ডের মহাসচিব ছিলেন। তিনি তখন ঢাকাসহ সারা দেশে এ বোর্ডের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
পারিবারিকভাবেও তিনি আামাদের আত্মীয়।
আমি তার হুজুরের সরাসরি ছাত্র। কিন্তু সহকর্মী হওয়ার পর অত্যন্ত স্নেহ, মমতা ও উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করেন। আমি যখন দরগাহ মাদরাসার শিক্ষক হই তিনি আমাকে বলেন, তুমি আমাদের ছাত্র। এখানে তোমার উন্নতি হওয়া দরকার। এটা আমরা চিন্তা করবো। তুমি তোমার কাজ করে যাও। মন দিয়ে পড়াও। সত্যিই তিনি আমাদের উন্নতির জন্য চেষ্টা করেছেন। সুযোগ পেলে আমাদের এগিয়ে দিয়েছেন সামনে।
আমি যে এখন মাদরাসার শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালন করছি সেটাও হুজুরের নির্দেশে। আমি দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাচ্ছিলাম না। তিনিই আমাকে দায়িত্ব নিতে বলেন। কাজ শেখার জন্য ও বোঝার জন্য।
প্রায় আমাদের বাংলা লিখতে বলতেন। আমাদের দিয়ে কিছু লেখা তৈরি করিয়ে তিনি একটা পত্রিকা বের করেন।
সিলেট এদারায়ে আমার কিছু পাঠ্য বই আছে। যা হুজুরের উদ্যোগে এবং তার লেখা ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়েছে।
আমি যখন করাচিতে ছিলাম তখন হুজুরের জন্য ‘আল হাসান’ নামক পত্রিকার কপি পাঠিয়ে ছিলাম। এ সামান্য উপহারের জন্য আমাকে শুকরিয়া জানিয়ে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি আমাকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দান করেন। পরবর্তী জীবনে হুজুরের উপদেশ আমার অনেক উপকারে এসেছে।