রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই: তারেক রহমান জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেন শায়খ মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন আগামীকাল মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে চরমোনাই পীরের শোক প্রকাশ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী রহ.-এর বর্ণাঢ্য জীবন কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে: নাছির বড় ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা আইফোনে ‘টাইপ টু সিরি’ ফিচার যেভাবে ব্যবহার করবেন  স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা আল্লাহকে পেতে হলে রাসূলের অনুসরণ অপরিহার্য: কবি রুহুল আমিন খান

মাদরাসাপড়ুয়াদের ক্যারিয়ার ভাবনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাকিল আদনান
অতিথি লেখক

জুমাবারের পড়ন্ত বিকেল। রাজধানীর একটি মাদরাসার গেটে অপেক্ষা করছেন বেশ ক’জন অভিভাবক। এক সপ্তাহ পর তারা প্রিয় সন্তানকে দেখতে এসেছেন। অন্যরকম দৃশ্যটি দেখা গেলো একটু পরই। সরু সিঁড়ি বেয়ে হুড়মুড় করে নেমে আসছে একদল শিশু। যেনো সাদা পোশাকের ফেরেশতা।

শিশুদের ছোট্ট মিছিলটি গেটের কাছে এসেই হঠাৎ থেমে গেলো। একটু দেখে নিয়ে এরপর ওরা ঝাঁপিয়ে পড়লো যার যার মা-বাবার কোলে। হাসি-কান্না আর হৈ-হুল্লোড়ে অভাবনীয় এক পরিবেশ তৈরি হলো। পাশে দাঁড়িয়ে আমিও যে কখন অভিভাবক আর শিশুদের মধ্যে হারিয়ে গেছি টের পাই নি।

নিজেকে সামলে আরো একটু পর এগিয়ে গেলাম লতিফা আমিনের দিকে। আপাদমস্তক বোরখাবৃত এই নারী তখনও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন, চোখে টলমল জল। ম্যাডাম- আপনি কাঁদছেন?...

একটু থতমত খেলেন। তারপর মুখে হাসি টেনে বললেন- কাঁদবো না! ছয় বছরে একদিনও আমার বাবুকে ছাড়া থাকি নি আমি। এই প্রথম টানা এক সপ্তাহ ওকে ছাড়া থাকতে হলো। তার কথার ফাঁকে আমি আমার প্রশ্নগুলো করার জন্য তৈরি হলাম। ছেলেকে ছেড়ে লতিফা আমিনও ততক্ষণে ওঠে দাঁড়িয়েছেন।

স্বামী এডভোকেট রুহুল আমিনের সাথে আগেই কথা বলে জেনেছি- এই নারী সাধারণ গৃহিণী নন। মাস্টার্স করা বিদুষী। একটা সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষিকাও। তার কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন- ছেলেকে মাদরাসায় দিলেন যে?!...

‘ও কোলে আসার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম, আল্লাহ আমাকে ছেলে সন্তান দান করলে ওকে আমি মাদরাসায় পড়াবো। সে কুরআন পড়বে, মসজিদে সবার সামনে দাঁড়িয়ে ইসলামের কথা শোনাবে। আমার নানা আলেম ছিলেন। তাকে দেখে আমার খুব গর্ব হতো। তাই ছেলেকেও আমি নানার মতো করেই গড়ে তুলতে চাই।’

আমাদের সমাজের বিশেষ কিছু মানুষ- শুনেছি আপনার পরিবারের লোকেরাও মাদরাসাশিক্ষাকে ভালো চোখে দেখেন না। আপনি বাধা পান নি?...

লতিফা আমিনের কণ্ঠে বেশ ক্ষোভ- ‘মানুষ কী বললো, সমাজ কী ভাবে সেটাকেই বড় করে দেখলে আমার চলবে কেনো? নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সাহস-সামর্থ্য-অবস্থান সবই আছে আমার। আমার স্বামীও প্রথমে আপত্তি তুলেছিলেন, পরে খুশি মনেই রাজি হয়েছেন। সুতরাং আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই।’

কিন্তু পরিবার বা সমাজের প্রভাব তো অস্বীকারও করা যায় না। ছেলে যদি বড় হয়ে নিজের অবস্থানকে ছোট মনে করে?...

লতিফা আমিনের স্বর এবার বদলে যায়। ঝাঁঝ মেশানো কণ্ঠেই বললেন- ‘সন্তান আমার। ওকে আমি সেভাবেই গড়ে তুলবো। আমি না ভেবে সিদ্ধান্ত নিই নি। একজন শিক্ষিকা হিসেবে সমাজের আরো দশটা শিশুকে নিয়ে আমার নিত্যদিনের পথচলা। সুতরাং ওর ভালো-মন্দটা আমি ভালোই বুঝি।...

আপনি ওর জীবিকার কথা বলতে পারেন। সেক্ষেত্রেও একই কথা। নিজেদের ভালোলাগা থেকে আমরা ওকে মাদরাসায় দিয়েছি। ওর পরবর্তী জীবনের সব ব্যবস্থাও আমরাই করে যাবো ইনশাআল্লাহ। বড় হয়ে ইসলামের জন্য সে যা-ই করুক, সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে করবে। অন্যদের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ছোট ভাবার মতো অবস্থায় আমরা ওকে রেখে যাবো না।’...

প্রশ্ন আরো ছিলো, করা হলো না। যে আবেগ, বোধ আর বিশ্বাস থেকে লতিফা আমিন কথাগুলো উচ্চারণ করে গেলেন- এরপর আর কথা চলে না। শুকরিয়া জানিয়ে দ্রুত পাশে সরে এলাম। এডভোকেট সাহেবের সাথে শেষবার চোখাচুখি হলো। তার সাথে কথা বলে আগেই অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম। যে ঝাঁঝের আভাস তিনি দিয়েছিলেন তারচে বেশিই প্রকাশ পেতে দেখে তিনি মুচকি হাসলেন শুধু।

এভাবে, এভাবেই সব শ্রেণি-ঘরানার ছেলে-মেয়েরা মাদরাসায় ভর্তি হচ্ছে প্রতিবছর। বাড়ছে ছাত্র-ছাত্রীসংখ্যা। গড়ে উঠছে নতুন নতুন মাদরাসা। সব প্রশ্ন, সব শংকা আর সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ক্রমেই গতিময় হচ্ছে কওমি মাদরাসার শিক্ষা এক্সপ্রেস।

ক্যারিয়ারক্যাচাল

জীবনের পথে অগ্রগতি, জীবিকা, পেশা, বৃত্তি- ক্যারিয়ারের এমন বিভিন্ন অর্থ নির্দেশ করছে বাংলা একাডেমির ইংলিশ-বাংলা অভিধান। তবে এই সময়ে এই সমাজের তরুণ প্রজন্মের সামনে বসে এভাবে ক্যারিয়ারের শাব্দিক বিশ্লেষণে যাওয়ার প্রচেষ্টা হাস্যকার হবে সন্দেহ নেই।

৭০০ কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে প্রতিটি শিশু জন্মই নিচ্ছে একজন প্রতিযোগী হয়ে। মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই, ভাত-পোশাকের একটু নিশ্চয়তার জন্য তাকে লড়াই শুরু করতে হয় বোধ-বুদ্ধি বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই। পাশ থেকে পৃষ্ঠপোষক হয়ে, সহযোগী হয়ে, শুভাকাঙ্ক্ষি হয়ে এগিয়ে আসেন পরিবার-পরিজন। কাছের মানুষজন।

প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যাবার পর পুঁজিবাদ তাকে শিখিয়ে দেয় অন্যকে, অন্যদেরকে, চারপাশের সবাইকে ছাড়িয়ে যাবার মন্ত্র। জীবন মানেই যেনো প্রতিযোগিতা। জীবন মানেই যেনো লড়াই। সুতরাং এই প্রজন্মের সামনে ক্যারিয়ারের আঁতুড়কথন বোকামি নয়তো কী? ক্যারিয়ার তাই ক্যারিয়ারই। কর্মজীবন, জীবিকার লড়াই এসব বিশ্লেষণের তাই দরকার নেই।

আমরা বিভোর হচ্ছি, পরিবেশ আমাদের বাধ্য করছে জীবনের পথে এগিয়ে যাবার হরদম লড়াইয়ে লেগে থাকতে। তাই জীবনের জন্য গতি নয়, গতির জন্য আমরা ব্যয় করছি জীবন। কারণ ‘সফল’ যে আমাকে হতেই হবে!

ক্যারিয়ারের পেছনফেরা

মাদরাসাশিক্ষার সূচনা মূলত ইসলামের শুরু যুগ থেকেই। তবে প্রথম দিকে তা ছিলো মসজিদকেন্দ্রিক। হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে মাদরাসাশিক্ষার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ব্যক্তিনির্ভরতা কাটিয়ে মাদরাসাশিক্ষা উঠে আসে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়।

ভারতবর্ষে মাদরাসাশিক্ষার সূচনা ঘটে আরো অনেক পরে- সপ্তম শতাব্দীতে। পুরো ইসলামি জগতে বিশেষ করে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে অসংখ্য মাদরাসা। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের। তবে ক্যারিয়ারভাবনাটি তখনো বড় করে ভাবনায় আসে নি বা আসার সুযোগ পায় নি মূলত দুটো কারণে।

প্রথমত শিক্ষানির্ভর ক্যারিয়ার ভাবনাটি তখনো প্রতিষ্ঠাই পায় নি। পৃথিবীর কোথাও নয়। চাষাবাদ, ব্যবসা, পারিবারিক ও ঐতিহ্যগত শিল্পের মতো সনাতন মাধ্যমকেই মানুষজন সাধারণত পেশা হিসেবে বেছে নিতেন।

আর দ্বিতীয়ত তখন ছিলো খেলাফত ও মুসলিম শাসনের যুগ। মুসলিম শাসনের নানা পর্যায়ে মাদরাসা শিক্ষিত তরুণরাই ডাক পেতো। তাদের হাতেই ছিলো বা থাকতো রাষ্ট্রীয় সকল কাজ আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব। তাই কর্মক্ষেত্র নিয়ে ভাবার তেমন কোনো কারণ তাদের ছিলো না।

তবে সেই সোনালি যুগ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া ক্যারিয়ারের মতো অতি বাস্তব বিষয়ের ক্ষেত্রে অতীত আলোচনাও তেমন কাজের কথা নয়। তবু খুব সংক্ষেপে আমরা অতীতটা টেনে আনছি মূলত সামনের আলোচনার সুবিধার্থেই।

ভারতে মুসলিম শাসনের শেষ এবং বৃটিশ শাসনের শুরু- দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে মাদরাসাশিক্ষার অনুকূল পরিবেশের। এবং মাত্র একশ বছরের বৃটিশ শাসনামলে বড় ও মধ্যম সারির সব মাদরাসাই প্রায় বিলীন হয়ে যায়।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর দিল্লীতে স্বউদ্যোগে টিকে থাকা অবশিষ্ট মাদরাসাগুলোকেও বলপূর্বক বন্ধ করে দেয়া হয়। উপমহাদেশজুড়ে মাদরাসাশিক্ষার আকাশে নেমে আসে অন্ধকার।

এরপর ১৮৬৬ সালে মাওলানা কাসেম নানুতবীর হাত ধরে শুরু হয় নতুন ধারার মাদরাসা- দারুল উলুম দেওবন্দ। পুরো উপমহাদেশের মাদরাসাগুলো- যেগুলো কওমি মাদরাসা হিসেবে খ্যাত, সেগুলোর সূচনা ও বিস্তার এই দারুল উলুম থেকেই।

উপেক্ষিত ক্যারিয়ার

একদিকে দুর্দান্ত প্রতাপে প্রথম শতাব্দী অতিক্রম করছে বৃটিশ শাসন অন্যদিকে আগেই কবর রচিত হয়েছে ইসলামি শিক্ষার। স্বাধীনতা আন্দোলনের জেরে নিশ্চিত করা হয়েছে হাজার হাজার আলেমের জেল, দেশান্তর ও ফাঁসির হুকুম।

এসব বাস্তবতা সামনে রেখে কওমি ঘরানার মাদরাসাগুলোর প্রতিষ্ঠাতা ওলামায়ে কেরাম কিছু ব্যতিক্রমধর্মী মূলনীতি গ্রহণ করেন। যেমন, সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য জনগণের সহায়তা গ্রহণ, অল্পসংখ্যক লোক দিয়ে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র বিষয়গুলোকে একীভূত করে ব্যাপকভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন আর জীবিকার ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা।

ফলে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে বাস্তবতা দাঁড়ায়- ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য নিজেকে আমি উৎসর্গ করলাম।’ এই অঙ্গীকারনামা তখনকার বাস্তবতায় খুবই ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয় এবং ভাববাদের এ উপমহাদেশে সহজেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

অর্থাৎ ইহকাল ও দুনিয়ার বিষয়টি কওমি শিক্ষাধারার শুরু থেকেই উপেক্ষিত হয় এবং তা সচেতনভাবেই। এই অর্থে মাদরাসাশিক্ষায় ক্যারিয়ার ভাবনার তেমন কোনো সুযোগ নেই। বিগত দেড়শো বছর ধরে উপমহাদেশের মাদরাসাগুলো এ ধারারই একনিষ্ঠ অনুসরণ করে আসছে।

এখানকার বাস্তবতা হলো- কারো ভেতর নিজের কর্মজীবন বা সম্মানজনক জীবিকার চিন্তা উদয় হওয়া বা সেগেুলো নিয়ে কোনোরকম আলোচনার মানেই হলো তার চেতনা বা বিশ্বাসে ফাটল ধরা। আস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়া। এমনকি মাদরাসাশিক্ষার মূলধারা থেকেও তার ছিটকে পড়া। আমাদের প্রশ্নটা শুধু এখানেই।

খোলামনে বলি
আমরা এখানে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দ্বীনের সেবার ব্যাপারে কোনো কথা নেই। আপসরফার প্রশ্নও উঠছে না। কিন্তু এ দুটোকে ঠিক রেখে ক্যারিয়ারভাবনাটা কি সামনে আনা যায় না? বর্তমান থেকে মুখ ফিরিয়ে দেড়শো বছর আগের বাস্তবতা আঁকড়ে থাকা কতোটা যৌক্তিক?

ক্যারিয়ারভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নটি আসতে পারে সিলেবাস বা পাঠ্যসূচি নিয়ে। আমরা দারুল উলুমের মূলনীতি অষ্টকে দেখি- ‘পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচি নির্ধারিত হয়ে আছে কিংবা পরে পরামর্শের ভিত্তিতে যা নির্ধারিত হবে’- এই পরে সময়টা কবে আসবে?

অনেক আলেমকে বলতে শুনি- আমরা আকাবিরদের রেখে যাওয়া বিন্দুতে আটকে আছি। পরে তাদেরও যখন প্রচলিত ধারারই পরিবর্তনহীন মাদরাসা করতে দেখি তখন মনে প্রশ্ন জাগে- এই বিন্দুটি ঠিক কী এবং কেনো আমরা এখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারছি না।

আরেকটি বিষয় এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যা, পুঁজিবাদ বা বিশ্বায়ন- কারণ যাই হোক, ক্যারিয়ার বা ভবিষৎতচিন্তায় সবাই এখন অস্থির। আজকাল প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী মাদরাসায় ভর্তি হচ্ছে। এসব অতি বাস্তব ও জরুরি বিষয়ের ঠিকঠাক কোনো ব্যাখ্যা হাজির না থাকায় মাদরাসাশিক্ষায় একটা অস্থিরতা- বলা ভালো ছন্দপতন ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।

এখন দুটো ভাবনার একটাকে অবশ্যই সামনে আনা প্রয়োজন। এক, ছাত্র নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ প্রচলিত ধারা ও মূলনীতি ঠিক রেখে এমন স্বল্পসংখ্যক ছাত্রই মাদরাসাশিক্ষার জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হবে- যারা ইলম ও দ্বীনের খেদমতে নিজেদের স্বর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত।

ক্যারিয়ারভাবনা বা কর্মজীবন-জীবিকা তাদের কোনোরকম অস্বস্তিতে ফেলবে না। আর দ্বিতীয়ত- পরামর্শের ভিত্তিতে সিলেবাসে গঠনমূলক একটা পরিবর্তন আনা হবে। যাতে মূল লক্ষ্য ঠিক রেখেও ছাত্ররা- হোক তারা বিশেষভাবে সিলেক্টিভ, বর্তমান সমাজ-বাস্তবতায় একজন যোগ্য প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে ওঠবে।

বর্তমান প্রজন্মের মেধা আগের চেয়ে ধারালো, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখনকার ছেলেমেয়েরা পড়াশানায় ভালো এবং সহজেই যে কোনো কিছু আয়ত্ত করে নিতে সক্ষম- এই ভাবনাটা কওমি শিক্ষাধারায় কোনোভাবেই বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না।

ছাত্রদের সামনে পদ্ধতিগতভাবে পরিমিত শিক্ষার খোরাক হাজির হচ্ছে না। ফলে কেউ সময় নষ্টের সুযোগ পাচ্ছে তো কেউ হতাশ হচ্ছে বা বাইরের পাঠে মনোযোগ দিচ্ছে। এই বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে বা সমাধান না করে আমরা যদি নীরব থাকি এবং নসিহতকেই একমাত্র সমাধান ভেবে নিশ্চিন্ত হই- তো সন্দেহ নেই মাদরাসাশিক্ষার চলমান অস্থিরতা বাড়বে।

আখেরে সবার জন্যই তা ক্ষতিকর প্রমাণিত হবে। বর্তমানে তরুণ আলেমদের অনেককেই আমরা নিজস্ব চিন্তামতে সিলেবাসে পরিবর্তন এনে ছোট ছোট মাদরাসা গড়ে তুলতে দেখছি। অনেকে আবার আধুনিক ও ইসলামি শিক্ষার সমন্বয়ে প্রণয়ন করছেন একরকম খিচুড়ি সিলেবাস। দিনশেষে এগুলো মাদরাসাশিক্ষার ঐতিহ্যবাহী ধারায় বিশৃঙ্খলাই বাড়াচ্ছে কেবল। কে নেবে এর দায়?

ছাত্রদের ভাবনা
আমরা রাজধানীসহ দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক ছাত্রদের সাথে এ নিয়ে কথা বলেছি। যারা পড়াশোনায় তুলনামূলক দুর্বল, অমনোযোগী- স্বাভাবিকভাবেই এসব নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। নেই উদ্বেগও।

ক্যারিয়ার কী হবে না হবে এসব নিয়ে তারা তেমন কিছু জানে না, ভাবেও না। এই না ভাবার কারণ আস্থা বা বিশ্বাস নয়, একরকম হতাশা। ক্যারিয়ার বিষয়ক প্রশ্নকে তাই এড়িয়ে যেতেই পছন্দ তাদের। তবে পড়ুয়া ও চিন্তাশীল ছাত্রদের ব্যাপারটা ভিন্ন। তাদের ভাবনা ভিন্ন এবং নিজের মতো করে ব্যতিক্রম কিছু করতে তারা উদগ্রীব। পথ ও পদ্ধতি নিয়ে যদিও কেউ কেউ দ্বিধান্বিত।

ওদের মধ্যে আবার দুটো ধারা। একটি ধারা এমন- মাদরাসাশিক্ষায় এসে আল্লাহর সন্তুষ্টি খোঁজায় নিজেকে বিলীন করাতেই মর্জি তাদের। এবং প্রচলিত খেদমত ও কাজের সুযোগের বাইরে অন্যকিছু ভাবাকে তারা একরকম অন্যায় ও হীনমন্নতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে চায়।

বাকিদের কথা- সিলেবাসে পরিবর্তন বা বিয়োজন নয় যা আছে তার সাথে সংযোজনের সুযোগ আছে বা অন্তত বিশেষ তত্ত্বাবধানে হলেও মেধাবী ছাত্রদের জন্য এমন একটা ধারা গড়ে তোলা যেতে পারে, যাতে তারা ভালো আলেম হওয়ার পাশাপাশি জেনারেল ধারাতেও যুক্ত হতে পারে।

আধুনিক বিষয়াদির সমন্বয়ে দীনী বিষয়ের গবেষণায় নিয়োজিত হতে পারে। এটা নিজেদের জন্য যেমন, সাধারণ শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে খেদমতের জন্যও আদর্শ একটা পদ্ধতি হতে পারে। তবে তাদের বড় একটা অংশেরই ইচ্ছে- ভবিষ্যতে মাদরাসা-মসজিদ থেকে কোনোরকম সুবিধা না নিয়ে দ্বীনের কাজে নিয়োজিত হওয়া।

জীবিকার ক্ষেত্রে তাদের নানারকম ভাবনা আছে। সেগুলো বাস্তবায়নে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তারা আশাবাদী। নিজ নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের বক্তব্যে বেশ প্রত্যয়ও লক্ষ করা গেলো।

সফল ক্যারিয়ার
মাদরাসাপড়ুয়াদের সাধারণ ক্যারিয়ার মসজিদ ও মাদরাসায়। তবে আগের দিন তো আর নেই। প্রার্থী বেশি, মানুষও অনেক সচেতন। তাই এখানেও যথেষ্ট প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের।

তবুও, এখনও পর্যন্ত মাদরাসা-মসজিদই কওমিপড়ুয়াদের প্রধান ও প্রায় বিকল্পহীন কর্মক্ষেত্র। মাদরাসায় পড়াশোনা করে যারা অন্যান্য পেশায় জড়িয়েছেন এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন এমন অনেকের সাথেও আমরা কথা বলেছি।

আছেন, এমন লোকও প্রচুর। সুযোগ ও সংখ্যা বিবেচনায় এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে আছেন ব্যবসায়ী আলেম সমাজ। হজ এজেন্সি, ট্রাভেলস এন্ড ট্যুর, হাউজিং ও রিয়েল এস্টেট, লাইব্রেরি ও প্রকাশনা, ফার্মেসী, ডিজাইন এন্ড প্রিন্টিং, কাপড়, গার্মেন্টস ও কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট নানা দিকসহ অন্যান্যক্ষেত্রে ব্যবসা করে আজ তারা সুপ্রতিষ্ঠিত।

কেউ কেউ এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ও জাতীয় পর্যায়ে নিত্যপণ্যের প্রডাকশন ও বিপণণের মতো বড় বড় প্রকল্পেও কাজ করছেন। এর বাইরে মাদরাসাশিক্ষা শেষ করে বিভিন্ন মেয়াদী কারিগরি ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কোর্স করে বা আলিয়া মাদরাসা, বাউবি ও সরাসরি জেনারেল শিক্ষাধারার পরীক্ষাসমূহে অংশ নিয়ে পরবর্তীতে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতেও যোগ দিয়েছে অনেক মেধাবী ও পরিশ্রমী তরুণ।

মাদরাসাপড়ুয়াদের ক্যারিয়ারভাবনায় সাম্প্রতিক সময়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছে মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, টিভি চ্যানেল, বেতার ও সাময়িকীর গ্ররুত্বপূর্ণ নানা পদে দক্ষতার সাথে কাজ করে চলেছে একদল আলেম। বেশকিছু ইসলামি শিল্পীগোষ্ঠীও এখন যথেষ্ট অগ্রসর। বয়ান-মাহফিল ও দাওয়াহ সম্পর্কিত বিশাল কর্মক্ষেত্র এখন আরো প্রসারিত।

অন্যদিকে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে মাদরাসাপড়ুয়াদের রাজনীতি-সচেতনতা বেড়েছে। তারা সুস্থ রাজনীতির ময়দানে আগ্রহী হচ্ছে, এগিয়ে আসছে। এসবের বাইরে তরুণ আলেমদের কাছে নতুন করে জনপ্রিয় হচ্ছে সুদমুক্ত অর্থনৈতিক সংগঠন ও সেবামূলক সংস্থার ধারণা।

এভাবে, এভাবেই ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে মাদরাসাপড়ুয়াদের কর্মজগত। মাদরাসার শিক্ষক-কর্মকর্তারাও এখন যথেষ্ট উদার, সচেতন ও আন্তরিক। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণসহ কর্মমুখী নানা উদ্যোগ তারা নিচ্ছেন, ছাত্রদের সচেতন করছেন। মাদরাসাশিক্ষা সমাপ্ত করে নিজের প্রচেষ্টায় ব্যবসা-বাণ্যিজ্যসহ সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে যারা নিয়োজিত হয়েছেন এমন কজন আলেমের সাথেও আমরা কথা বলেছি।

পুরো সময় ইলমের খেদমতে থাকতে না পারার আক্ষেপ তাদের যেমন আছে, আছে একদম শূন্য থেকে শুরু করে নতুনসব কর্মক্ষেত্রে এসে সাফল্য পাওয়ার তৃপ্তিও। নিজের পাশাপাশি মেধাবী মাদরাসাপড়ুয়াদের এসব কর্মক্ষেত্রে সুযোগ করে দেওয়ার বেলায়ও তাদের প্রচেষ্টা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। এবং তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ইসলামের বিশেষত কোনো না কোনোভাবে ইলমের খেদমতে নিয়োজিত থাকছেন।

তারাও বিশ্বাস করেন- ওলামায়ে কেরাম আরেকটু বাস্তবমুখী ও সময়সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সবকিছুরই সহজ একটা সমাধান হতে পারে। অস্বস্তির দেয়ালটা সরে গিয়ে দেখা মিলতে পারে আলোকিত ভোরের।

সফল মানুষ সফলতার রহস্য
প্রতিটি মানুষই চায় জীবনে সফল হতে, বড় হতে। সবাই স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনের এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। তাই বলে সবাই কি পারে সফল হতে? জীবনে বড় হওয়া কি খুব সহজ?

সাফল্য প্রত্যাশী একজন তরুণের প্রথমেই প্রয়োজন নিজেকে চেনা, নিজের ভেতরটাকে জানা। নিজের সামর্থ্যের খোঁজ রাখা এবং তাতে আস্থাশীল হওয়া। প্রত্যয়ী হওয়া নিজের ভবিষ্যৎ-সাফল্য অর্জনে। শিক্ষা ও অন্যান্য বৈষয়িক বিষয়াদি তাকে কেবল সাহায্যই করে।

কিন্তু শিক্ষাটাকে- বলা ভালো সার্টিফিকেটকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে চারপাশে আজকাল এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, যে কোনো মূল্যে ভালো মার্কস বা নাম্বার পেতে সবাই মরিয়া। পড়ুক বা না পড়ুক, বুঝুক বা না বুঝুক, পরীক্ষায় ভালো ফল করলেই হলো। বাইরের সমাজের এ প্রভাবটা মাদরাসাপড়ুয়াদের ওপরও পড়ছে।

অনেকে এ নিয়ে হতাশায় ভোগছে। অথচ সরকারসহ সচেতন সবাই আজকাল শিক্ষানির্ভর ক্যারিয়ারের ধারণার বাইরে নতুন নতুন সৃজনশীল কর্মক্ষেত্র তৈরিতে জোর দিচ্ছে। বিনিয়োগ করছে মোটা অংকের টাকা। আমরাও সবাইকে সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করার আহ্বান জানাই।

একজন মাদরাসাপড়ুয়ার প্রধান বৈষয়িক লক্ষ্য থাকবে ভালো আলেম হওয়া। তারপর বড়দের পরামর্শক্রমে কে কোন ময়দানে কীভাবে ইসলামের সেবা করবে, নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলবে সে সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে। সবাই নিজের মতো করে ভাবলে এবং নিজের মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রস্তুত হতে পারলেই কেবল সফল ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। সফল ও আদর্শ মানুষ হওয়া সম্ভব।

একই সাথে বেকারত্বহীন কর্মময়, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। সুতরা মাদরাসাপড়ুয়া তরুণদের বলি- এসো আমরা নিজের প্রতি তাকাই। নিজের সামর্থ্যরে ব্যাপারে সচেতন হই। কঠোর মুজাহাদার মাধ্যমে নিজেকে প্রবল প্রতিযোগিতাময় এই সময় ও সমাজের জন্য গড়ে তুলি। এগিয়ে যাই নিজস্ব ভাবনার পথ ধরে। তাহলে সাফল্য আমাদের পদচুম্বন করবেই।

কারণ, আত্মপ্রত্যয় আর সংকল্পই যুগ যুগ ধরে সফল হয়ে আসা মানুষদের সফলতার প্রধান ও একান্ত রহস্য। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন।

শেষের আগে
দারুল উলুম দেওবন্দ এবং এ ঘরানার মাদরাসাগুলোর অবদান উপমহাদেশের মুসলমানদের জীবনে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যময়, আজকের বাংলাদেশে বসে তা অনুমান করা সম্ভব নয়।

যুগ যুুগ ধরে চলে আসা সমৃদ্ধ এ শিক্ষাধারার হঠাৎ মোড় ঘুরে দাঁড়ানোর ভাবনাও সহজ নয়। আবার চলমান প্রতিযোগিতা ও যুগচ্যালেঞ্জর অস্থির সময়ে দেড়-দুশো বছর আগের বাস্তবতা আঁকড়ে থাকার মানসিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

আমরা চাই- কানে কানে চলা আলোচনা প্রকাশ্যে শুরু হোক। আবেগ আর ঘোরের জগৎ থেকে নিরেট বাস্তবতায় আমাদের পদার্পণ ঘটুক। বিক্ষিপ্ত অবস্থান ও ভাবনার জায়গা থেকে সরে এসে আমরা একটা প্লাটফর্মে দাঁড়াই। সময়ের দাবিগুলোকে আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে ভাবি।

আখেরে তা মাদরাসাশিক্ষা এবং হাজার হাজার তালেবুল ইলমের জন্য কল্যাণকরই প্রমাণিত হবে। ওমা আলাইনা ইল্লাল বালাগ...

শাকিল আদনান: আলেম। লেখক। সম্পাদক।
পরিচালক- মানাম কনজ্যুমার প্রডাক্টস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ