মুহাম্মাদ আবদুর রহমান গিলমান
শিক্ষক, কলামিস্ট
ছাত্র রাজনীতি। একটি আলোচিত সমালোচিত বিষয়। অনেক বিজ্ঞজন এ নিয়ে অনেক লেখালেখি করছেন। এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক বয়ান-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান ছাত্র রাজনীতি পর্যালোচনা করলে ছাত্রদের তিন শ্রেণিতে বিভক্ত দেখা যায়। এক. ছাত্র রাজনীতির নামে বাড়াবাড়ি ও চরম সীমালঙ্ঘন করে ছাত্র রাজনীতিকে একটি সন্ত্রাসী কর্মকণ্ডে পরিণত করেছে।
এরা এমন পর্যায়ে উপনিত হয়েছে যে, এদের সার্বিক কার্যক্রমকে ছাত্র রাজনীতি না বলে নিছক সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলা চলে। যদিও এরপরও তারা নিজেদের ছাত্রনেতা ও তাদের কার্যক্রমকে ছাত্র রাজনীতি বলে বেড়ায়।
দুই. এই শ্রেণি ছাত্র রাজনীতি থেকে অনেক দূরে সরে রয়েছে। এদের ধারণা ছাত্র জীবনে রাজনীতি হারাম। ছাত্র রাজনীতিকে এরা বিষধর সর্পের চেয়েও ক্ষতিকর মনে করে। যার কারণে তারা এর থেকে সবসময়ই দূরে থাকে।
তিন. এ শ্রেণি ছাত্র রাজনীতি নামে বাড়াবাড়ি করে না কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও করে না। আবার ছাত্র রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকে না; বরং ঈমানী দায়িত্ব পালন মনে করেই তারা রাজনীতি করে।
বাংলাদেশের ত্রিধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিকভাবে এই তিন শ্রেণির ছাত্র পাওয়া সম্ভব। তবে এখানে আমার উদ্দেশ্য হল- ১ম শ্রেণিতে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির ঐ সকল বন্ধুরা, যারা ছাত্র রাজনীতির নামে নিজের জীবন-যৌবন ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওইসব তালেবুল ইলম বন্ধুরা, যারা আকাবিরদের চেতনা, ঐতিহ্য লালনে ও ঈমানী দায়িত্ব পালনে বিরত রয়েছে।
সর্বশেষ ওইসব বন্ধুই উদ্দেশ্য যারা স্বীয় ক্যারিয়ার গঠনের পাশাপাশি ঈমানী দায়িত্ব পালনে সক্রিয় রয়েছে।
ইতিহাসের আলোকে, বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায়- প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র বন্ধুরা চরম ভ্রষ্টতা ও ভ্রান্তির মাঝে রয়েছে। উভয়ের পূর্বসূরীদের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এদের কারো বর্তমান অবস্থান সঠিক নয়।
যারা আজ ছাত্র রাজনীতির নামে অরাজনীতি চর্চা করছে তাদের পূর্বসূরিরাই তো ৫২-এর সফল ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ৬৯-এর গণ অভ্যূত্থানেও ছিল এদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে এদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
এভাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, বার বার সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তারা ছিল অগ্রসেনানী। এদের থেকেই তৈরি হয়েছে বড় বড় দার্শনিক, চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, কূটনৈতিকসহ অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু আজ ওই ছাত্ররাই যারা জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার, যারা আগামী দিনে জাতির নেতৃত্ব দিবে তারা একেকজন সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে তৈরি হচ্ছে। নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ভুলে আজ কলঙ্কজনক অধ্যায়ের রচনা করছে।
জাতির ভবিষ্যত কর্ণধাররাই আজ সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, হলদখল, ইভটিজিং, মাদকসহ সকল অন্যায় কাজের মধ্যে লিপ্ত। তাদের অভিভাবকরাই বলছে- দুই টাকার জন্য এরা টেন্ডারবাজী শুরু করে।
এদের কারণে আজ মানুষ তৈরির কারখানাগুলো সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মিনি ক্যান্টনম্যান্টে রূপান্তরিত হয়েছে। যার কারণে আজ ছাত্র রাজনীতির কথা শুনলে মানুষ আঁতকে উঠে।
অন্যদিকে কাওমি অঙ্গনে যারা ছাত্র রাজনীতিকে হারাম ফতোয়া দিয়ে এর থেকে অনেক দূরে রয়েছেন, যারা মনে করেন ছাত্রজীবনে অন্য কোন কাজ করা যাবে না। আমি তাদের কাছে করজোড়ে জানতে চাই- এই ইলম অর্জনের উদ্দেশ্য কী?
এর দু’টি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ১. জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করা, মুহাক্কিক হওয়া বা বড় বড় ডিগ্রী-উপাধী অর্জন করা। ২. ইলম শিখে তদানুযায়ী আমল করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
যদি মা’লুমাত বৃদ্ধি আর উপাধি অর্জনই মাকসাদ বা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ইলমে দীন শেখা আর বাহ্যিক দুনিয়াবী কাজ যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন উদ্দেশ্য থাকে না তার মাঝে পার্থক্য রইল কোথায়?
আর যদি ইলম শেখার উদ্দেশ্য তা বাস্তবজীবনে আমলে পরিণত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা হয়, তাহলে আপনার কাছে অনুরোধ- আপনার ফিকাহর কিতাবের মাসআলাগুলো, কুরআনের বিধানের আয়াতগুলো এবং আল্লাহর রাসুলের গোটা সীরাত আবার মুতালাআ’ করুন।
গভীর দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করুন আর নিজেকে জিজ্ঞেস করুন- এর কত পার্সেন্ট আপনি আমল করতে পেরেছেন বা পারছেন? আমি বলব, তাহারাতের কিছু মাসআলা ব্যতীত সালাতের অনেক মাসআ’লা, যাকাতের অধিকাংশ মাসআলার ওপর আমল করা যাচ্ছে না।
হুদুদ, কিসাস, দিয়াত ইত্যাদি অনেক মাসআলার বাস্তবায়ন স্বচক্ষে দেখার কোন সুযোগ নেই। জিহাদ অধ্যায়ের কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। এভাবে কুরআন-সুন্নাহ ও ফিকাহর অনেক মাসআলার ওপর আমল করার সুযোগ হচ্ছে না।
এখন প্রশ্ন হল- এত কিছু তাহলে কেন নেসাবে রাখা হয়েছে? সেই তা’লীমুল ইসলাম থেকে বুখারী শরীফ পর্যন্ত এরপর তাখাসসুসাত, প্রায় প্রত্যেক জামাতেই এই মাসআলাগুলো পড়া হচ্ছে। তাহলে কেন এত সময় নষ্ট।
মূলত ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সকল বিধানাবলীর পূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করার নামই হল ইসলামী রাজনীতি।
আকাবিরদের অনুসরণ কাওমি মাদরাসার একটি বৈশিষ্ট্য। তাই আকাবিরদের অনুসরণ বলে আকাবিররা ছাত্র রাজনীতি করেননি বা ছাত্র রাজনীতি পছন্দ করেননি একথা ঢালাওভাবে বললে ইতিহাসের সাথে যেন অসঙ্গতি মনে হয়।
আকাবিরদের অনেকেই যেমন ছাত্র রাজনীতিসহ ছাত্রজীবনে সকল ব্যস্ততা পরিহার করতে বলেছেন, আবার নিজে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বা সমর্থন করেছেন এমন অনেক আকাবিরও ইতিহাসে পাওয়া যায়।
তবে এই রাজনীতির উদ্দেশ্য হল আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা ও বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ ও সংগ্রাম করা। রাসুল সা.-এর পরে আমাদের সবচেয়ে বড় আকাবির হলেন হযরত সাহাবায়ে কেরাম। তাঁরা সবাই রাসুল সা.-এর ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশি এ ছাত্র থাকা অবস্থাতেই বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ ও সংগ্রাম করেছেন।
সাহাবায়ে কিরাম রা.-এর পর বহু তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ও যুগ যুগ ধরে উলামায়ে কেরাম ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্নভাবে বাতিলের মুকাবিলা করেছেন। সময়ের সংক্ষিপ্ততা ও কাগজের সংকীর্ণতার কারণে এখানে সেই বিস্তারিত ইতিহাস লেখা যাচ্ছে না।
সংক্ষেপে দারুল উলুম দেওবন্দ ও এর আগ পর কিছু উলামায়ে কিরামের যৎসামান্য ইতিহাস আলোচনা করব।
এ উপমহাদেশে ইসলামি আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ.-এর ইন্তেকালের পর তাঁর এই মিশনের নেতৃত্বের ভার আসে তাঁর ছেলে শাহ আবদুল আজীজ রহ.-এর ওপর। অথচ তখন তিনি মাত্র সতের বছরের বালক।
ইতিহাসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে- ‘আবদুল আজীজ রহ.-এর বয়স যখন মাত্র সতের বছর তখনই বাবা শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরিষদ তাকে ইমাম হিসেবে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এজন্য তাঁকে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য কেন্দ্রীয় পরিষদ উদ্যোগ গ্রহণ করে।’
শাহ আবদুল আজীজ রহ. যখন বড় হলেন তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যু্দ্ধ ঘোষণা করলেন এবং হিন্দুস্তানকে দারুল হরব ফতোয়া দিলেন। তাঁর এই ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা ভারতবর্ষে আন্দোলনের দাবানল জ্বলে উঠলো।
সর্বস্তরের উলামায়ে কিরাম, ছাত্র-শিক্ষক তাঁর এই ফতোয়ায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ময়দানে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ.-এর সময় যে সকল দীনি প্রতিষ্ঠান ছিল ইংরেজরা তা ধ্বংস করে দেয়।
এরপর দীনি শিক্ষার প্রচার-প্রসার ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মী তৈরিসহ আরও বিভিন্ন লক্ষ্য সামনে নিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দসহ অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠালাভ করে।
এ সকল মাদরাসাসমূহ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যসমূহের মাঝে একটি এটিও ছিল, ‘ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ’ তথা আল্লাহর বাণীকে সর্বাবস্থায় সমুন্নত রাখা। আর এর জন্য ছাত্রদের ঐভাবে দিক্ষাও দেওয়া হত।
ইসলামী রাজনীতির চেতনায় ছাত্রদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হত। যেমন ইতিহাসে পাওয়া যায়- ‘শিক্ষার পাশাপাশি আযাদীর দীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দেওয়া হত এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।’
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম ছাত্র হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান শাইখুল হিন্দ রহ. পরবর্তীকালে দারুল উলুমের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন।
১৮৫৭ খ্রি. সিপাহী বিপ্লবের সময় তাঁর বয়স ছিল ছয় বা সাত বছর। পরে ইংরেজ হায়েনারা এদেশের মুসলমানদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার করেছিল, তা নিজ চোখে দেখা এবং উস্তাদ মুরব্বীদের মুখে শোনার সুযোগ তাঁর হয়েছিল।
সিপাহী বিপ্লবে তাঁর দু’জন শায়খ হযরত কাসেম নানুতুবী রহ. এবং হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রহ. প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ফলে উক্ত দুই শায়েখের নিকট হতে আধ্যাত্মিক তা’লীম গ্রহণ করার সাথে সাথে তাদের বিপ্লবী চিন্তাধারার উত্তরাধিকারিত্বও লাভ করেন।
শাইখুল হিন্দ রহ. যেভাবে ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি চর্চা ও শিক্ষা করেছেন, দারুল উলুমের অধ্যক্ষ হওয়ার পরও তিনি তাঁর ছাত্রদের সক্রিয় রাজনীতির মাঠে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে প্রেরণ করতেন।
১৯১১ সালের দিকে বিশ্বের তদানিন্তন তিন পরাশক্তি বৃটেন, রাশিয়া ও ফ্রান্স একত্রিত হয়ে সর্বশেষ ইসলামি খেলাফত তথা তুর্কী উসমানি খিলাফত উৎখাত করার জন্য তুরস্কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এ সময় শায়খুল হিন্দ রহ. মাদরাসা বন্ধ করে দিয়ে ছাত্রদের খেলাফত রক্ষার সপক্ষে জনমত গঠন ও উসমানি খেলাফতকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে চাঁদা আদায়ের কর্মসূচিসহ সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দেন।
এছাড়াও শায়খুল হিন্দ রহ. ইংরেজ খেদাও আন্দোলনকে আরো বেগবান করার লক্ষে তাঁর প্রাক্তন ছাত্রদের দ্বারাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেমন- জমিয়তুল আনসার, জুনদুল্লাহ, সামারাতুত্তারবিয়াহ ইত্যাদি।
শাইখুল হিন্দ রহ. যেভাবে ছাত্রজীবনে তাঁর উস্তাদ কাসেম নানুতুবী রহ. ও রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. থেকে রাজনৈতিক দীক্ষা অর্জন করেছেন, তেমনি শাইখুল হিন্দ রহ. থেকে ছাত্রজীবনেই রাজনৈতিক দীক্ষা অর্জন করেছেন হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.।
পরবর্তীকালে যিনি অনেক সময় হাদিসের দরস বাদ দিয়েও রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতেন।
এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- ‘গোলামের আবার কিসের হাদিস পড়া’ অর্থাৎ ইংরেজদের গোলামিতে থেকে হাদিস পড়ার আগে তাদের উৎখাত করতে হবে।
এভাবে ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, উলামায়ে দেওবন্দের অনেকেই ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন।
মাওলানা আবুল হাসানাত মোহাম্মদ আবদুল হাই, মাওলানা আদুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রমুখ তৎকালীন বঙ্গীয় উলামায়ে কেরামের অনেকেই ছাত্র জীবনে রাজনীতি করেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামের মাঝে যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, শাইখুল হাদিস আল্লামা আজীজুল হক রহ., সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম রহ., আল্লামা মোস্তফা আল হোসাইনী রহ., মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ. প্রমুখ।
এছাড়াও বর্তমান সময়ের অনেক উলামায়ে কেরাম হাফেজ্জী হুজুর র.-এর নির্বাচনের সময় ছাত্র ছিলেন। আর হাফেজ্জী হুজুর র.-এর নির্বাচনের সময় তাঁকে শুধু সমর্থন নয়; বরং সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেননি এমন মাদরাসা অনেক কম আছে।
তৎকালীন হাটহাজারী মাদরাসার মুরুব্বীরা মাদরাসা বন্ধ দিয়ে ছাত্রদের নিয়ে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। এভাবে অতীত এবং সাম্প্রতিক সময়ের উলামায়ে কিরামের অনেকেই ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার ইতিহাস পাওয়া যায়।
সর্বশেষ বর্তমান বিশ্বের কিংবদন্তি, উলামায়ে আহলে হকের মাথার মুকুট, হযরত আল্লামা তাকী উসমানী’র ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস বলে আলোচনার সমাপ্তির দিকে যাব।
আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর জীবনীর ওপর লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে প্রদত্ত সমাপনী ভাষণে জাস্টিস আল্লামা তাকী উসমানী বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাঝে মধ্যে আল্লামার সাথে পরামর্শ করতাম। একবারের ঘটনা- যখন আমি পাকিস্তানের ‘ইসলামী নযরিয়াতী কাউন্সিলের’ সদস্য।
একবার পরিস্থিতি কিছুটা এমন সৃষ্টি হচ্ছিল যে, কাউন্সিলের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে আমার মন চাচ্ছিল না। আমি আমার পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে লিখিতাকারে আল্লামাকে অবহিত করলাম। সাথে একথাও লিখলাম, কাউন্সিলের মাধ্যমে পাকিস্তানে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে আমারও সামান্য অংশ থাকবে- এ কাল্পনিক আশায় এ পর্যন্ত আমার নিজের লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি করেছি।
এর জবাবে তিনি লিখেন, আমি তোমাকে কাউন্সিল থেকে অব্যহতি নেয়ার পরামর্শ দেই না। তুমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ অব্যাহত রাখ।’ এ হল আমাদের আকাবিরদের ইতিহাস।
ধারাবাহিক আলোচনা করছিলাম বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রদের নিয়ে। প্রত্যেক বিষয়ের একটা মধ্যমপন্থা থাকে। আর ওই মধ্যমপন্থাটাকেই হাদিসে উত্তম বলা হয়েছে।
সে হিসেবে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির বিপরীতমুখী যে দু’টি চিত্র তুলে ধরা হল, এর বাইরে মধ্যমপন্থা হিসেবে একটি শ্রেণি রয়েছে। যারা ছাত্র রাজনীতির নামে কখনও কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়নি।
আবার ছাত্র রাজনীতি থেকে দূরেও সরে থাকেনি; বরং লেখাপড়ার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গঠনের পাশাপাশি আকাবিরদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সর্বপ্রকার বাতিলের মুকাবিলা করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে আল্লাহর জমীনে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এদের মাধ্যমে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির ধারা পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। এদের এখানে মেধাবী ছাত্রদের পাল্লা দিন দিন ভারি হচ্ছে।
প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির চরম অবক্ষয়ের মাঝেও অভিভাবক তার সন্তানকে এ ধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করাতে পেরে গর্ববোধ করে।
পরিশেষে সর্বস্তরের ছাত্র ভাইদের বলব, সীমালঙ্ঘন আর বাড়াবাড়িও নয়, আবার দূরে থাকাও নয়, আসুন লেখাপড়ার পরিবেশ ঠিক রেখে আদর্শ ছাত্র রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গঠন করি এবং ঈমানী দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হই।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে সত্য বুঝে তা অনুসরণ করার এবং ভ্রান্ত থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর দীনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন
লেখক : শিক্ষক, নুরপুর মাদরাসা, ফেনী।
সাবেক কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন
তথ্যসূত্র
১. রাজনীতিতে বঙ্গীয় উলামার ভূমিকা।
২. দেওবন্দ আন্দোলন: ইতিহাস, ঐতিহ্য, অবদান।
৩. জিহাদ ও ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে।
৪. আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর মিশন।
৫. নব চেতনার ডাক ইত্যাদি।