বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

আরাকান: পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম

নামে কী বা যায় আসে!
খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর ধরে স্বাধীন সত্তা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা, রাজনৈতিক ঐতিহ্য প্রভৃতি ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে আরাকান। বর্তমানে যা মিয়ানমারের একটি প্রদেশ।

দেশটির পূর্ণ নাম রিপাবলিক অব দ্য ইউনিয়ন অব মিয়ানমার। প্রাক্তন নাম বার্মা। প্রাচীন নাম ব্রহ্মদেশ। দেশটি আমাদের প্রতিবেশি। হ্যাঁ, আড়াই দশক আগের সেই বার্মাই এখন মিয়ানমার।

১৯৮৯ সালে সামরিক জান্তা দেশটির নাম পাল্টায়, পাল্টায় রাজধানীর নামও। রেঙ্গুন থেকে ইয়াঙ্গুন। এখন তাও নেই; এখনকার রাজধানী নেইপিদো। পরিবর্তন শুধু দেশ আর রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বিভিন্ন রাজ্য ও প্রদেশের নামও তারা পরিবর্তন করে ছেড়েছে।

আমাদের আলোচ্য স্টেট ‘আরাকান’। পরিবর্তিত হয়ে এর নাম এখন রাখাইন। কারো কারো মতে- ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে ‘রাখাইন’ নামটি পর্তুগীজ অপভ্রংশে ‘আরাকান’ নামে পরিবর্তিত হয়- যা এখনো ইংরেজিতে সমানভাবে জনপ্রিয়। আবার অনেকে বলেন, আরাকানের প্রাচীন নাম ‘রাখাইনপিয়ে’। রাখাইন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত রাক্ষস এবং পালি শব্দ ইয়াক্কা (যক্ষ) থেকে- যার অর্থ দৈত্য অথবা দানব।

ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদদের বর্ণনায় আরাকানের বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। তবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মতে, আরাকান নামটি অনেক পুরনো। এ নামের বিকৃতিতেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উচ্চারণ হয়েছে। আরাকান শব্দটি মূলত আরকান; যা আরবি ‘আর রুকন’ শব্দের অপভ্রংশ। রুকন শব্দের অর্থ হলো স্তম্ভ বা খুঁটি।

ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদকে রুকন বলা হয়। তাই তাদের ধারণা- সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে তৎকালীন মুসলমানরা আরাকানকে ইসলামের বুনিয়াদের দিকে খেয়াল রেখে ‘আরাকান’ নামকরণ করেছে।

ভৌগলিক অবস্থান ও আয়তন

বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত এ রাজ্যটিকে বঙ্গোপসাগর এবং নাফ নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম মোহনাবেষ্টিত আরাকান-ইয়োমা নামের দীর্ঘ পর্বতশৃঙ্গ- যার সর্বোচ্চ চূড়া ভিক্টোরিয়া শৃঙ্গের উচ্চতা ৩,০৬৩ মিটার (১০,০৪৯ ফুট) মিয়ানমারের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করেছে। এর উত্তরে চীন, পূর্বে ম্যাগওয়ে অঞ্চল, ব্যাগো অঞ্চল এবং আয়েইয়ারওয়াদি অঞ্চল, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ। এটি উত্তর অক্ষাংশের ২১ক্ক২০ ও ১৬ক্ক২২-এর মধ্যে এবং পূর্ব দ্রাঘিমাংশে ৯২ক্ক২১ ও ৯৫ক্ক২০” এর মধ্যে অবস্থিত।

ভূগোলের দিক থেকে আরাকান বার্মার (ব্রহ্ম) মূল ভূখণ্ড থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি, বার্মা ও আরাকান পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণি দ্বারা। এই পর্বতশ্রেণিকে বলে আরাকান-ইয়োমা। এর মধ্য দিয়ে আছে তিনটি গিরিপথ। এই তিনটি গিরিপথের মধ্য দিয়ে কেবলমাত্র একটি দিয়ে বছরে সব সময় যাতায়াত করা চলে। অন্য দু’টির মধ্য দিয়ে বর্ষাকালে যাতায়াত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

আরাকানের আয়তন নির্ণয় খুবই কষ্টসাধ্য। বাংলার সাথে আরাকানের সীমা প্রায়ই পরিবর্তন হতো।

বাংলাদেশের কক্সবাজার, রামু ও চট্টগ্রামসহ একটি বিশাল অংশ দীর্ঘদিন যাবৎ আরাকানের শাসনাধীনে ছিল। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান (১৬৬৩-৭৭; ১৬৭৯-৮৮ খ্রি.) কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের পর থেকেই কেবল এর আয়তন সঠিক অর্থে নির্ধারিত হয়।

এ হিসেবে বৃটিশ শাসন পর্যন্ত আরাকানের আয়তন ছিল ২০,০০০ (বিশ হাজার) বর্গমাইল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা উত্তর পার্বত্য আরাকান বার্মার চিন (Chin) প্রদেশে এবং দক্ষিণ আরাকানের কিছু অংশ লোয়ার বার্মার ইরাবতি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করায় বর্তমানে এখানকার আয়তন ১৪,২০০ বর্গ মাইল।

আরাকানের মানচিত্রের দৈর্ঘ্য ৩৬০ মাইল। কিন্তু প্রস্থে স্থান বিশেষে ভিন্নতা রয়েছে। উত্তর আরাকান অঞ্চলটি বেশ প্রশস্ত- যার প্রস্থ প্রায় ১০০ মাইল এবং আরাকানের দক্ষিণাংশে নিচের দিকে ক্রমশ সরু- যার প্রস্থ প্রায় ২০ মাইল। সমগ্র আরাকান অঞ্চল উত্তর-পশ্চিমে ১৭১ মাইলব্যাপী নদী ও স্থল সীমারেখা সহকারে বাংলাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত।

Image result for rakhine state

এখানে মিয়ানমার আর বাংলাদেশের কিছু তথ্যের তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেয়া যায়। মিয়ানমারের আয়তন ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৫৭৮ বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা ৫ কোটি ১৪ লাখ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৭৬ জন।

বিপরীত দিকে বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৯ লাখ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১ হাজার ৩১৯ জন। পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে ঘনবসতি হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান দশম, আর মিয়ানমারের হচ্ছে ১২৫তম।

আধুনিক আরাকান অঞ্চলটি সুদূর অতীতে চারটি ভৌগোলিক সীমানায় বিভক্ত ছিল। সীমানাগুলো হচ্ছে- ধন্যাবতি (Dhannyarwadi), রামাবতি (Ramawadi), মেখাবতি (Mekhawadi) এবং দারাবতি (Darawadi)।

তৎকালীন ধন্যাবতি অঞ্চলটিই বর্তমান আরাকানের রাজধানী এলাকা। এছাড়া রামাবতি বর্তমান রামব্রি দ্বীপ (Rambree Island), মেখাবতি বর্তমান চৌদুবা এবং দারাবতি বলতে আধুনিক সান্ডওয়েকে বুঝানো হয়ে থাকে।

ব্রিটিশ শাসনামলে এসে আরাকান হয়ে যায় বার্মার একটি বিভাগ (Division)। এই বিভাগের ছিল চারটি জেলা। যথা- ১. আরাকান হিলট্রাক্টস, ২. আকিয়াব, ৩. সান্ডওয়ে ও ৪. কাউকপিউ।

বর্তমানে আরাকান বা রাখাইন হলো মিয়ানমারের একটি প্রদেশ; বিভাগ আর নয়। কিন্তু বর্তমান আরাকান প্রদেশের আয়তন হলো আগের আরাকান বিভাগের চাইতে ছোটো। এই ছোটো হওয়ার কারণ, আরাকান হিলট্রাক্টসকে জুড়ে দেয়া হয়েছে মিয়ানমারের আরেকটি প্রদেশের সাথে।

মিয়ানমার বর্তমানে সাতটি প্রদেশ (Constituent stats) এবং সাতটি বিভাগ নিয়ে গঠিত। এই সাতটি বিভাগে বাস করেন খাঁটি বর্মিভাষী জনসমষ্টি; কিন্তু আর সাতটি প্রদেশের মধ্যে ছয়টির জনসমষ্টির মাতৃভাষা বর্মি নয়।

কৃষি ও বনাঞ্চল

আরাকানের জমি খুব উর্বর। সমুদ্রের তীরবর্তী হবার কারণে এখানকার আবহাওয়া মধ্যম প্রকৃতির- যা কৃষি কাজের জন্য বেশ উপযোগী! অঞ্চল ভেদে আরাকানের একেক স্থানের মাটি একেক রকম। এর কিয়দাংশ এঁটেল মাটি এবং বাকি অধিকাংশ অঞ্চলের মাটিই দোআঁশ, পলি ও বেলে। আকিয়াবের রাথিদং ও মংডু অঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চলই বেলে মাটি।

এছাড়া আরাকানের উপত্যকাসমূহের উঁচু অঞ্চলজুড়ে বর্ষার পাহাড়ি ঢল ও জল প্রবাহের কারণে উর্বর পলি মাটি সমৃদ্ধ। আরাকানের অধিবাসীরা মূলত কৃষিকে মূল পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে, তবে আবাদযোগ্য সকল জমিই কৃষির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। গোটা বার্মার তিন চতুর্থাংশ জনগণ কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত। সেখানকার ৯,৫৪,২৫৭ একর আবাদযোগ্য জমির মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৮,৫৪,৭২৪ একর জমি চাষ করা হয়। বর্তমানে অনেক মুসলমান কৃষককে দেশ থেকে বিতাড়িত করে সেখানে মগদের পুনর্বাসন করাই এর অন্যতম কারণ।

Image result for rakhine state

কালাদান নদীর পাশে আরাকানিদের বসতি ও ফসলি জমিন

ধান আরাকানের প্রধান উৎপাদিত ফসল। এছাড়াও এখানে ভুট্টা, আখ, তামাক, চীনাবাদাম, আলু, বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, রসুন, পিয়াজ, আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, লিচু, বরই, কমলালেবু, বাতাবি লেবু, তরমুজ, জলপাই প্রভৃতি শস্য, শাকসবজি ও ফলমূল জন্মে।

আরাকানে কৃষি কাজের জন্য সাধারণত গরু-মহিষের লাঙ্গল ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রচালিত চাষ পদ্ধতিরও প্রয়োগ শুরু হয়েছে। গৃহপালিত পশু হিসেবে সেখানে গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতিই প্রধান।

আরাকান গভীর জঙ্গলাপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা। তাই সেখানে টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ, ভালুক, বুনো শুকর এবং বুনো হাতিও রয়েছে। বিশেষ করে ইয়োমা পাহাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে হাতি, গণ্ডার, বুনো গোখরা সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ এবং স্রোতস্বিনী নদীর মোহনায় কুমির রয়েছে।

কৃষির পাশাপাশি আরাকানের একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী মাছ শিকারকে তাদের প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। আরাকানের মংডু থেকে শুরু করে ওয়াচং (Gwachaung) হয়ে ইরাবতি বিভাগের থাবাং সীমান্ত অঞ্চল কিয়াকচামচং (Kzaukchamchaung) পর্যন্ত প্রায় ৩৬০ মাইলব্যাপী মনোরম সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চল। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন মোহনায় পর্যাপ্ত সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ে।

এছাড়া নদীমাতৃক আরাকানের নদীসমূহেও পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায়। বিশেষ করে নাফ নদী ও কালাদান নদীর উপকূলীয় চিংড়ি ঘের থেকে পর্যাপ্ত উন্নতমানের চিংড়ি উৎপন্ন হয়। আধুনিককালে সেখানকার পুকুর ডোবাতেও মাছ চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

আরাকানের মোট আয়তনের প্রায় ৭০% পাহাড় ও বনাঞ্চলসমৃদ্ধ। এখানকার বনাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নত মানের কাঠ উৎপন্ন হয়। আরাকানের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন সেগুনকাঠ মিয়ানমারের মোট উৎপাদিত কাঠের প্রায় ১৫ শতাংশ। এছাড়া আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে পিনকেডু নামে পরিচিত আয়রন কাঠ, বাঁশ, দারুচিনি ও ওক (Oak) গাছসহ প্রচুর পরিমাণে বনজ ও ঔষধি গাছ জন্মে। বনাঞ্চলের মধু আরাকানে খুব প্রসিদ্ধ।

খনিজ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্য

খনিজ সম্পদের দিক থেকেও আরাকান অঞ্চল খুব সম্ভাবনাময়। এখানে পেট্রোল, কয়লা ও তেলসহ বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদের সন্ধান রয়েছে। এমনকি সেখানে সোনা ও রূপার খনিরও অস্তিত্ব বিদ্যমান। কিন্তু খনন কাজের উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবে তা উত্তোলন ও ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হচ্ছে না।

দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর পশ্চিমা আকাক্সক্ষার জন্য রাখাইন ও মিয়ানমার সরকারের অপরাধগুলোকে এড়িয়ে চলা হয়। মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড তাই সম্প্রতি প্রতারণামূলকভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চলা বর্বরতার মূল কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাব বলে জানিয়েছেন।

তবে এ নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই, যদিও মিয়ানমার খনিজসমৃদ্ধ একটি দেশ, এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে সবচাইতে দরিদ্র। কিন্তু দারিদ্রই এই গণহত্যার মূল কারণ- যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন মতামত আসলে ভাষিক ছদ্মাবরণে থেকে ঘাতক মিয়ানমার সরকারের অপরাধগুলোর ভয়াবহতাকে চেপে যাবার নামান্তর।

বসনিয়া আর রুয়ান্ডার ক্ষেত্রেও আমরা একই ধরনের অজুহাত শুনেছি। পৃথিবীতে অনেক দরিদ্র দেশই আছে- তাই বলে সেসব দেশে শক্তিশালী সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের ওপর গণহত্যার প্রকল্প নেয় না। গণহত্যা ঘটাতে হলে চাই রাষ্ট্রিক পৃষ্ঠপোষকতা, যেখানে সমাজের প্রায় সকল স্তরের লোকই অংশগ্রহণ করে- আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সাথে তাই-ই হচ্ছে।

যাক, এ ব্যাপারে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা করবো। তার আগে আন্তর্জাতিক স্বার্থকেন্দ্রিক মারপ্যাঁচ সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা দেয়া যাক।

অনেককাল ধরেই চীন, ভারতসহ অন্যান্য এশীয় ও প্রশান্ত অঞ্চলের দেশগুলো মিয়ানমারের নির্দয় সামরিক সরকারের সাথে ব্যবসা করে আসছে। এখানে মানবাধিকার কখনো অগ্রাধিকার পায়নি। পক্ষান্তরে বহুকাল ধরেই ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো মিয়ানমারে ব্যবসা করতে পারেনি। তাদের অংশগ্রহণের জন্য মিয়ানমারের পরিচায়ক মুখের পরিবর্তন ছিল অপরিহার্য। এই বিকৃত পদ্ধতি শুরু হয় যোগ্যতাহীন সু চি’কে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার মাধ্যমে- আর তার ধারাবাহিকতায় আসে সেনা সদস্যদের অসামরিক পোশাক পরে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে পরিচিতি দেয়ার নাটকের দৃশ্যায়নে। যখন বার্মার নাম পাল্টে মিয়ানমার রাখা হয়।

এই দাবির ধারাবাহিকতায় আসে ২০১০ সালের নির্বাচন ও এর পরের উপনির্বাচন- যেখানে সু চি’র NLD পার্টি সদ্যোমে অংশ নেয়। উদ্দেশ্য ছিল- এটা প্রমাণ করা, মিয়ানমার ফ্যাসিবাদী সামরিক গোষ্ঠীশাসন থেকে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রে উত্তীর্ণ হচ্ছে।

Image result for rakhine state

রোহিঙ্গাদের অধিকাংশের পেশা মাছধরা... কালাদান নদীতে মাছ ধরছেন এক রোহিঙ্গা জেলে

এরপরে আসে থেইন সেইনের অলিখিত দূত হিসেবে সু চি’র পশ্চিমা বিশ্ব সফর- যেখানে তিনি বার্মার সাথে বহির্বিশ্বের ব্যবসা বাণিজ্য পুনঃস্থাপনের অনুরোধ জানান। সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের শেষ অঙ্কে আসে থেইন সেইনের জাতিসংঘে সফরের নাটক- যেখানে তিনি বান কি মুনসহ অন্যান্য পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করেন।

ফিরে আসি পরিচিতি পর্বে। চাল আরাকানের প্রধান রপ্তানি পণ্য। অতীতে আরাকান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাল রপ্তানি করা হতো বলে ঐতিহাসিকভাবে আরাকানকে ধন্যবতি (Granary of Rice) বলা হয়ে থাকে।

চাল ছাড়াও মাছ, লবণ, মশলা, তামাক, কাঠ প্রভৃতি আরাকানের প্রধান রপ্তানীযোগ্য পণ্য। প্রধান আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে ঔষধ, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কাপড় এবং প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত বিলাস সামগ্রীই প্রধান।

পর্যটন

আরাকানের পর্যটন শিল্প খুব সম্ভাবনাময়। সরকারিভাবে আরাকানকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হলে আকিয়াব, কিয়াকপাউ, সান্ডওয়ে, ঘাপালি (Ngapali) প্রভৃতি অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য সমুদ্রবন্দর, সমুদ্র সৈকত ও প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় হিসেবে আকর্ষণ করতে পারবে।

কারণ সেখানে আছে- দিগন্তজুড়ে সবুজের হাতছানি। সুবিশাল জলরাশি। পাহাড়ের মোহনীয় আকর্ষণ। নানাদিকে ছড়িয়ে থাকা বিখ্যাত সব বৌদ্ধবিহার আর পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তীর্থক্ষেত্র।

প্রাচীন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির লীলাভূমি মিয়ানমারের প্রকৃতির রূপ আর অত্যাশ্চর্য সব প্যাগোডা ভিনদেশি পর্যটকদেরও প্রধান আকর্ষণ। মিয়ানমারের দর্শনীয় জায়গাগুলো এক ঝলকে দেখে নিই-

(১) ইয়াঙ্গুন : পূর্বে এ জায়গাটি রেঙ্গুন নামেও পরিচিত ছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত রেঙ্গুন মিয়ানমারের রাজধানী ছিল। দেশটির সবচেয়ে বড় শহরও এটি। ইয়াঙ্গুনের প্রধান আকর্ষণ বিশ্ব বিখ্যাত শোয়েডেগন প্যাগোড- যা মিয়ানমারের মানুষের ধর্মীয় আচার পালনের কেন্দ্রবিন্দু। সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো এই বৌদ্ধ মন্দিরটির উচ্চতা ৯৯ মিটার।

মিয়ানমারের সাবেক সচিবালয় এখানেই অবস্থিত। একসময় ব্রিটিশ বার্মার প্রশাসনিক ভবন ছিল এটি।

১৮৮৯ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে লাল ইটের এই ভবনটি তৈরি হয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিয়ানমারের অনেক ইতিহাস। ইয়াঙ্গুনের আরেক আকর্ষণ শিয়া মসজিদ। বিশ শতকের শুরুর দিকে ইরান থেকে যাওয়া অভিবাসীরা ইয়াঙ্গুনে এই মসজিদটি গড়ে তোলেন। পর্যটকরা আরো যেসব দেখে মুগ্ধ হন- কলোনিয়াল সময়ের বহু পুরনো বিল্ডিং, মহা প্রসন্না গুহা, ৭০ মিটার দীর্ঘ শায়িত গৌতম বুদ্ধের মূর্তি, মহাজায় প্যাগোডা ইত্যাদি।

(২) বেগো (পেগু) : চৌদ্দ থেকে ষোলো শতাব্দীতে মন্ রাজাদের রাজধানী ছিল এই শহর। এ শহরে ছড়িয়ে রয়েছে আকর্ষণীয় বৌদ্ধ বিহার, সে সময়কার রাজাদের দর্শনীয় বাড়ি, উন্মুক্ত মার্কেট, কায়াকপুন প্যাগোডায় ৪টি সুদৃশ্য বিশালাকার বুদ্ধের মূর্তি সব কিছু বলতে গেলে এককথায় অনবদ্য। এগুলো এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যটকদের বিমোহিত না করে পারে না।

(৩) ম্রাউক উ : মিয়ানমারের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক শহর। একসময় শহরটিকে ঘেরা দেয়ালের দুর্গ বলে ভাবা হতো। মূলত এখানে থাকা প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্য এই দেয়ালগুলো নির্মাণ করা হয়। এর ইতিহাস নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করবো।

(৪) থানলিয়ন (সিরাইম) : ইয়াঙ্গুন থেকে বেগো নদী পার হয়ে মাত্র ৩০ মিনিট পেরোলেই এ শহরে খুব সহজেই পৌঁছা যায়। চৌদ্দদশ শতাব্দীতে এটি মিয়ানমারের অন্যতম বন্দর ছিল। সপ্তদশ শতকে এই অঞ্চলটি পুর্তগীজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখানে সপ্তদশ শতকে নির্মিত কাইকাহুক প্যাগোডা, থানলিন ও ইয়েল প্যাগোডা, বেগো নদীর স্বচ্ছ জলরাশি এবং নদীতে নৌ ভ্রমণ ভ্রমণে দেবে আনন্দ।

Related image

বেগান

(৫) বেগান : বেগান সোনালী শহর হিসেবে বিশ্বে প্রসিদ্ধ। নবম থেকে ১৩ শতাব্দীতে এ অঞ্চলের রাজারা তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি মিয়ানমারের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। ঐতিহাসিক বৌদ্ধমন্দির, প্যাগোডা আর প্রাকৃতিক সবুজে ঘেরা বেগান পর্যটন বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণ। এখানে প্রায় ১৩ হাজারের বেশি বৌদ্ধমন্দির রয়েছে।

(৬) মান্দালয় : বৃটিশরা সম্পূর্ণ মিয়ানমার দখলের পূর্বে এ অঞ্চলটি ছিলো মিয়ানমার রাজবংশের শেষ রাজ্য। এ কারণে এখনও এ রাজ্যটি মিয়ানমারের সাবেক রয়েল রাজধানী হিসেবে সমান গুরুত্ব বহন করছে। বর্তমানে মিয়ানমারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এটি। অনেক ঐতিহাসিক ভবন এবং মন্দির ও প্যাগোডা, সিল্ক শিল্প, মার্বেল খোদাই, ব্রোঞ্জ ও রূপা কারুশিল্পের পীঠস্থান এই মান্দালয়। মান্দালয় বাইরে সেইগিং পাহাড়কে ঘিরে স্থাপিত মঠ ও প্যাগোডা রয়েছে।

(৭) গোল্ডেন প্যালেস : মান্দালয় শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক বৌদ্ধবিহার গোল্ডেন প্যালেস। এটি একসময় প্যালেসের মূল অংশের সাথে যুক্ত ছিলো। কিন্তু তৎকালীন রাজার মৃত্যুর পর তার ছেলে এই অংশটি রাজবাড়ি হতে আলাদা করে দেন। কথিত আছেÑ এখানে মৃত রাজার আত্মা ঘুরে বেড়ায়। পরবর্তীতে এটিকে বৌদ্ধ বিহারে পরিণত করা হয়। একসময় এটি স্বর্ণ দিয়ে ঘেরা ছিল কিন্তু বর্তমানে তা কেবল বিহারের ভিতরে সাজানো।

(৮) পিনদায়া : পিনদায়া গুহা ঘর হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। এখানে গৌতম বুদ্ধের প্রায় আটহাজার চিত্র রয়েছে। কিভাবে এই গুহায় এসব চিত্র পাওয়া গেছে তা এখনও রহস্য। এর মধ্যে কিছু চিত্র রয়েছেÑ যা একশো বছর পুরনো, আর কিছু সা¤প্রতিক সময়ে সংযোজিত হয়েছে।

(৯) তুয়াং কালাত : এটি মিয়ানমার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। এই বিহারটি আগ্নেয়গিরির ঠিক মুখে অবস্থিত। একজন দর্শনার্থী ৭৭ টি সিঁড়ি পার হয়ে এই বিহারটি দর্শন করতে যান। আর তার সাথে উপভোগ করেন পাহাড়ের চারপাশের সবুজ পরিবেশ। পাহাড় চ‚ড়া থেকে চারপাশের প্রকৃতিকে দেখার অনুভুতি পাওয়া যাবে।

(১০) কালাউ : কালাউ মিয়ানমারের সবচেয়ে শীতলতম স্থান। প্রচন্ড গরমের সময়েও এ অঞ্চলটির আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা থাকে। জাতিগত অনেক সংখ্যালঘুর বাস এই এলাকায়। শহরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় মার্কেট। এই মার্কেটে নানারকম হস্তশিল্প, খোদাই করা কারুশিল্প খুব কম টাকায় পাওয়া যায়।

(১১) শ্বেন্দাগন প্যাগোডা : এই প্যাগোডাকে বৃহত্তম ড্রাগন প্যাগোডাও বলা হয়ে থাকে। বৌদ্ধ ধর্মবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান। প্রাচীন ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন রয়েছে এখানে। যেমন- গৌতম বুদ্ধের চুল ও বৌদ্ধ ধর্মের বহু অমূল্য পাণ্ডুলিপি- যা যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত রয়েছে এই স্থানটিতে।

(১২) ইরাবতি নদী : মিয়ানমারের প্রধান নদী হচ্ছে ইরাবতি। সারা মিয়ানমারজুড়েই রয়েছে ইরাবতির স্পর্শ। মিয়ানমারের পাথেইন, লাইং ও ইয়াঙ্গুন এই ইরাবতিরই শাখা। মিয়ানমারের পনেরটি প্রধান শহর ইরাবতিকেই ঘিরে তৈরি হয়েছিলো। মান্দালয় ও ইয়াঙ্গুনও একই কারণে রাজধানী হিসেবে গড়ে উঠেছিলো। নদীটিতে নৌ ভ্রমণ করা যায়। নদীর চারপাশের অপার সৌন্দর্যে ভ্রমণ হয়ে উঠে আনন্দময়। তার সাথে বাড়তি পাওয়া যাবে রাস্তার দু’পাশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপন, পাহাড়ের চ‚ড়ায় মন্দির। সেই সাথে জেলেদের ধরে আনা প্রচুর মাছ।

(১৩) ওয়্যার মেমোরিয়াল সমাধিক্ষেত্র : ইয়াঙ্গুন থেকে বেগোর রাস্তা ধরে ৩২ কি.মি. দূরে তাউকিন শহরে এই সমাধিক্ষেত্রটি অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর ২৭,০০০ সৈন্য এই মিয়ানমারে নিহত হন। তাদের এখানে সমাধি দেয়া হয়। তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ওয়্যার মেমোরিয়াল সমাধিক্ষেত্রটি নির্মাণ করা হয়।

(১৪) নগেপালি : সাদা বালি আর বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি দেখতে চাইলে নগেপালি ভ্রমণ করা যেতে পারে। বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত, সমুদ্রের স্বচ্ছ জলরাশি নগেপালিকে সাজিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যে। অধিকাংশ পর্যটক এখানে মাছ ধরার সাথে সমুদ্র স্নান এবং সার্ফিংয়ের জন্য আসেন। রূপ-বৈচিত্রের প্রাকৃতিক তীর্থভ‚মি এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মিলনক্ষেত্র এই মিয়ানমার। হোটেল ও রিসোর্ট বেশ সস্তা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

বহির্বিশ্ব হতে সামরিক জান্তা দ্বারা প্রায় অর্ধশত বৎসরব্যাপী বিচ্ছিন্ন প্রায় দেশটি দীর্ঘদিন অনেকটা বন্ধুবিহীন ছিল। এ বিষয়ে ‘বাড়ীর পাশের হাঁড়ির খবর’ নিবন্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মান্নান লিখেন- “দুটি দেশ একেবারে আমাদের বাড়ির পাশে। ভারত আর মিয়ানমার। দুটি দেশের সাথেই বাংলাদেশ সীমান্তের ভাগাভাগি আছে।

ভারতের সাথে বেশী মিয়ানমারের সাথে কম। বাপ-দাদারা বৃটিশ আমলে ভাগ্য ফেরাতে বার্মায় যেতেন। দেশটিকে সকলে চিনতো বার্মামুল্লুক হিসেবে। ধারণা ছিল- রাস্তায় ঘোরা ফেরা করলেই সোনা মেলে। অথচ ভারতের খবর বাংলাদেশের মানুষ যতো ব্যাপকভাবে রাখে, বার্মার বেলায় তার ছিটেফোঁটাও না।

বর্তমানে ভারতে যাওয়ার ভিসার জন্য এক লক্ষ আশি হাজার মানুষ অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় ভিসা অফিস দিনে তিন হাজার ভিসা প্রার্থীকে ভিসা দিতে পারে। এই তিন হাজারকে ভিসা দেয়া শেষ হলে আর তিন হাজার আবেদন জমা হয়। ওই তিন হাজার ফরম অনলাইনে জমা দিতে আধা মিনিটের কম সময় লাগে। এই সব ঘটে সূর্য উঠার আগেই।

ভারতে প্রতিদিন বিভিন্ন বিমান সংস্থার কমপক্ষে পাঁচটি ফ্লাইট আছে। টিকিট পাওয়া অনেক সময় কষ্টকর। এর পর আছে ডজন খানেক আধুনিক বাস আর সপ্তাহে উভয় দিক হতে তিন দিন ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা। পক্ষান্তরে বার্মায় সরাসরি যেতে হলে একমাত্র বাহন আমাদের বাংলাদেশ বিমান। তাও সপ্তাহে দুদিন। প্রায়শঃ অর্ধেকটা খালি যায়।”

১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ছিল মিয়ানমারের। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা (সিপিবি)-এর মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল চীন। ১৯৭৮ সালে চীনা নেতা দেং জিয়াও পেং মিয়ানমার সফরে আসেন।

১৯৮৬-তে সিপিবির ওপর থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন তুলে নেয় চীন। বৈরী সম্পর্ক দারুণভাবে সহযোগিতার দিকে নতুন মোড় নেয়। তারা তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগসহ বাণিজ্যিক সুবিধা পায়। এ সময় চীন সামরিকভাবে মিয়ানমারকে সহায়তা করতে থাকে।

১৯৮৯ সালে মিয়ানমার চীন হতে ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে। ভারতের ওপর ভ‚রাজনৈতিক কৌশলগত সুবিধা বাড়াতে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয় চীনের।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিগত বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে মিয়ানমারকে বহুমুখী সাহায্যের হাত খুলে দেয় চীন। চীনের সমর্থন মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে অধিকতর শক্তিশালী করে। তারা এই সুযোগকে ব্যবহার করে দেশের মধ্যে যেমন তাদের ক্ষমতা বাড়ায়, তেমনি একটি শক্তিশালী সমরশক্তির দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে চীনের সর্বোচ্চ সহায়তা পেতে থাকে।

ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করে এসেছি- সেই হিসেবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো মিয়ানমারে ব্যবসা করতে পারেনি। তাদের অংশগ্রহণের জন্য মিয়ানমারের পরিচায়ক মুখের পরিবর্তন ছিল অপরিহার্য। এই বিকৃত পদ্ধতি শুরু হয় যোগ্যতাহীন সু চি’কে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার মাধ্যমে। এরপর তাদের সম্পর্ক আরও ঘনিভ‚ত হতে থাকে বিভিন্ন উপায়ে।

ফলশ্রুতিতে শুরু হয় অপরাধী বর্মী সরকারের ওপর আরোপিত পুরোনো সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার পশ্চিমা সরকারগুলোর প্রতিযোগিতা- উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন বাজারে আগেভাগে ঢুকে নিজের ভাগের অংশ ঠিক রাখা। তারা মিয়ানমারে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দেয়। এমন উদ্যোগের মহড়া দেখে থেইন সেইন সরকারের সাহস বেড়ে যায় আরো অনেকগুণ। আর তারা ভাবতে থাকে যে বিশ্ববাসীর কাছে দেয়া আগের প্রতিশ্রুতিগুলো মানতে তারা আর বাধ্য নয়।

জাতিসংঘের সফরের অব্যবহিত পরেই, বর্ণবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিক্ষোভের সাজানো নাটক করে বর্মী সরকারের কাছে মুসলিমদের জোরপূর্বক অন্যত্র স্থানান্তরিত করার আর্জি জানায়। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলোতে তারা ঘোষণা দেয়- মুসলিমদের সাথে কোনোরকমের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেউ রাখলে তাকে মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে।

আগে যেভাবে বলা হলো- এটা নাৎসি নীতিরই ছায়া। এটা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাসহ সকল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার সার্বিক ব্যবস্থা বা অপকৌশল। মিয়ানমারের এই বৌদ্ধ ফ্যাসিবাদ এমনই অনিষ্টকর যে, আরাকানের ভেতরে ও বাইরে বসবাসরত রাখাইন বৌদ্ধরা মিয়ানমারের অন্য সব বৌদ্ধদের আশীর্বাদে মিয়ানমারে, বিশেষত রাখাইন রাজ্যে একজন মুসলিমও অবশিষ্ট রাখতে চায় না।

জনসংখ্যা
আরাকানের জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান প্রদান করা খুবই কষ্টসাধ্য। সামরিক জান্তা শাসিত রুদ্ধদ্বার দেশ হিসেবে সেখানকার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিস্থিতি এবং জনসংখ্যার বিন্যাস উভয় ক্ষেত্রেই অস্পষ্টতা রয়েছে। তাছাড়া স্বাধীনতা উত্তর মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে কোনো আদমশুমারিও হয়নি। ফলে এ বিষয়ে মতপার্থক্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার ভাষ্য ও আরাকানের মুসলিম লেখকদের মতানুসারে আরাকানের মোট জনসংখ্যা ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ। তন্মধ্যে ৩০ লক্ষ মুসলমান; যা প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর ৬০%। এদিকে ড. আবদুল করিম-এর মতে- আরাকানের মোট জনসংখ্যা ৪০ লক্ষ, তন্মধ্যে ২০ লক্ষ মগ-বৌদ্ধ, ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান, ৪ লক্ষ সর্বপ্রাণবাদী (Animist) এবং ২ লক্ষ হিন্দু ও খ্রিস্টান।

Image result for mosque in arakan

আরাকানের সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি, নামাজ পড়ছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা মুসলিম

আরাকানী মুসলিম লেখকদের মতানুসারে- প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বিভিন্ন সময় নির্যাতনের মুখে আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৮ লক্ষ (নতুন আসাসহ), সৌদি আরবে ২ লক্ষ, পাকিস্তানে ২ লক্ষ ৫০ হাজার, গালফ স্টেটসমূহে ৫৫ হাজার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ৪৩ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ১০ হাজারেরও বেশী মুসলমান আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে।

এছাড়া ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের গণহত্যার সময় লক্ষাধিক মুসলমানকে হত্যা করা হয় এবং ৫ লক্ষাধিক মুসলমান দেশ থেকে বিতাড়িত হয়। তৎকালীন বৃটিশ প্রশাসন বর্তমান গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার সুবিরানগরে এবং কক্সবাজারের সমুদ্রোপক‚লে শরণার্থী ক্যাম্প তৈরী করে এদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চালায়।

এভাবে বিভিন্ন সময় হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও বিতাড়নের ফলে মুসলমানদের সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।

তদুপরি আরাকানী মুসলিম লেখকদের পরিসংখ্যানটি উত্তর আরাকান বিশেষতঃ বুচিদং ও মংডু এলাকার পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেইসাথে পরবর্তী দু’টি পরিসংখ্যানের সাথে বিতাড়িত ও নিহত মুসলমানদের সংখ্যা যোগ করলে আরাকানী মুসলিম লেখকদের পরিসংখ্যানের সাথে মিলে যায়।

কেননা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারী মোতাবেক আকিয়াবের মুসলমান ছিল ৩৩%। অনুরূপভাবে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারী অনুযায়ী আরাকানের লোকসংখ্যা হচ্ছে ১২,৯৯,৪১২ জন। এর মধ্যে বৌদ্ধ ৮,৭৮,২৪৪ জন, মুসলমান ৩,৮৮,২৫৪ জন, হিন্দু ৩,২৮১ জন, খ্রিস্টান ২,৭৫৩ জন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছিল ২৫,৮৮০ জন। সুতরাং মোটামুটিভাবে বলা যায়- বর্তমানে আরাকানের মোট জনসংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ। এর মধ্যকার ৪০% লোক মুসলমান।

বার্মায় ১৩৫টি নৃতাত্বিক জাতি গোষ্ঠী আছে। এদের মধ্যে এগারোটি সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত। তার মধ্যে কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাম নেই। রোহিঙ্গারা সাধারণত খুব গরীব এবং শান্তি প্রিয় এবং বর্তমান বিশ্বে সব চেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি।

মুসলিম জনসংখ্যা আধিক্যের হেতু

আরাকান রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে। তার মধ্যে নৃতাত্তি¡ক দিক থেকে একটি গবেষণা হচ্ছে, বর্মীরা মোঙ্গল বংশোদ্ভূত- যারা পূর্ব হিমালয়ের কোনো একটি অঞ্চল থেকে আট বা নয় শতকে বার্মায় বসতি স্থাপন করে। তাদের আগমনের কয়েক শতাব্দী পূর্বে আধুনিক কম্বোডিয়া অঞ্চল থেকে মন খেমাররা বার্মায় বসতি স্থাপন করে। এরা বার্মায় প্রাচীনতম পায়াস (হেল) রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

এর কয়েক বছর পরে ৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বার্মায় প্যাগান রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা আনারোথা শক্তিশালী প্যাগান সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তিনি বিশুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে ১০৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মন রাজ্য দখল করে প্যাগান শহরটিতে সমগ্র বার্মার রাজধানী স্থাপন করেন।

১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলিয়ান-মুসলিম নেতা কুবলাই খান (১২১৫-১২৯৪ খ্রি.) বার্মা আক্রমণ করেন এবং বার্মায় প্যাগানদের ক্ষমতা ধ্বংস হয়। ফলে প্যাগান-বার্মা সাম্রাজ্যে মুসলমানদের প্রধান্য বৃদ্ধি পায়।

এ ব্যাপারটিকে আরো ব্যাপকভাবে গবেষণা করতে গিয়ে পাশ্চাত্যের কিছু কিছু চিন্তাশীল ঐতিহাসিক-লেখক লক্ষ্য করলেন, ইসলামের সূতিকাগার আরবভূমি থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থিত এ সকল অঞ্চল কেনো এবং কীভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পরিণত হলো? শুধু তাই নয়, বাংলার যে সমস্ত শহর-বন্দরে মুসলিম শাসকগণ অবস্থান করেছেন- যেমন মুর্শিদাবাদ, নদীয়া- এগুলোর চেয়ে অনুন্নত পল্লীতেই মুসলমানের সংখ্যা বেশি।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রিচার্ড এম. ইটন গবেষণা চালান। তিনি তাঁর The Rise of Islam and the Bengal Frontier (1204-1760) বইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেন।

তাতে তিনি লিখেছেন যে, ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী (মৃত্যু ১২০৬ খ্রি.) বাংলা দখল করলে বাংলায় মুসলমান শাসন শুরু হয়। এমন এক প্রেক্ষাপটে কাকতালীয়ভাবে এখানকার গুরুত্বপূর্ণ গঙ্গা নদীর প্রধান প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বাংলার প্রাচীন নগরীগুলো বিরান হতে থাকে; অন্যদিকে নতুন নতুন উর্বরা জমির সৃষ্টি হয়। নতুন ভ‚মির উর্বরা মাটিতে যেমন প্রচুর ফসল ফলতো, তার সাথে তাল মিলিয়ে জনসংখ্যারও বৃদ্ধি ঘটে, তেমনই নতুন ধর্মবিশ্বাসের বিকাশের জন্যও সময়টি ছিলো অত্যন্ত অনুক‚ল; ঠিক সে সময়ে যে ধর্মের ডাক দেওয়া হতো- সাধারণ মানুষ তা-ই গ্রহণ করতো। এ সময়টাতেই প্রথমে তুর্কি, আফগান বা পাঠানেরা আসেন। তার ফলেই আরাকানসহ বিশাল সাম্রাজ্যের নতুন ভ‚মিতে ইসলামের বিকাশ ঘটে।

আমরা দেখতে পাই- ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারিতে বার্মার মুসলিম সংখ্যা ৫৮,২৫৫। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তা বেড়ে হয় ১৭৮,৬৪৭। অনেক ইতিহাসবিদগণ বলে থাকেন- ধানের মাঠে বাঙালি মুসলমানের শস্তা শ্রমই ছিল এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ। চট্টগ্রাম থেকেই আরাকান অভিমূখি এই মাইগ্রেশন ছিল বেশি।

তাবৎ শিল্প বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়ার ফলে জীবন-জীবিকার সন্ধানে ভারত উপমহাদেশের মানুষদের পদচারণায় সরব হয়ে উঠে রেঙ্গুন সে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই। তাই অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতকের মধ্যভাগ (ষাটের দশক) পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ দুই শতাব্দীরও অধিককালব্যাপী সমগ্র ভারতবর্ষের ভাগ্যান্বেষী মানুষদের আনাগোনা ছিল এ রেঙ্গুন শহরকে ঘিরেই। নগরীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির ফলে এক পর্যায়ে স্থানীয় বার্মিজ বৌদ্ধ জনগণের চেয়েও এখানে অস্থানীয় হিন্দু-মুসলমানদের সংখ্যা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।

১৯০১ খ্রি., ১৯২১ খ্রি. ও ১৯৩১খ্রি.-এর আদম শুমারির রিপোর্টসমূহ এ তথ্যের স্বীকৃত দিচ্ছে। আদম শুমারি মোতাবেক দেখা যাচ্ছে- ১৯০১খ্রি. রেঙ্গুনের জনসংখ্যা ছিল ২,৪৮,০৬০ জন, ১৯১১খ্রি. ২,৯৩,৩১৯ জন।

১৯১১খ্রি. এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মোট ২,৯৩,৩১৯ জন অধিবাসীদের মধ্যে ভারতীয় ছিল ১,৮৭,০০০ জন এবং বার্মিজ ছিল ১,০৫,০০০ জন। ১৯৩১খ্রি. মোট ৩,৪১,৯৬২ জন অধিবাসীর মধ্যে এখানে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল ২,১২,০০০ জন এবং বার্মিজদের সংখ্যা ছিল ১,২৮,০০০ জন।

এখানে উল্লেখ্য যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়দের মধ্যে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধাংশ। নিচের পরিসংখ্যানে তা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।

১৯২১ খ্রি. ১৯৩১ খ্রি.
হিন্দু ১,২৬,১৮৪ জন ১,৪০,৯০১ জন
মুসলিম ৬১,৭৯১ জন ৭০,০০০ জন
মোট ভারতীয় ১,৮৭,৯৭৫ জন ২,১১,৬৯২ জন

১৮২৪-২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্রিটিশরা রেঙ্গুন দখল করে নেয়। আবার ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের দিকে দ্বিতীয় Anglo-Burmese যুদ্ধের পর ফিরিয়ে দেয়। সমগ্র বার্মা ব্রিটিশ রাজ্যভুক্ত হওয়ার পর এটি সারা দেশের প্রধান শহরে পরিণত হয়। সে থেকে এ শহরে ব্যাপকহারে আসতে থাকে ভারতীয় (বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) অধিবাসীরা। রেঙ্গুন বার্মার প্রধান বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর পরিধিও বাড়তে থাকে ক্রমাগত। এসবের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে রেঙ্গুন এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ৬০ এর দশক পর্যন্ত এ শহর ছিল ভারতীয়দের দ্বারা পরিপূর্ণ। ভারতীয়রা এখানে ব্যবসা-বানিজ্য এবং শিল্প প্রতিষ্ঠায় রাখেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ১৮৫৫-১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এখানে আগা আহমদ ইস্পাহানী, মোহাম্মদ ইব্রাহিমজী ডুপলে, মোল্লা দাউদ, আবদুল ওয়ালী এবং জামাল ব্রাদার্স এর মতো উল্লেখযোগ্য মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাজ-কারবার ছিল।

বন্দরের উন্নতির সাথে সাথে যুগপথ উন্নয়ন ঘটে এর ব্যাংকিং ব্যবস্থার। ফলে ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে এখানে ‘ব্যাংক অব বেঙ্গল’ প্রতিষ্ঠিত হয়Ñ যা পরে ‘ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

অর্থাৎ সেই উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই রেঙ্গুন শহর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো- যার চ‚ড়ান্ত বিকাশ দেখা যায় বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে। এ সময় থেকেই এ শহরে সিটি কর্পোরেশন ব্যবস্থা বহাল হয়। বার্মার মুসলমান সমাজের গৌরব ব্যারিস্টার এমএম রফি এমএলসি সাহেবের মতো বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব রেঙ্গুন-এর সিটি করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট (১৯২৯ খ্রি.) ও মেয়র (১৯৩৬ খ্রি.) পদে সমাসীন ছিলেন।

আকৃতি ও গঠন
আরাকান হলো এমন একটি প্রদেশ- যার মানুষের মাতৃভাষা খাঁটি বর্মি নয়; কিন্তু বর্মি ভাষার খুবই কাছাকাছি। একে বলতে হয় প্রাচীন বর্মি ভাষার অনুরূপ। অর্থাৎ আরাকান প্রদেশের অবস্থান ভাষাগত দিক থেকে বর্মি পরিবারভুক্ত হলেও বেশ কিছুটা ভিন্ন।

আরাকানের সব লোক মঙ্গোল মানবধারার নয়। এখানে অনেক মানুষের চেহারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনুরূপ। তাদের চোখ আয়ত, নাক সরল ও উন্নত, মাথার চুল মসৃণ। তাদের পুরুষের মুখে দাড়ি গোঁফের প্রাচুর্য থাকতে দেখা যায়। এদের মাথা প্রধানত মধ্যমাকৃতির; কিন্তু যাদের মনে করা হয় একান্তভাবেই আরাকানীয়- তাদের মাথার আকৃতি গোল, চুল ঋজু, চোখের ওপর পাতায় থাকে বিশেষ ধরনের ভাঁজ।

যে কারণে তাদের চোখ দেখে মনে হয় ছোটো এবং বাঁকা। এদের গণ্ডের হাড় হয় উঁচু- যে কারণে এদের মুখমণ্ডল দেখে মনে হয় সমতল। পুরুষের মুখে দাড়িগোঁফের প্রাচুর্য থাকতে দেখা যায় না। এরা অনেক খর্বাকৃতির। মানবধারার দিক থেকে এদের বলা চলে, দক্ষিণ চীনের মঙ্গোলধারার।

আগামী পর্বে থাকছে

আরাকানের মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য
আরাকানের মুসলমান : শিল্পকলা ও সংস্কৃতি
বাংলা সাহিত্যে আরাকান
রোহিঙ্গা মুসলিম : নিপীড়ন ও বঞ্চনার সাতকাহন
রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশ
মিয়ানমারের মুসলমানদের আন্দোলন ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড
উম্মাহ ও বিশ্ব : ভূমিকা ও দায়


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ