মুহাম্মাদ শোয়াইব
‘সৌদি পত্রিকায় সুচিকে সমর্থন’ এরকম শিরোনামে একটি নিউজ ঘুরে ফিরছে অনেক অনলাইন পত্রিকায়। শিরোনামটা অপ্রত্যাশিতই। যে কারণেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিউজটা শেয়ার হচ্ছে প্রচুর। তবে বাস্তাবে বিষয়টা কি এমন?
প্রথমে পূর্বপশ্চিম বিডি নামের একটা অনলাইনে নিউজটা দেখার পর সন্দেহ হলো।
[তাদের নিউজটা এমন- সৌদি আরবের দৈনিক পত্রিকা আল-শার্ক, আল-আওসাত রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমারে যে গণহত্যা, নির্বিচারে ধর্ষণ ও বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ চলছে, তার জন্যে নিন্দা না জানিয়ে বরং দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সুচিকে সমর্থন করেছেন। এ দুটি পত্রিকার নিবন্ধে বলা হয়েছে, সুচি সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সুচি বলেছেন, তার সরকার রাখাইনে সবাইকে রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন।
সৌদি আরবের এ দুটি পত্রিকায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুটি পত্রিকা লন্ডন, বৈরুত ও রিয়াদ থেকে প্রকাশিত হয়। সুচিকে সমর্থন জানিয়ে পত্রিকা দুটি বলে মিয়ানমারের এই নেত্রী তার দেশে সন্ত্রাস দমনে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মিয়ানমার সরকারের প্রতিও সমর্থন জানায় পত্রিকা দুটি।
পত্রিকা দুটির নিবন্ধে আরো বলা হয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে তারা সন্ত্রাসী।]
প্রথমেই গুগলে সার্চ দিয়ে মূল পত্রিকাটা বের করার চেষ্টা করলাম। এখানেই সাংবাদিকের মূর্খতার প্রমাণ পাওয়া গেল। আসলে পত্রিকা দুটি নয় একটিই। কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে সাংবাদিক মনে করেছেন দুটি পত্রিকা।
পত্রিকাটির নাম ‘আশ শারকুল আওসাত’। সাংবাদিক দুটি শব্দকে দুটি পত্রিকার নাম বলে ধরে নিয়েছেন।
যাইহোক পত্রিকার ইন্টারন্যশনার বিভাগে গিয়ে খোঁজে বের করলাম নিউজটা। বাংলাদেশি মিডিয়ায় সাধারণত আরবি অনুবাদের লোক নেই। তাই সন্দেহ হলো নিউজটা ইংরেজি থেকে করা কিনা। সেটা নিশ্চিত হতে পূর্ব পশ্চিমবিডিকে ফোন দিলে তারা ওই বিষয়টির সদুত্তর দিতে পারল না। বলল অনেক পত্রিকা এই নিউজ করেছে আমরা সেটা দেখে করেছি। বলে লাইন কেটে দিল।
এবার বাংলা শিরোনামটা দিয়ে গুগলে সার্চ দেয়া হলে অনেকগুলো পত্রিকায় নিউজটা পাওয়া গেল। তবে এগুলোর কোনোটাই মূলধারা মিডিয়া নয়। কিন্তু অনেক্ষণ সার্চিংয়ের পর আমাদেরসময়.কম এর লিংক এল। বোঝার বাকি থাকল না নিউজটা তাদেরই করা।
আমাদের সময়ের লিংকে ঢুকে নিউজটা পাওয়া গেল। অনুবাদ করেছেন রাশিদ রিয়াজ। একটা ইংরেজি পত্রিকা থেকে করা। নাম আইইউভিএম প্রেস। পত্রিকাটিতে ঢুকে বের করা হলো নিউজটি। হ্যাঁ তারাই এ গাঁজাখুড়িটা করেছে। ইসলাম, আরব, মুসলিম নিয়ে সাধারণ ক্রিটিসাইজ করার চেষ্টায় থাকে যারা।
এবার আসা যাক মূল নিউজের বিষয়ে। যদিও একে নিবন্ধ বলা হয়েছে মূলত এটি নিউজ। ‘আশ শারকুল আওসাত’ এর মূল টেক্স বের করে পড়ার পর দেখা গেল এটি রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে সুচি যেসব মিথ্যাচার করেছেন সে বক্তব্য নিয়েই রিপোর্ট। তার বক্তব্যগুলোই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। প্রশ্ন হলো অপরাধীর বক্তব্য তুলে ধরলেই কি তার পক্ষে বলা হয়?
আর পত্রিকাটি আরবের প্রসিদ্ধ পত্রিকা নয়। এটির মূল অফিস লন্ডনে। লন্ডনে প্রিন্ট প্রকাশের পাশাপাশি বৈরুত ও রিয়াদে এদের নুসখা প্রকাশ হয়।
অনেকে বলতে পারেন, নিউজটার বাংলা অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি থেকে, তাদেরটা তো ঠিকই আছে। (ইংরেজিতেও পত্রিকার নাম দুটি নয় একটিই বলা হয়েছে, আল শার্ক আল আওসাত) কথাটি মানা যাচ্ছে না। প্রথমত পত্রিকাটি অপ্রসিদ্ধ, দ্বিতীয়ত এরকম একটি স্পর্শকাতার নিউজ অনুবাদের আগে কেন মূল টেক্স দেখা হলো না!
এ নিউজ প্রকাশ হওয়ার পর শুধু নিউজ থাকেনি। ফেসবুকে সার্চ দিয়ে দেখা গেল নিউজটা অনেকেই শেয়ার করেছেন এবং দলিল করেছেন সৌদি আরব রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে, আর গণহত্যার পক্ষে। যদিও আদতে বিষয়টার পুরোপুরিই ভিন্ন।
এবার আশ শারকুল আওসাতের মূল নিউজটি পড়ুন-
রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার ব্যাপারে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সুচি রোহিঙ্গা প্রতিরোধকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে অভিযোগ করেন, তারা ‘মিডিয়ার ভয়াবহ অপপ্রচারের’ শিকার। কিন্তু তিনি ১২৫ (বাস্তবে এই হিসাব আরও বেশি) হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নৃশংসতার শিকার হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারে নীরব থাকেন।
সুচি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ইসলামী বিশ্বের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জাতীয় ‘পরিশুদ্ধিকরণ’ প্রক্রিয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে এক চিঠিতে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে গত দুই সপ্তাহ যাবত চলমান সহিংসতা ও নৃশংসতা একটি ‘মানবিক ক্রাইসিসে’ পরিণত হতে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারের ওপর সংযত হওয়া ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে আহবান জানান।
গত কয়েক দিন আগে টেলিফোনে সুচির সঙ্গে কথা বলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান। এরদোগান অবশ্য বিশ্ব নেতাদের জাতিগত উচ্ছেদের শিকার রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
এক ফেইসবুক বার্তায় সুচি বলেন, রাখাইন রাজ্যে সরকার সব মানুষের অধিকার রক্ষায় সবচেয়ে সুন্দর পদ্ধতি কাজ করছে। তিনি সর্তক করে দিয়ে বলেন, মিডিয়ার অপপ্রচার অনেক সময় ভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণ হয়। এতে তিনি ইঙ্গিত করেন, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের হত্যার কিছু ছবি তার টুইটারে প্রকাশ করার দিকে। তবে পরে তিনি তা সরিয়ে ফেলেন। কেননা সেগুলো মিয়ানমারের ছিল না।
সংবাদ সংস্থা আল বয়ান বলছে, যে মিথ্যা তথ্যের শিকার হয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্টে, সেটা ছিল মিডিয়ার মিথ্যাচারের কারণে। এসব মিডিয়া সন্ত্রাসীদের প্রচার বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশের মাঝে সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি করতে চায়।
অন্যদিকে মিশর মিয়ানমারের মুসলমানদেরকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দান ও তাদের রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে যা ঘটছে যার কারণে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়তে ও শরণার্থী হতে বাধ্য হচ্ছে সেসব নৃশংসতার জন্য কঠোর নিন্দা জানাচ্ছে কায়রো।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই সংকটের ফলে সৃষ্ট মানবাধিকার পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সব প্রচেষ্টাকে মিশরের পক্ষ থেকে সমর্থন জানানো হবে।
রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা শুরু হয়েছে আজ থেকে ১২ দিন পূর্বে। যখন কয়েজন রোহিঙ্গা বন্দুকধারী যুবক কয়েকটি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাবাহিনী ক্যাম্পে হামলা চালায়। এরপর সেনাবাহিনী ও রোহিঙ্গা যুবকদের সেই সংঘর্ষের জের ধরে সেনাবাহিনী চারশর অধিক বেসামরিক লোককে হত্যা করে। তারা নিরুপায় হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এই ঘটনার জের ধরে সুচিকে শুনতে হয় পশ্চিমাদের করা সমালোচনা। সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলমান হামলার নিপীড়ন বন্ধে সুচি ব্যর্থ হওয়ায় প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। এমনকি কেউ কেউ তো ১৯৯১ সালে শান্তিতে পাওয়া নোবেলও যাতে প্রত্যাহার করে নিয়ে নেওয়া হয়- সে দাবিও জানিয়েছেন।
অন্যদিকে মিয়ানমার বলছে, নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরেুদ্ধে বৈধ হামলা চালাচ্ছে। যারা পুলিশ স্টেশনে হামলার জন্য দায়ী।
মিয়ানমার ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বেসামরিক লোকদের হত্যার জন্য রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহীদের দায়ী করছে মিয়ানমার। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও জীবন বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে পলায়নকারী রোহিঙ্গারা বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র ভিভিয়ান ট্যান বলেন, রাখাইনে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা-নির্যাতন এড়াতে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে প্রবেশ করায় কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় তাদের খাদ্য সরবরাহ ও বাসস্থান নিশ্চিত করা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের সংকট।
কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরগুলো একদম ভরে গেছে। অন্যান্য ক্যাম্পেও চাপ পড়ছে প্রচণ্ড। কিন্তু এতেই বন্ধ হচ্ছে না রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন। এ পরিস্থিতিতে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
জাতিসংঘ এক মুখপাত্র বলেছে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এক ১ লাখ ৪৬ হাজার। (কিন্তু এখন এই পরিমাণ আরও বেড়েছে। জাতিসংঘ তাদের সর্বশেষ হিসাবে বলেছে, গত দুই সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা।)
ভিভিয়ান ট্যান বলেন, গত আগস্ট থেকে এই পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা হয়েছে দুই লাখ ৩৩ হাজার। উল্লেখ্য, গত আগস্টেই রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা পুলিশ স্টেশন ও সেনা ক্যাম্পে হামলা চালায়।
বাংলাদেশের দুটি সূত্র বলছে, মিয়ানমার চলে আসা রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা ঠেকাতে সীমান্তে স্থল মাইন পুঁতেছে। তারা বলেন, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের এই কাজে কঠোর প্রতিবাদ জানাবে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের একটি সেনা সূত্র বলছে, তারা নব্বয়ের দশকে একবার অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ ঠেকানোর জন্য সীমান্তে মাইন পুঁতেছিলেন। সম্প্রতি তারা এরকম কোনো মাইন পুঁতেননি।
এ নিউজ দিয়ে কি আদৌ বোঝানোর উপায় আছে সৌদি পত্রিকা সুচির পক্ষাবলম্বন করেছেন? এবার পাঠকরাই বিচার করুন।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা শিবিরের হিরো : গাজী ইয়াকুব