মুহাম্মদ শোয়াইব
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে
মানবতার হাহাকার চলছে উখিয়া-কেটনাফের শরণার্থী শিবিরগুলোতে। স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদ। মানবতা ডুকরে কাঁদছে সেখানে। রাখাইনের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এই পর্যন্ত বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয়া ও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হওয়া লক্ষ লক্ষ আশ্রয় প্রার্থী রোহিঙ্গাদের মাঝে স্বজন হারানোর আর্তনাদে আকাশ ভারি হয়ে উঠছে।
উখিয়া থেকে টেকনাফ যাওয়ার প্রধান সড়কের দুই পাশের অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করলেই উঠে আসে হাহাকারের করুণ চিত্র। হায় মানুষ! হায় মানুষের জীবন!!
রাস্তার পাশে কাদামাটির ওপর স্রেফ একখানা পলিথিন বিছিয়ে দু দিন আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু সন্তানকে শুইয়ে রেখেছেন রোজিনা খাতুন। টানা পাঁচ দিনের হাঁটার ক্লান্তিতে শরীরটা যেন আর চলছে না। এর মধ্যে আবার বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ায় কেয়ামতের বিভিষিকা চলে গেল তার ওপর দিয়ে মাত্র দুদিন আগে।
সেই ভীষণ ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর নিয়ে রোজিনার একটু বিশ্রামের সুযোগ নেই। মাথা গুজার ঠাই নেই। নিজের কাদামাখা ভীষণ ওজনের শরীরটা দু হাতের ওপর ফেলে দিয়ে ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছেন তিনি। রাত ঘনিয়ে আসছে। রোজিনা জানে না কোথায় রাত কাটাবে তার সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তান? সংসারের একমাত্র কর্মোক্ষম স্বামীকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছেন রোজিনা। বাস্তবতার সামনে দাঁড়াতে পারছেন না তিনি।
অনেক দূরে ছিটকে পড়েছেন জীবন থেকে। কোনো কিছুই আগের মতো টানে না তাকে। কোথাও কেউ নেই। খুব ভীতু হয়ে গেছেন তিনি। তার ভিতরে সৃষ্টি হয়েছে এক অজানা আতঙ্ক।
রোজিনা যখন তার দুদিনের বাচ্চাকে পলিথিন দিয়ে রাস্তায় শুইয়ে রেখেছেন তখন কথা হয় তার সঙ্গে। তার থেকে শুনা যায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বর্বর বৌদ্ধ জানোয়ারদের পৈশাচিক নির্মমতার কথা। তার স্বামীর ওপর হায়েনারদের নৃশংসতার কথা স্মৃতিচারণ করে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। স্বামী সংসার হারিয়ে রোজিনার সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত।
তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে পাঁচ দিন হেটে বাংলাদেশে আসতে পারলেও স্বামী তো আর বেঁচে নেই। স্বামীর নিথর দেহে শেষ চুমু দিয়ে একমাত্র সন্তানকে গর্ভে নিয়ে পাড়ি জমাই বাংলাদেশে। পেছনে ফেলে আসা জীবন, পুড়ে যাওয়া ঘর আর স্বপ্ন যেন এক হয়ে গেছে। লক্ষ মানুষের আহাজারি, আক্ষেপ আর অভিশাপে কেমন যেন গুমোট হয়ে গেছে আমাদের জীবন।
রোজিনা আক্ষেপ করে বলেন, মিয়ানমারের উত্তর পশ্চিম অংশে আমরা বসবাস করি। এর সীমান্ত মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার ও বাংলাদেশে কোথায়ও আমাদের নাগরিকত্ব নেই। যুগ যুগ ধরে আমরা নাগরিক অধিকার বঞ্চিত। শিক্ষা চিকিৎসা, খাদ্যসহ মৌলিক অধিকার বঞ্চিত সব সময় নিপীড়নের শিকার।
রোজিনার কাছ থেকে উঠে আসে তাদের গ্রামগুলোর নির্মম চিত্র। গত কয়েক সপ্তাহ যাবত তাদের গ্রামগুলোতে প্রকাশ্যে গণহত্যা চলছে। পুরুষদের ধরে নিয়ে হাত পা বেধে প্রথমে তারা উল্লাস করে । পরে কুড়াল দিয়ে হাতপাগুলোকে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলে। এরপর সারা শরীর ছুরি দিয়ে আঘাত করে করে ঝাঝরা ঝাঝরা করে ফেলে।
কথা বলতে বলতে রোজিনা আবেগ আপ্লুত হয়ে পরেন। চাপা কান্নায় তার কন্ঠ থেমে যায়। স্বামীর স্মৃতিচারণ করে রোজিনা বলেন, স্বামীকে নিয়ে আমার সংসার খুবই সুখের ছিল। স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসত। কিন্তু আমি এখন দু:সহ স্মৃতিগুলোকে ভুলতে পারছি না। মাঝে মধ্যে রাস্তাঘাটে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকি। আর আমার স্বামী আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।