এ এস এম মাহমুদ হাসান
বিশেষ প্রতিবেদক
চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার ফাঁদে পড়ল কওমী মাদরাসার সরকারি স্বীকৃতির বাস্তবায়ন। সূত্র বলছে, কওমী শিক্ষা সনদ বাস্তবায়নে সংসদে আইন পাশে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সরকার ও কওমী শিক্ষা কমিশনের নেই কোনো উদ্যোগ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের একান্ত সদিচ্ছার অভাবে এবং কওমী শিক্ষা কমিশনের উদ্যোগহীনতায় বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদে কওমী মাদরাসার বহুল প্রতিক্ষিত কওমী শিক্ষার রাষ্ট্রীয় মান আর হচ্ছে না। ফলে ২০০৬ সনে তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেওয়া কওমী মাদরাসার সনদের মান ও বর্তমান সরকারের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেওয়া সনদের মান একই চোরাবালিতে আটকে গেল।
সূত্রমতে, গত ১০ সেপ্টেম্বর রোববার থেকে শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে কওমী মাদরাসার সনদ সংক্রান্ত কোনো বিল উত্থাপন হওয়ার এজেন্ডা ছিল না সরকারের। সংক্ষিপ্ত এই অধিবেশন আজ বৃহস্পতিবার শেষ হওয়ার কথা।
ফলে চলতি সংসদ অধিবেশনে কওমী মাদরাসার সনদের বিল উত্থাপন না হলে আগামী শীত কালীন সংসদ অধিবেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কওমী শিক্ষা কমিশনকে। তাতে চলতি বছরে স্বীকৃতি বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
এছাড়া সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে এসে কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি বাস্তবায়ন ও তা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ফলে ভোটের রাজনীতিতে আগামী বছরে যদি সংসদে বিলটি পাসও হয়, তাহলে পরবর্তীতে এ বিলটি আদালতের মাধ্যমে স্থগিত হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে। কেননা, আরবি সাহিত্য ও ইসলামিক ইতিহাসে কওমী শিক্ষার মাস্টার্স মান নিয়ে সরকারি আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে মতভেদ ও বিতর্ক রয়েছে ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে কওমী শিক্ষা ব্যবস্থার কিছুটা অসামাঞ্জস্যতা রয়েছে। তাই যে কোনো সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা না থাকলে এই কওমী শিক্ষা ব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।
কওমী শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এন্টি ইসলাম গ্রুপের অভাব নেই। যারা প্রতিনিয়ত মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী বলে প্রকৃতপক্ষে কওমী আলেমদেরই ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। ফলে এমন একটি বাম ঘেঁষা সরকারের হাত ধরে কওমী মাদরাসার সরকারি স্বীকৃতির চূড়ান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
অপরদিকে সংসদে কওমী স্বীকৃতির আইন পাশ করা ছাড়াই দাওরায়ে হাদীস সমাপ্তকারীদের মাস্টার্স মানের সনদ দেওয়া শুরু করেছে কওমী শিক্ষা কমিশন ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছ, কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের মাস্টার্স মান প্রদান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রন সংস্থা “আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়্যাহর নিজস্ব প্যাডে এ সনদ প্রদান করা হচ্ছে। অথচ এ সংস্থাই সরকারী শিক্ষা সনদ প্রদানে এখনো সরকারি কোনো আইনি অনমোদন পায়নি। যা সংসদের মাধ্যমে আইনি কাঠামোতে পাশ হয়ে আসার কথা ছিল।
কওমী মাদরাসা সংশ্লিষ্ট অনেকেই সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে এমন সনদ প্রদানের বিরোধিতা করে বলছেন, এর মাধ্যমে শিক্ষিত সমাজ ও সরকারের কাছে কওমী মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। সরকারের সাথে কওমী মাদরাসার লিয়াজোঁ কমিটির সঠিকমাত্রায় যোগাযোগের অভাবে স্বীকৃতি নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে কওমী মাদরাসা শিক্ষা কমিশনের প্রভাবশালী ও সরকারের সাথে লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য মুফতি রুহুল আমীনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংসদে আইন পাশের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সরকারের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়েছে কি না আমার জানা নেই।
তিনি লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম সদস্য হওয়া সত্বেও এ ব্যাপারে না জানার বিষয়টি উল্লেখ করলে নিজের অসুস্থতার কথা জানান।
তার মতে, সরকারের ২০১০ শিক্ষা আইনের ৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, কওমী মাদরাসার যে কোনো সিদ্ধান্ত কওমী কমিশন নিতে পারবে। তাই সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কওমী সনদের মান অর্জিত হয়ে গেছে। সংসদে আইন পাশ ছাড়াই দাওরায়ে হাদীস সমাপ্তকারীরা মাস্টার্স মানের সনদ গ্রহণ করে কাজে লাগাতে পারবে। ২০০৬ সনেও তৎকালীন বিএনপি সরকার এমন প্রজ্ঞাপন জারী করেছিল প্রশ্ন করলে তিনি বিষয়টির সদুত্তর দিতে পারেননি।
সংসদে আইন পাশ ছাড়াই কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের মাস্টার্স মান প্রদান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা “আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়্যাহ কেন নিজস্ব প্যাডে সনদ প্রদান করছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি সনদ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, শুধুমাত্র দাওরা হাদীসের পরীক্ষা ও রেজাল্ট প্রদান করা হয়েছে। সনদ দেওয়া হচ্ছে না।
যদিও এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর হাইআতুল উলয়ার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) মাওলানা ইসমাইল বরিশালী আওয়ার ইসলামকে বলেছিলেন, আমরা এক দেড় সপ্তাহ আগে থেকে সাময়িক সনদ বিতরণ শুরু করেছি।
এ ব্যাপারে কওমী মাদরাসা শিক্ষা কমিশনের সদস্য বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মুফতি আব্দুল কুদ্দুসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, সংসদে কওমী স্বীকৃতি পাশের জন্য সরকারের সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। আর কোনো পক্ষ যোগাযোগ করেছে কিনা সেটাও আমার জানা নেই।
আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়্যাহ নিজস্ব প্যাডে সনদ প্রদান করছে কি না জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়টি জানেন না বলে আওয়ার ইসলামকে জানান।
সূত মতে, দওরায়ে হাদীসের মান নিয়ে সংগঠিত হওয়া দেশের বিভিন্ন বোর্ডের সমন্বয়ে আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়্যাহর কার্যত কোনো কার্যক্রম নেই।
১১ জুন সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কওমী মাদরাসার প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ করার পর এখন পর্যন্ত এ সংস্থার স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে কোনো মিটিং বা কার্ম পরিকল্পনা করা হয়নি। এমনকি সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন একাধিক কওমী মাদরাসার আলেমরাও সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা বা সরকারের ইতিবাচক মনোভাব সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে আওয়ার ইসলামকে জানান।
সুতরাং এটা স্পষ্ট, বর্তমান সরকারের আমলে কওমী স্বীকৃতির প্রজ্ঞাপন আর বাস্তবায়নের মুখ দেখছে না। শেষ পর্যন্ত সরকারের এ মেয়াদে হতাশ হতে হচ্ছে কওমী মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের।
এটিও পড়ুন: রোহিঙ্গা সমস্যা: আক্রান্তদের ভবিষ্যত এবং আমাদের করণীয়