আওয়ার ইসলাম : আজ থেকে ৭০ বছর আগে দেশ গঠনের পর থেকে পাকিস্তানের মোট ১৭ জন প্রধানমন্ত্রীর একজনকেও তাদের মেয়াদের নির্ধারিত পাঁচ বছর পূর্ণ করতে দেয়া হয়নি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাগ্যেও তাই জুটল।
পানামা পেপারসের নথি কেলেঙ্কারির পর দুর্নীতির মামলায় সুপ্রিমকোর্ট শুক্রবার তাকে অযোগ্য ঘোষণার পর পদত্যাগ করেছেন নওয়াজ শরিফ। এভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইতিহাসের বারবার পুনরাবর্তন ঘটছে।
১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময় উত্তাল। এ সময়ের মধ্যে স্বৈরশাসকদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়েছে চারবার, একজন প্রধানমন্ত্রীকে গুপ্তহত্যা এবং আরেকজনকে ফাঁসি দেয়া হয়।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্টদের নির্দেশে আরও অনেকেই অবসরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া নওয়াজ শরিফসহ দু’জন প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিমকোর্টের মাধ্যমে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন।
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর হাতে নিহত হন। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এরপর দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের নির্দেশে ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল অবসরে যেতে বাধ্য হন। তারপর আসেন মোহাম্মদ আলী বোগরা। ১৯৫৪ সালে তাকেও সরিয়ে দেন গোলাম মোহাম্মদ। তবে পরে তাকে আবার প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হলেও পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হন তিনি। অতএব ১৯৫৫ সালে তার সরকার ভেঙে দেন গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা।
একই বছর প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ১৯৫৬ সালের নতুন সংবিধান বলে প্রেসিডেন্ট হন ইস্কান্দার মির্জা। ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন মোহাম্মদ আলী।
এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের নেতা নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৬ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
মুসলিম লীগের বাইরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তিনিই প্রথম কোনো ব্যক্তি। কিন্তু ১৯৫৭ সালে ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে মতানৈক্যের জেরে তিনি পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পর ইবরাহিম ইসমাইল চন্দ্রিগরকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন ইস্কান্দার মির্জা। তিনি প্রায় দুই মাসের মতো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি পদত্যাগ করেন।
এরপর ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের ৭ম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরোজ খান নুনকে নিয়োগ দেন। আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন।
তেরো বছরের সামরিক শাসনের পর ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধান পাস হওয়া পর্যন্ত ভুট্টো বিশেষ ব্যবস্থায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধান গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে ভুট্টো প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭৭ সালে তিনি নির্বাচন দেন এবং পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে জেনারেল মোহাম্মদ জিয়াউলি হক এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
১৯৭৯ সালে দেশটির শক্তিশালী বিচার বিভাগের এক রায়ে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। এরপর ১৯৮৫ সালের এক নির্বাচনে স্বৈরশাসক জিয়াউল হকের অধীনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ খান জুনেজো। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তাকে স্বৈরশাসক জিয়াউল হক হুমকি মনে করেন। অতএব ১৯৮৮ সালের ২৯ মে ভেঙে দেয়া হয় মোহাম্মদ খান জুনেজোর সরকার। ওই একই বছর মারা যান স্বৈরশাসক জিয়াউল হক। ফলে ১৯৮৮ সালে একটি সাধারণ নির্বাচিত অনুষ্ঠিত হয়।
গণতান্ত্রিক এ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ১৯৮৮ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন বেনজির ভুট্টো। প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান তার সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার ১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট বেনজির ভুট্টোর সরকার ভেঙে দেন। বেনজির ভুট্টোর পর একই বছর প্রথমবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ।
১৯৯৩ সালে নওয়াজ শরিফের সরকারও ভেঙে দেন গোলাম ইসহাক খান। পরে সুপ্রিমকোর্ট তাকে আবার প্রধানমন্ত্রী পদে বহল করেন। তবে তৎকালীন সেনাপ্রধান ওয়াহিদ কাকার ১৯৯৩ সালের ১৮ জুলাই নওয়াজ শরিফ ও গোলাম ইসহাক খান উভয়কে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
এরপর বেনজির ভুট্টো ১৯৯৩ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে এসে তারই নিয়োগ দেয়া প্রেসিডেন্ট ফারুক লাঘরি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ১৯৯৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের সুবাদে নওয়াজ শরিফ দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। তবে ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ দেশে সেনাশাসন ঘোষণা করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
এরপর তিনজন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের অধীনে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে মির জাফরুল্লাহ খান জামালি দায়িত্বে ছিলেন মাত্র ১৯ মাস এবং ২০০৪ সালে মোশাররফের বন্ধু শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত মাত্র ২ মাস দায়িত্ব পালন করেন চৌধুরী সুজাত।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ইউসুফ রাজা গিলানি। সুপ্রিমকোর্টের এক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২০১২ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন গিলানি।
এরপর ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাজা পারভেজ আশরাফ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। নিজের মেয়াদ পূর্ণ করার প্রায় ১ বছর আগে দুর্নীতির অভিযোগ সুপ্রিমকোর্টে অযোগ্য ঘোষিত হয়ে পদত্যাগ করলেন নওয়াজ শরিফ।
-এজেড