শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


নূরানী পদ্ধতি: কুরআন শিক্ষায় বিপ্লবের ইতিহাস

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাসান আল মাহমুদ, প্রতিবেদক, আওয়ার ইসলাম
শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে বাংলাদেশের সর্বত্র চালু রয়েছে বিশুদ্ধ কুরআন শেখার এক অভিনব পদ্ধতি।  তার নাম 'নূরানী পদ্ধতি'। 'নূরানী পদ্ধতি শিক্ষা' বাংলাদেশের শিক্ষা জাগরণের এক অবিস্মরণীয় নাম। ইতিহাসের নতুন এক পাঠ । এক সময়ে ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞানার্জনে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান তথা পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল মকতব কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু একটি স্বতন্ত্র সিলেবাস, সহজ পদ্ধতিতে ইসলামের প্রাথমিক ও আবশ্যকীয় জ্ঞানের পাঠশালা গড়ে ওঠে 'নূরানী পদ্ধতি' শিক্ষার মধ্য দিয়ে। যার ফলে হিফজ বিভাগ, কিতাব বিভাগের সাথে যুক্ত হয় স্বতন্ত্র সিলেবাসে নূরানী বিভাগও। বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোথাও এ নামে পূর্বে কোনো শিক্ষা পদ্ধতি ছিল না।

ষাটের দশকে নুরানী শিক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। হজরত হাফেজ্জী রহ. প্রতিষ্ঠিত কামরাঙ্গীচরের জামিয়া নুরিয়া মাদরাসায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্ব প্রথম নূরানী শিক্ষা-পদ্ধতি বাস্তবায়ন হয়। পরবর্তীতে তাঁরই সহযোগিতায় একজন দানবীরের কল্যাণে ১৯৮১ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজস্ব জায়গায় 'নূরানী তা'লীমুল কুরআন বোর্ড' নামে প্রতিষ্ঠিত হয় নুরানী শিক্ষা-পদ্ধতির প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম।

বর্তমানে নূরানী শিক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে একটি স্বতন্ত্র বোর্ডও গঠিত হয়েছে। এ বোর্ডের কার্যক্রম যথাক্রমে তিনটি।

এক. শিক্ষক প্রশিক্ষণ
এ কার্যক্রমের অধীনে সারা দেশে স্থায়ী ট্রেনিং সেন্টার বা মারকায ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মৌসুমি-অমৌসুমি, স্বউদ্যোগে শিক্ষকদের মানোন্নয়নে ট্রেনিং কোর্সের ব্যবস্থা। ট্রেনিংয়ে অংশ গ্রহণ করে যে কেউ অর্জন করতে পারে নূরানী শিক্ষকতার যোগ্যতা। হাতে পান নূরানী সার্টিফিকেট। সারা দেশের যে কোনো দীনি প্রতিষ্ঠানে এ সার্টিফিকেটের বিশেষ মূল্যায়ন।

এছাড়া, সারাদেশের নূরানী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মানোন্নয়নে অনুষ্ঠিত হয় ষাণ্মাসিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মশালা। প্রতিবছর পুরাতন শিক্ষকদের নিয়ে জেলায় জেলায় অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা।

দুই. সারা দেশে নূরানি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের আটষট্রি হাজার গ্রামে আটষট্রি হাজার নূরানী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে জন্ম নেয়া নূরানী তা'লীমুল কুরআন বোর্ড বাংলাদেশ সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যাতে নূরানী শিক্ষার আলো অনায়াসে পৌঁছে যায় সে লক্ষ্যপানে ছুটে চলেছে অবিরাম। বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ সারা দেশে করেন সফর। কোথাও নূরানী প্রতিষ্ঠান থাকলে তার মানোন্নয়নে চালান প্রচেষ্টা। কোথাও নূরানী শিক্ষার আলো না থাকলে সেখানে এ আলো ছড়িয়ে দিতে স্থানীয়দের সহযোগিতায় নেন বাস্তবায়নের নানা উদ্যোগ।
এছাড়া, সারাদেশের নূরানী মাদরাসাগুলোতে ভিজিট করেন বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ।

তিন. বয়ষ্ক শিক্ষা
এ কার্যক্রমের অধীনে সারা দেশের বিভিন্ন মসজিদে চাহিদা ভিত্তিক নুরানী তা'লীমুল কুরআন বোর্ড কর্তৃক প্রশিক্ষিত শিক্ষকমণ্ডলী দ্বারা সাধারণ মুসলমানদের (বয়ষ্ক) সহজ নুরানী পদ্ধতিতে 'কুরআন শিক্ষা প্রশিক্ষণ' কোর্সের আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। সমাজের সর্বস্তরের মুসলমানগণ এ কোর্সে অংশ গ্রহণ করে সহজ পদ্ধতিতে শিখতে পারে কুরআনসহ ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান।

নূরানী পদ্ধতির মূল্যায়নে মনীষীগণ
নূরানী পদ্ধতি শিক্ষার প্রবর্তক হচ্ছেন হজরত মাওলানা ক্বারী বেলায়েত হুসাইন। তিনিই এই অভিনব শিক্ষা ব্যবস্থার আবিষ্কার করেন। 'নূরানী পদ্ধতি' নামে কোনো শিক্ষা পদ্ধতি ইতিহাসের কোনো পাঠে ছিলই না। তিনিই সেই ইতিহাসের পাঠোদ্ধারের নায়ক। সারা বাংলাদেশে নূরানী মাদরাসা নামে সকল প্রতিষ্ঠান তাঁর আবিষ্কৃত শিক্ষা পদ্ধতির আলোকেই গড়ে উঠেছে। তাঁর আবিষ্কৃত নূরানী পদ্ধতি শিক্ষা নিয়ে সে সময়ের আলেম শিক্ষাবিদগণ উচ্চ প্রশংসা করেন এবং তা সাদরে গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এই শিক্ষা ব্যবস্থা। শহরে-বন্দরে,গ্রামে-গঞ্জে গড়ে উঠে 'নূরানী মাদরাসা'।

এ পদ্ধতিতে শিক্ষা অর্জন নিয়ে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. বলেন, 'মাওলানা বেলায়েত হুসাইন সাহেব দীর্ঘ দিনের সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মক্তব শিক্ষার এই নতুন পদ্ধতি চালু করিয়াছেন। আমার জানামতে এই পদ্ধতিতে তা'লীম হাসিল করা অত্যন্ত সহজ এবং বেশি ফলদায়ক'।

তিনি আরও বলেন, 'আমি মনে করি প্রতিটি মুসলমানের ঘরে ঘরে এই শিক্ষা চালু হওয়া উচিত এবং ইহার প্রচার-প্রসারের জন্য সকলের সার্বিক চেষ্টা ও সহযোগিতা করা একান্ত'।

নূরানী পদ্ধতির মূল উপাদান 'নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা' বইটি সম্পর্কে তিনি বলেন 'ইহা তাহার সুদীর্ঘ জীবনের নিরলস সাধনার এক সার্থক ও মহা মূল্যবান সারাংশ'।

এই বই সম্পর্কে হজরত মাওলানা আতহার আলী রহ. বলেন, 'নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা’ বইটি দেখার সুযোগ পাইয়াছি। যাহাতে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয় পঠনমূলক বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, যাহা দেখিয়া আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি এবং আন্তরিকভাবে দু'আ করিতেছি। তাহার উপকারিতা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ হউক। আম-খাছ সর্বস্তরে মকবুল হউক'।

খতিবে আযম হজরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রহ. বলেন, ‘স্বল্প সময়ে বিশুদ্ধভাবে কুরআন পাঠের উপায় হিসাবে কুরআন শিক্ষায় 'নূরানী পদ্ধতি' বাস্তবিকই একটি উন্নত পদ্ধতি। আমি এই পদ্ধতির উপকারিতা স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়াছি। এই পদ্ধতির কল্যাণে ছোট ছেলেমেয়েরা মাত্র এক বৎসরে আলিফ-বা হইতে শুরু করিয়া কুরআন শরীফের বিশুদ্ধ পঠন এবং তৎসঙ্গে জরুরী মাসআলা-মাসায়েল ও দু'আ-দরূদ আত্মস্থ করিতে সক্ষম হয়। এই পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রদর্শনী আমি স্বয়ং দর্শন করিয়া ইহার আশ্চর্যজনক উপকারিতা প্রত্যক্ষ করিয়াছি'।

কুরআনের পাখি কারী উবায়দুল্লাহ

বাহাস এড়াতে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর নতুন কৌশল

'নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা' বইয়ে পেশ কলাম লিখেন মাসিক মদীনা সম্পাদক প্রয়াত আলেম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ:। তাতে তিনি বলেন -'আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাহন বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য বহুতর বৈজ্ঞানিক পন্থা ও প্রক্রিয়ার আবিষ্কার হইয়াছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং অতি সহজে শিক্ষার্থীগণকে পঠন প্রণালী আয়ত্ব করার এমন সব ব্যবস্থা করা হইয়াছে,যা দেখিয়া রীতিমত অবাক হইতে হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপেরর বিষয়, কুরআনের ভাষা এবং পঠন প্রণালী আয়ত্ব করার জন্য আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত কোনো প্রকার সন্তোষজনক ব্যবস্থা হয় নাই। ছয়-সাত শত বৎসেরর পুরাতন পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ শিশুকে সুর করিয়া পাঠ এবং কুরআন তিলাওয়াতের অনুশীল করিতে দেখা যায়। কিন্তু পাঁচ ছয় বৎসর প্রাণান্তকর পরিশ্রম করিয়াও কুরআন শরীফ শুদ্ধ করিয়া পাঠ করার যোগ্যতা অর্জিত হয় না।.. সুখের বিষয় আজকাল সমাজের এই মারাত্মক অভাবটির প্রতি কিছু সংখ্যক বিজ্ঞ আলেমের দৃষ্টি আকৃষ্ট জইয়াছে। সহজ পদ্ধতিতে কুরআনের ভাষা শিক্ষাদান, অক্ষর পরিচয় হইতে শুরু করিয়া উচ্চারণ তথা সাবলীল পাঠ অভ্যাস পর্যন্ত শিক্ষাদানের একটি উন্নততর পদ্ধতি উদ্ভাবিত হইয়াছে। 'নূরানী পদ্ধতি' নামে এই পদ্ধতি পরিচিত। এই পদ্ধতিতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যও চলিতেছে। সাধক আলেম, কুরআন পাকের একনিষ্ঠ খাদেম, মাওলানা ক্বারী বেলায়েত হুসাইন সাহেব এই পদ্ধতিতে মুআল্লিম ট্রেনিং (শিক্ষক প্রশিক্ষণ) ব্যবস্থারও প্রবর্তন করিয়াছেন'।

হজরত মাওলানা ক্বারী বেলায়েত হুসাইন আবিষ্কৃত নূরানী পদ্ধতি শিক্ষার আবির্ভাব ঘটেছে মূলত একজন মুসলমান যাতে সহজ পন্থায় কুরআন মাজিদ শিখতে ও ইসলামের আবশ্যকীয় জ্ঞান অর্জন করতে। পরবর্তীতে তাতে বাংলা, অংক, ইংরেজি ইত্যাদি জেনারেল শিক্ষার প্রয়োজনীয় বিষয় সংযুক্ত হয়ে এ শিক্ষা ব্যবস্থাপনাটি একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থায় রূপ লাভ করে। সহজ পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা, ইসলামের আবশ্যকীয় জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি যুগোপযোগী জেনারেল শিক্ষা সংযুক্ত হওয়ায় সর্ব সাধারণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। নূরানী তা'লীমুল কুরআন বোর্ড কর্তৃক প্রণীত সিলেবাসে সারা দেশে জানুয়ারি টু ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে একটি স্বতন্ত্র সিলেবাসে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠদান। এ সিলেবাসে ১ম শ্রেণী থেকে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত নূরানী পদ্ধতিতে লেখা-পড়া করে একটি শিশু মাদরাসা ও স্কুলের যে কোনোধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তির যোগ্যতা লাভ করে।

বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক শিক্ষা ‘নূরানী পদ্ধতি শিক্ষা’র আবিষ্কার কিভাবে হল, কিভাবে বেড়ে উঠলো ইত্যাদি নানা বিষয় জানতে চোখ রাখুন ourislam24.com এ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ