মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


২৪দিন পর মায়ের কোলে সুমাইয়া

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মায়ের চক্ষু শীতল করে ফিরে এসেছে সুমাইয়া । গত ২ এপ্রিল কামরাঙ্গীর চর ভাড়া বাসা থেকে অপহৃত হয় শিশু সুমাইয়া। এরপর টানা ২৪দিন নিখোঁজ ছিল সে। প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে সুমাইয়ার মা মুন্নি এবং বাবা জাকির হোসেন পাগল প্রায়।

পুলিশের দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে ২৪ দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার কদমতলী থেকে উ্দার করা হয় সুমাইয়াকে। গ্রেফতার করা হয় অপহরণকারী সাবিনা আক্তার বৃষ্টি (২৮) ও তাঁর বাবা সিরাজ মিয়া ওরফে বাবুল মিয়াকে।

সুমাইয়ারা এখন যে বাসায় থাকে একসময় সেই বাসায়ই ভাড়া থাকতেন বৃষ্টি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের মাধ্যমে তাঁদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। সুমাইয়াকে ভারতে পাচার করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছেন বৃষ্টি।

সুমাইয়া উদ্ধার হওয়ার পর তাদের বাসার আশপাশে কামরাঙ্গীর চরের বড়গ্রাম এলাকায় রীতিমতো উৎসব হয়েছে। এলাকাবাসীই মিষ্টি বিতরণ করেছে।

এর আগে উদ্ধারের পরপরই সুমাইয়াকে পুরান ঢাকার লালবাগ থানায় নেওয়া হয়। খবর পেয়ে থানায় গিয়ে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরেন মা-বাবা। থানায় মা-বাবাকে পেয়ে শিশু সুমাইয়াও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শী এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন এ তথ্য।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সুমাইয়া মা-বাবাকে কাছে পেয়েই বলে ওঠে, ‘আব্বু আম্মু আসছ, আমাকে তোমরা খুঁজছিলে। ’

সুমাইয়ার দেওয়া তথ্য জানিয়ে পরে তার মা-বাবা জানান, অপহরণের পর সুমাইয়াকে মারধর করা হয়। হাতে সুচও ফোটানো হয়েছিল।

সুমাইয়াকে উদ্ধারের ঘটনায় গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ দপ্তরে ব্রিফিং করা হয়। এতে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইব্রাহিম খান বলেন, সুমাইয়াকে ভারতে পাচারের পরিকল্পনা করেছিলেন বৃষ্টি। এরই মধ্যে বৃষ্টির একাধিকবার ভারতে যাওয়া-আসার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আরো কয়েকজন জড়িত আছে। এরা সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণকারী চক্রের সদস্য।

গতকাল সুমাইয়া ও তার মা-বাবাকে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আনার পর সুমাইয়া কিছুক্ষণ পরপরই মাকে চুমু দেয় আর বলে, ‘মা, আমাকে চুমু দাও। ’ এ সময় হাসিমুখে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদরে ভরিয়ে দেন মা। তখন মা-বাবার চোখে আনন্দাশ্রু, মুখে হাসি। মা-বাবার মুখে হাসি দেখে ছোট্ট সুমাইয়ার মুখটাও হাসিতে ভরে যায়। সুমাইয়া মাকে বলে, ‘আমি তোমাদের জন্য অনেক কেঁদেছি। ’

২৪ দিন পর মায়ের কোলে সুমাইয়াসুমাইয়া বলে, ‘জান মা, বৃষ্টি আমাকে জোর করে মা বলতে বলত, আমি বলিনি, তাই মেরেছে। ’  মেয়ের এই কথা শুনে মা-বাবা চোখ ভিজে যায়।

পুলিশের লালবাগ বিভাগের ডিসি ইব্রাহিম খান বলেন, কদমতলীর জনৈক কামালের বাড়িতে সুমাইয়া আছে বলে তথ্য পান তাঁরা। এরপর গতকাল ভোররাত ৪টার দিকে তাঁরা ওই এলাকার সব বাড়ি ঘিরে ফেলেন। সুমাইয়াকে অপহরণকারী বৃষ্টিকে আগে থেকে চেনেন এমন তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে কামালের বাড়িতেই সুমাইয়ার অবস্থান নিশ্চিত হন তাঁরা। সকালে তাঁরা শিশুটিকে উদ্ধারের চূড়ান্ত অভিযান শুরু করেন। তখন শিশু সুমাইয়া ঘুমাচ্ছিল। ওই বাড়িতে ঢুকেই শিশু সুমাইয়াকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে তুলে নেন তিনি। সুমাইয়াকে উদ্ধারের পর বৃষ্টি ও তাঁর বাবাকে আটক করা হয়। পরে মা-বাবাকে থানায় ডেকে এনে সুমাইয়াকে তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

অপহরণের ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে সুমাইয়ার মা মুন্নী আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমি বিকেলে বিছানায় বসে কোরআন শরিফ পড়ছিলাম। বৃষ্টি বাড়িওয়ালার খোঁজ করে। পরে বারান্দার মেঝেতে বসে সুমাইয়ার সঙ্গে কথা বলে। আমি বুঝতেও পারি নাই তার মনে এসব ছিল। ’ মুন্নী আক্তার বলেন, ‘আমি কোরআন শরিফ পড়ছিলাম বলে বৃষ্টি নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আমি কোরআন শরিফ পড়া শেষে মেয়েকে ডাকাডাকি করি। ওর সাড়া না পেয়ে রাস্তায় গিয়ে খুঁজি। তখনই আমার সন্দেহ হয়। ’

জানতে চাইলে সুমাইয়ার বাবা জাকির হোসেন বলেন, সুমাইয়াকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হবে।

সুমাইয়াদের বাড়িওয়ালি হাসনা হেনা বলেন, সুমাইয়া খুব চঞ্চল প্রকৃতির ও মিশুক। মিষ্টি চেহারার  মেয়েটির জন্য সবার মন খারাপ হয়ে ছিল। সুমাইয়া উদ্ধার হওয়ার পর এখন তাঁরা সবাই স্বস্তিতে আছেন।

বাড়িওয়ালি জানান, এর আগে বৃষ্টি ওই বাসায় স্বামীর সঙ্গে ভাড়া থাকতেন। গত বছরের রমজান মাসে তিনি বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।

সুমাইয়া উদ্ধার হওয়ার পর যেন উৎসব শুরু হয়েছে বড়গ্রাম এলাকাবাসীর মধ্যে। সুমাইয়াদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ আলী নামের এক প্রবীণ বলেন, ‘সুমাইয়া আমাগো অনেক আদরের আছিল। এতটুকু বাচ্চারে যে মাইয়া অপহরণ করেছিল তার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। ’

আমেনা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘মাইয়াডা কী হাসিখুশি! কত কথা কয়। মনে হয়, সারাক্ষণ ওর কথা হুনি। যে বেটি এই সুন্দর বাবুরে অপহরণ করছিল তার যেন কুড়ি বছর জেল হয়। ’

সুমাইয়া অপহরণের তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য গতকাল দুপুরে কামরাঙ্গীর চর থানার উপপরিদর্শক রাজিবুল ইসলাম আটক বৃষ্টি ও তাঁর বাবাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। মহানগর হাকিম প্রণব কুমার তাঁদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সুমাইয়ার বাবা জাকির হোসেন স্টিল কারখানার কর্মচারী এবং মা মুনিয়া বেগম গৃহিণী। গত ২ এপ্রিল সুমাইয়া অপহৃত হয়। এরপর এলাকায় মাইকিং করে তার পরিবার। এলাকায় পোস্টারও সাঁটা হয়। সুমাইয়ার বাবা জাকির হোসেন ২৪ এপ্রিল কামরাঙ্গীর চর থানায় অপহরণের মামলা করেন। নিখোঁজ হওয়ার ২২ দিন পর পুলিশের সব কটি বাহিনী সুমাইয়ার খোঁজে মাঠে নামে। কয়েক দিন আগে সুমাইয়াদের বাসার পাশের একটি বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যায়। তাতে দেখা গেছে, বাসার সামনে থেকে সুমাইয়া কালো বোরকা পরা এক নারীর হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ