শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

হারিয়ে যাওয়া কিশোর যোদ্ধারা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
গল্পকার

galpaপুকুর পাড়ের জামগাছটায় এ বছর প্রচুর পরিমাণে জাম ধরেছে। জামের ভারে নুয়ে পড়েছে গাছের ডালগুলো। কামাল, মফিজ, সালেহারা সারাদিনই গাছতলায় ভিড় করে থাকে। আমি ওদের নির্লজ্জ বলে যতোই বকাঝকা করি না কেন ওদের যেন গায়েই লাগে না। আজকেও ওরা এসেছে জামগাছ তলায়। আমি ওদের অপমানিত করার জন্য বললাম-
তোরা রোজ রোজ অামাদের বাড়িতে অাসিস কেন? তোদের লজ্জা লাগে না? জাম খাওয়ার শখ হলে কিনে খেতে পারিস না?
বাঁকা হাসি দিয়ে কামাল বলল- মাগনা পাইলে কিননা খামু ক্যান?

ওর কথা শুনে রাগে আমার গা জ্বলে ওঠল। তাই সোজা বলে দিলাম- এটা কি তোর বাবার গাছ?
এমন সময় আম্মা ডাক দিলেন- জামিল... ভাত খেতে আয়।
আসছি আম্মা...।

আম্মা পুঁটিমাছ দিয়ে চালকুমড়ো রেঁধেছেন। কিন্তু আমিতো পুঁটিমাছ খেতে পারি না। তাই মুখ ভার করে বসে আছি। আম্মা জিজ্ঞেস করেন-
কিরে খাচ্ছিস না কেন?
আম্মা! তুমি কী জানো না আমি পুঁটিমাছ খাই না?
আজ কষ্ট করে খেয়ে নে বাবা। কাল তোর জন্য বাজার থেকে বড় রুই মাছ অানাবো।
না, অামি পুঁটিমাছ খাবো না। অামাকে দুধ দাও।
দুধ পাবো কোথায়?
কেন সেজো দাদু দিয়ে যাননি?
তোর সেজো দাদু তো গতকালকেই ইন্ডিয়া চলে গেছেন।
ইন্ডিয়া গেলেন কেন?
দেশের অবস্থা যে ভালো না, সে জন্য।
ও! আমিতো ভুলেই গেছি দেশে এখন যুদ্ধ চলছে। আচ্ছা আম্মা! ওরা আমাদের শুধু শুধু মারতে এলো কেন?
কারণ ওরা জালেম।
জালেম মানে কী?
জালেম মানে হলো যারা ক্ষমতার দাপটে, গায়ের জোরে নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার করে, তাদের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেয়, দুর্বলদের সহায়সম্পত্তি আত্মসাৎ করে, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করে ইতিহাস তাদেরই জালেম বলে।
তাহলে ওদের কি কোনো বিচার হবে না?
হবে বাবা হবে।
কিন্তু কবে?
যেদিন তুই এদেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে পারবি, সেদিনই হবে ওদের সঠিক বিচার।
আমি! আমি কী পারবো?
পারতে তোকে হবেই। এ যে তোর বাবার স্বপ্ন।
বাবার স্বপ্ন!
হ্যাঁ, স্বাধীনতা তোর বাবার স্বপ্ন। তোর মায়ের স্বপ্ন। সকল বাঙ্গালীর স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণের জন্যইতো তোর বাবা...
আম্মা আর কিছু বলতে পারলেন না
আঁচলে চোখ মুছে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন।

***
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।
পশ্চিমাকাশে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের রক্তিমাভা। মৃদু বাতাসে ঢেউ ওঠেছে বুড়িগাঙ্গের তীরঘেঁষা সাদা কাশবনে। বুড়িগাঙ্গ এখন বর্ষার পানিতে থৈ থৈ। এখান থেকে অামাদের বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। আমি কাশবনের আল দিয়ে হেটে চলছিলাম আপন মনে। হঠাৎ গণমানুষের চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ালাম। চিৎকারটা দেখছি অামাদের বাড়ি থেকেই আসছে। মুহূর্তেই জ্বলে ওঠলো আমাদের দু'চালা টিনের ঘরটি। জ্বলে পুরে ভস্ম হতে থাকে প্রয়াত দাদুর এই শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু। তাহলে আম্মু কোথায়? আম্মু ঠিক আছেতো? আমি বাড়ির পথে দৌর দিতে গিয়ে বুঝতে পারি কে যেন আমার হাত ধরে রেখেছে। পেছন ফিরে দেখি কাশেম চাচা। চাচা কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলেন-
গেরামে মিলিটারি ঢুকছে। বেবাক মানুষরে গুলি কইরা মাইরা ফেলছে। অহন গেরামে যাওন যাইবো না। ওই দেখ ঘাটে মিলিটারির নৌকা বাঁধি রাখছে।

কাশবনের যে জায়গাটায় এখন দাঁড়িয়ে আছি তার থেকে মাত্র একশ গজ দূরে বাঁধা রয়েছে মিলিটারি নৌকাটা। নৌকায় দুইজন পাকসেনা বসে বসে গল্প করছে। চাচা আমাকে চুপচাপ বসে থাকার নির্দেশ দিয়ে নৌকার দিকে এগিয়ে গেল। আমার মাথায় খুন চেপে যায়। পায়ের কাছেই পেয়ে গেলাম অর্ধভাঙা একটা ইট। দ্রুত হাতে তুলে নিলাম। তারপর কাল বিলম্ব না করে একজন সেনাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম। ব্যস কেল্লা ফতে। সঙ্গে সঙ্গে বেটা চিতপটাং। ওদিকে অপর সেনাটি পেছন ফিরে তাকাতেই কাশেম চাচা তার হাতের বৈঠা দিয়ে কষে এক ঘাঁ মেরে বসলেন। ওই নরাধমও গাঙে পড়ে নাকানিচোবানি খেতে থাকল। আমি আর এক মুহূর্তও দেরি না করে কাশবনের পাশ ঘেঁষে ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে হাপিয়ে ওঠলে পেছন ফিরে তাকালাম ওরা আসছে কি না তা দেখার জন্যে। না, কাউকেই দেখা গেল না। একটু দম নিয়ে চারদিকে ভালো করে তাকাতেই ভয়ে শিউরে ওঠি। এ কোথায় চলে এলাম? চারদিকে কেমন বিদঘুটে অন্ধকার। বিশালাকার গাছগুলো দেখে বুঝে নিলাম এ নিশ্চয় কোনো গভীর জঙ্গল। ভয়ে গা কেমন ছমছম করে ওঠে। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে অামার কাধে হাত রাখল। ভয়ে অামি অাৎকে ওঠি। পেছন ফিরে দেখি দু'জন লোক দাঁড়িয়ে অাছে। তাদের একজন অামাকে অভয় দিয়ে বলে-
ভয় পেয়ো না। অামরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।
অন্যজন বলল-
তোমার বাড়ি বোথায়? কোথা থেকে এসেছো?
কিন্তু আমি তাদের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকলাম।

***
প্রায় চারমাস হলো মুক্তিবাহিনীতে এসেছি। সেদিন যে দু'জন লোক অামাকে জঙ্গল থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন তারা হলেন রাজু ভাই ও বিনুদা। এ কয়েকমাসের ট্রেনিংয়ে অামি অনেক কিছুই শিখে নিয়েছি। কাজও করেছি টুকটাক। এই যেমন, সারা দিন টু টু করে ঘুরে বেড়িয়ে শত্রুদের খবরাখবর সংগ্রহ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রু ক্যাম্পে মাইন পুঁতে দেয়া।

আমাদের কমাণ্ডার ছিলেন আবু সালেহ ভাই। তিনি একদিন সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে বসলেন। সবার মনোযোগ অাকর্শন করে বললেন-
মাতৃভূমি রক্ষার তরে জীবন উৎসর্গকারী সহযোদ্ধা ভাইয়েরা অামার! অামরা দেশের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছি। বিসর্জন দিয়েছি পরিবার পরিজন। তাই আমাদের পেছনে তাকাবার সময় নেই। আমাদেরকে বীরদর্পে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে হবে। আপনারা হিম্মত হারাবেন না। বিজয় আমাদের হবেই ইনশাআল্লাহ। সেদিন অারো অনেক প্রসঙ্গেই কথা হয়েছে। আলোচনা শেষে আমরা খেতে বসি। খাবার খেতে খেতে আমি বিনুদাকে বললাম-
আচ্ছা বিনুদা! তুমিতো দারুণ ছবি আঁকতে। যুদ্ধের পর কি আবারো ছবি আঁকা শুরু করবে?
হ্যাঁ, আর প্রথমেই তোর একটা ছবি আঁকবো। তোর এক হাতে থাকবে মেশিনগান আর অন্য হাতে থাকবে লাল সবুজের পতাকা। ভেবে দেখ কেমন লাগবে তখন!
সত্যিই! তোকে অনেক সুন্দর লাগবে জামিল!
হাশেম চাচা বিনুদার কথায় যোগ দিয়ে বললেন। অামি কিছুটা গর্ববোধ করে হাশেম চাচাকে বলি-
লাগবেইতো। আমিওতো তোমাদের মতোই একজন যোদ্ধা। তাই নয় কি?
নূরনবী ভাই অামার কাধ চাপড়ে বললেন-
মনে রাখিস জামিল! যুদ্ধেরর পর অামার প্রথম উপন্যাসটা কিন্তু তোকে নিয়েই লিখবো। বইয়ের নাম হবে কী জানিস?
আমি জানতে চাইলাম-
কী?
নূরনবী ভাই কেমন একটা উদাস ভঙ্গিমায় বললেন-
'একাত্তরের দিনগুলো'। এ বইয়ের পাতায় পাতায় থাকবে আমাদের যুদ্ধের দিন রাতের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার অমলিন স্মৃতিগুলো।

পরদিন অামরা কুসুমপুরে রওয়ানা হলাম। খবর এসেছে অাজ সেখানে পাকবাহিনী আস্তানা গাড়তে আসছে। এই প্রথম আমিও রাজু ভাইদের সাথে এল এমজি হাতে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করছি। আমরা শত্রুক্যাম্পের চারপাশে পজিশন নিয়ে রাতের আঁধার ঘন হওয়ার অপেক্ষা করছি। শত্রুরা ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। যে দু'চারজন পাহাড়ায় নিয়োজিত তাদের চোখেও ঘুম ভর করে অাছে। রাতের দ্বিপ্রহরে কমাণ্ডার সিগনাল দিতেই আমরা একযোগে হামলা চালালাম। অল্পক্ষণের মধ্যে শত্রুরাও গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। এল এমজির ঠা ঠা গর্জনে রাতের নিরবতা ভেঙে খান খান। শত্রুদের গুলিতে হামিদ চাচা আর রাজু ভাই শহীদ হয়েছেন। গ্রেনেড ছুড়তে গিয়ে অামারও একটা হাত চলে যায়। পুরো রাতভর চলল এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। শত্রুদের একজনও বাকি নেই। মৃত্যুদূত তাদের সবাইকে স্ব স্ব স্থানে পৌছে দিয়েছে।

রাজু ভাই আর হামিদ চাচাকে হারিয়ে আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। সবার চোখেই বাঁধভাঙা ঢেউ। তবে এতো কষ্টের মাঝেও আশার কথা হলো বিজয় আমাদেরই হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এমনই বিজয়ের সংবাদ একের পর এক আসতে থাকলে আনন্দে আমরা আত্মহারা হয়ে ওঠি। সবশেষে আসে ১৬ই ডিসেম্বর। লক্ষ লক্ষ শহীদের জীবন উৎসর্গ অার মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পাই একটা লাল সবুজের পতাকা। পাই কাঙ্খিত স্বাধীনতা।

যুদ্ধ শেষে যে যার বাড়িতে ফিরে যায়। এরই মধ্যে প্রস্তুত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। কিন্তু সে তালিকায় খুঁজে পাওয়া গেল না আমার মতো কিশোর যোদ্ধার নাম। বিনুদারও অার অাঁকা হলো না সেই ছবিটি, যে ছবিতে অামার এক হাতে থাকার কথা ছিল মেশিনগান অার অন্য হাতে লাল সবুজের পতাকা। এমনিভাবে নূরনবী ভাইও হয়তো ভুলে গেছে অামার মতো এক কিশোর যোদ্ধাকে। তাই তার প্রথম উপন্যাস 'একাত্তরের দিনগুলো'র কোনো এক পাতায় ঠায় পেলো না আমার একটুকরো স্মৃতি। এভাবেই হয়তো হারিয়ে গেছে অামার মতো আরো অসংখ্য কিশোর মুক্তিযোদ্ধারা।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ