প্রকাশনা জগতের অন্যতম নাম সাহস পাবলিকেশন্স। প্রকাশনাটির বয়স আট বছর হলেও ছোট-বড় সবার উপযোগী বই প্রকাশ করে আলোচনায় এসেছে। নিখুঁত, সুন্দর,পরিপাটি মুদ্রণ, বিষয়-বৈচিত্র আর আভিজাত্যের ছাপ থাকায় প্রকাশনাটি সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। প্রবীণ, প্রথিতযশা লেখকদের পাশাপাশি তরুণ ও নবীণ লেখকের বইও প্রকাশ করে দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেন প্রকাশনাটির স্বত্ত্বাধিকারী নাজমুল হুদা রতন। তিনি শুধু একজন প্রকাশকই নন খ্যাতিমান লেখকও। সাহস রতন নামে কলাম লিখেন বিভিন্ন দৈনিকে। পাদুকার পদচিহ্ন, সে ও মিশিনা নামে তার দুটি উপন্যাস সমাদৃত হয়েছে পাঠক মহলে। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবারের ২০১৭ একুশে মেলার নতুন বইয়ের সংখ্যা ৩২টি। প্রকাশনা, বইমেলা, পাঠক ও শিল্পের নানান বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন আওয়ার ইসলামের প্রতিবেদক হাসান আল মাহমুদ।
সাহস পাবলিকন্স কাদের বই সাধারণ বেশি প্রকাশ করে?
প্রবীণ, তরুণ, নবীণ ও সবার উপযোগী সব ধরনের ব-ইই প্রকাশ করে, তবে তরুণরা এখানে প্রাধান্য পায় সবসময়। আমাদের এ প্রকাশনা মূলত তরুণ লেখকদেরই এক ধরনের আশ্রয়স্থলের মত।
তরুণদের বই বেশি করেন কেন? অন্যরা তো তেমন করে না।
না, অন্যরা করে না এটা ঠিক না। অন্যরাও করে। কিন্তু আমাদের এখানে হয়তো একটু বেশি। আমরা তরুণদের অগ্রাধিকার দেই। এজন্য দিই যে, তরুণরাইতো আগামী গড়বে। তাদের হাতেই ভবিষ্যত পৃথিবী। সুতরাং তারা যেন এগিয়ে যায় একটা ভরসা পায় সেটা আমাদের দায়িত্ব।
তরুণদের বই করে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
দুই ধরনের সাড়াই পাচ্ছি। ভালো সাড়াও পাচ্ছি, খারাপ সাড়াও পাচ্ছি। এটা নির্ভর করে সেই তরুণ লেখকের সাহিত্য মানের উপর। তার লেখনি গাঁথুনির উপর।
এবারের মেলায় সাহস থেকে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে কোন বইটা বেস্ট সেলার?
আমাদের তিন-চারটা বই বেস্ট সেলার হচ্ছে এ মেলায়। তার মধ্যে এক নম্বরে আছে আহাসান রনি সম্পাদিত ২২জন তরুণের নির্বাচিত অনুপ্রেরণার গল্প সংকলন 'দেখা হবে বিজয়ে'। সাজেদুল ইসলাম শুভ্র’র 'সব গল্পের শিরোনাম এক'। তারপর আছে রোকন রাইয়ানের 'সুখিয়া' উপন্যাস।
এগুলা কি বেস্ট সেলারের সিরিয়াল অনুযায়ী বলছেন?
হ্যাঁ, আপনি বেস্ট সেলারের সিরিয়ালই ধরতে পারেন।
তরুণদের বই করে কখনো কোনো হতাশাবোধ কাজ করে?
আমি আসলে বিশ্বাস করি যেটা, শুরু থেকেই সাহস পাবলিকন্স তরুণদেরই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। চাইলেই সব তরুণের বই আমরা করতে পারি না। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু তারপরও আমরা সেসব তরুণকে প্রাধান্য দেই, যার মধ্যে সত্যি সত্যি এগিয়ে যাওয়ার মতো কোয়ালিটি আছে। হতাশার কিছু রাখি না।
আচ্ছা, এবার প্রকাশিত যেসব বই তুলনামূলক কম বিক্রি হচ্ছে আগামী বছরেরর বইমেলায় তাদের বই প্রকাশ করবেন?
হ্যাঁ,করবো। যেমন একটা বই একজন নবীন লেখকের। জীবনের প্রথম বই। তার যদি সেরকম চাহিদা ও ইচ্ছা থাকে তাহলে অবশ্যই করবো। এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে রাখি, এটা আমাদের অষ্টম মেলা। প্রতি বছরই সাহস পাবলিকন্স থেকে সাত-আট-দশজন এমনকি ১৪জন পর্যন্ত হয়েছে এক মেলায়। ১৪ জনেরই জীবনের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে সাহস থেকে। এবারও ছয়জন নবীন লেখক এসেছে যা তাদের জীবনের প্রথম বই। এখন তাদের মধ্য থেকে যদি কারো পাণ্ডুলিপি আগামী মেলার জন্য পাই, তাহলে অবশ্যই তা প্রকাশিত হবে।
আপনাদের কি আগে থেকেই টার্গেট থাকে, আমরা এ বছর এতজন তরুণের বই প্রকাশ করব?
না, সেরকমভাবে কোনো টার্গেট থাকে না। হ্যাঁ, একটা টার্গেট থাকে, আমরা ২৫ থেকে ৩০টা বই প্রকাশ করব। আর এই ২৫-৩০ এর মধ্যে কিভাবে কিভাবে যেন তরুণরাই চলে আসে।
আগামী বইমেলার জন্য কোনো টার্গেট আছে কি না?
আগামী বইমেলায় আমি আশা করি যে, আমাদের যে লেখক আছেন অলরেডে, তাদের বইয়ের পাশাপাশি নবীণ লেখকদের বইও আসবে।
সাহসকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন?
আসলে প্রকাশনাকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখার মতো অবস্থা এখনো বাংলাদেশে নাই। নাই এজন্য যে, আমরা মেলাগুলো করার জন্য যতটা আয়োজন, যতটা সময় ব্যয় করি, পাঠক তৈরি করার মতো কিন্তু কার্যক্রম নেই আমাদের। একমাত্র ব্যতিক্রম হল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। পাঠক তৈরি করার জন্য এ কেন্দ্র যে ভূমিকা নিচ্ছে, বিভিন্ন রকম কার্যক্রম চালাচ্ছে, এর বাইরে বলার মতো, উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো সাংগঠনিক, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম নেই।
পাঠক তৈরির জন্য প্রকাশক বা অন্য কারো দায় আছে বলে মনে করেন কি না? এ ক্ষেত্রে আপনার কোনো চিন্তা আছে কি?
না, আমি এ ক্ষেত্রে প্রকাশকদের আলাদাভাবে দায়ী করব না। পুরো ব্যাপারটা রাষ্ট্রের। আমি এভাবেই দেখব। হ্যাঁ, রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে প্রকাশকদেরও কিছু দায় আছে। মূল দায়টা নিতে হবে কিন্তু রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র চাইলে এটা হতে পারে। তাছাড়া আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে যারা আমাকে প্রশ্ন করেছে, তাদের আমি যেটা বলেছি, তা হলো, পাঠক তৈরি করার জন্য বইটাকে সহজলভ্য করতে হবে। আগে কিন্তু আমরা গ্রামেও বই পেতাম। গ্রামের বাজােরর লাইব্রেরিতে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি গল্প,উপন্যাস ইত্যাদি ক্লাসিকের বাইরের বই পেতাম। কিন্তু আজকাল বই কিনতে হলে আপনাকে যেতে হবে উপজেলা কিংবা জেলা শহরে। কার এত ঠেকা পড়েছে যে, এত দূরে গিয়ে বই কিনবে!
অনেকে বলবেন যে, হ্যাঁ, অনলাইনে আপনি পেতে পারবেন। অনলাইনতো কয়দিন ধরে চালু হল। অনলাইনের সঙ্গে তো এতোটা জড়িত নয় মানুষ।
মোবাইল দিয়ে কথা বলা এক জিনিস, আর মোবাইল দিয়ে একটা বই কেনা অনেক কঠিন। ইট ইজ নট ইজি। হেবিচুয়েশন থাকতে হবে। তা না থাকলে গ্রামে বসবাস করারা একটা স্টুডেন্ট চাইলেও কিন্তু হুট করে সহজে বইটা পাবে কি না আমার সন্দেহ আছে।
সেজন্য আমার প্রস্তাবনা হল, আমাদের প্রায় তিনশ প্রকাশনা রয়েছে, সমস্ত প্রকাশনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বা তার আশেপাশে কিংবা এখানে যে মেলাটা হচ্ছে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে মন্দিরে ঢোকার গেইট থেকে শুরু করে টিএসসি পর্যন্ত বড় রাস্তার প্যারালাইনে একটানা সারা বছরের জন্য বরাদ্দ দিয়ে দিত, তাহলে বই কেনার জন্য একজন পাঠককে সেই বাংলাবাজারসহ বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জায়গায় দৌড়াতে হত না। এতে করে সবাই জানতো, বাংলাদেশের যত বই আছে সব ওখানেই আছে। এতে সহজলব্য হত। পাঠকও বাড়তো, আরো অনেক লেখকও তৈরি হতো।
আরআর