আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ
শীতের ফ্যাকাশে প্রকৃতি বিদায় নেয় । উঁকি দেয় বসন্তের মিষ্টি সকাল । সবুজের গায়ে রঙ লাগে নতুন করে । বাংলার প্রকৃতির সাথে আমরা বঙালীরাও জেগে উঠি । নতুন করে সুন্দরের বীজ বুনি । আমাদের জ্ঞানের গজৎটাকে নাড়িয়ে দিতে তখনি আসে বইমেলা । মেলা, বাঙালীর আনন্দের পাঠশালা । আবার বইয়ের সাথে যখন এই মেলা যোগ হয় তখন আমাদের আনন্দটা অন্য রকম মাত্রা পায় । আনন্দের সাথে জ্ঞানের এমন গলায় গলায় ভাব একটা জাতির জন্য অনেক বড় পাওয়া । আমাদের এ আনন্দের ইতিহাস বেশ পুরোনো । সেই বাহাত্তর থেকে । তখন অবশ্য পরিসরটা আজকের মত ছিল না । একাশিতে এসে আমরা বাংলা একাডেমির হাত ধরে পাই আজকের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ধীরে ধীরে বড় হয় মেলার পরিধি । প্রকাশনা জগতে ঘটে নানা পরিবর্তন । এভাবে সমৃদ্ধ হতে হতে বিশাল মহীরুহ হয়ে দাঁড়ায় বইমেলা । এদেশের মানুষের আনন্দ বেদনা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অনন্য মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে আজকের বইমেলা ।
বইমেলার কারণে সারা দেশে একটা জাগরণ তৈরি হয় । জ্ঞানের জাগরণ । মেলা ছাড়া এ জাগরণ সম্ভব না । বইমেলা আসে । শিক্ষার্থীরা পছন্দের বইয়ের সন্ধানে মেলায় ছোটে । শিশুরা বাবা মার কাছে আব্দার করে মেলায় যাব । চূড়ান্ত ব্যস্ত মানুষটাও মেলার জন্য একটু সময় বের করতে বাধ্য হয় । ছেলে মেয়েকে বই কিনে দেয় । সবারই নিজের আলাদা একটা পছন্দ থাকে । হয়ত সময়ের অভাবে বইয়ের দোকানে যাওয়া হয় না । ব্যস্ত এ সময়ে বই খুঁজে খুঁজে জ্ঞানবিলাসের সময় কই? ছেলে মেয়ে বা বন্ধু বান্ধবের আব্দার রক্ষায় মেলায় যেতে হয় । এ সুযোগে নিজের পছন্দের বইগুলোও কেনা হয়ে যায় । ঢাকার সমাজে এ শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা অনেক । হাতের কাছে পেলে এরা অনেক কিছুই করে ফেলে । কাছে না পেলে এরা অনেক কিছুই এড়িয়ে যায় । মেলা উপলক্ষ্যে অনেকে টাকা জমায় । মেলা আসছে বই কিনতে হবে এমন একটা হুজুগ সবার ভিতরেই কম বেশি থাকে । মেলা না থাকলে এদের অধিকাংশেরই বই কেনার জন্য টাকা জমানোর চিন্তাও আসত না । উঠতি তরুণদের তো এভাবেই বই কেনা হয় । নিজের প্রিয় মানুষকে উপহার দেয়ার জন্য বই কিনে এমন মানুষও কম না । মেলা না থাকলে এ জায়টা অনেকাংশেই অন্য কোন পণ্যের দখলে থাকত ।
লেখকদের আমরা উঁচু চোখে দেখি । নানাভাবে তাদেরকে কল্পনা করি । বিশেষত প্রখ্যাত লেখকদের একটা চিত্র আমাদের ভেতরে এঁকে রাখি । তাদের নির্মিত চরিত্র থেকে, তাদের চিন্তার গতি ও কল্পনার সূত্র ধরে আমরা কল্পনা করি । সবারই ইচ্ছা থাকে প্রিয় লেখককে কাছে থেকে দেখার । লেখকের সাথে নিজের একখণ্ড স্মৃতি ধরে রাখার । কিন্তু কয়জনের পক্ষে আলাদা করে লেখকের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ মিলে ? মেলায় গিয়ে ভক্ত পাঠকরা সহজেই কবি সাহিত্যিকদের সাথে কাছ থেকে মেলা মেশার সুযোগ পায় । লেখকের সাথে পাঠকের এই যোগসূত্র একদিকে পাঠককে আপ্লুত করে, অন্য দিকে লেখকের জন্যও তা প্রেরণার কারণ হয় । লেখকের জন্য পাঠকের মনকেনিখুঁত ভাবে পাঠ করা সম্ভব হয় । এতে লেখকের চিন্তা সমৃদ্ধ হয় , পাঠকের সামনে জ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় ।
বইপ্রেমীরা নতুন বইয়ের জন্য মেলার দিকে তাকিয়ে থাকে । কোন লেখকের নতুন কী বই বের হল তার জন্য সবাই উন্মুখ থাকে । লেখকরাও এ সুযোগকে লুফে নেন । নিজের পছন্দের বইটা মেলায় প্রকাশ করেন । এতে একসাথে সবার দৃষ্টি পড়ে তার বইটির উপর । আলাদা কোন প্রচারণা ছাড়াই সব শ্রেণীর পাঠকের সামনে নিজের বইটাকে তুলে ধরতে পারেন । এভাবেই লেখকের চিন্তা, লেখকের সাজানো স্বপ্ন একসাথে সব পাঠকের হৃদয়ে সাড়া ফেলতে পারে । মেলা ছাড়া পাঠকের হাতে হাতে বইয়ের ভাণ্ডারগুলো তুলে দেয়া কতটা দুঃসাধ্য তা সহজেই অনুমেয় ।
মেলায় এসে প্রকাশকরাও পরষ্পরকে চূড়ান্ত ভাবে যাচাই বাছাই করতে পারে । পাঠকের জায়গা থেকে নিজেদেরকে পরখ করতে পারে । এতে নিজের বইটাকে বাজার পাওয়ার জন্য হলেও শিল্প মানে তুলে আনার চিন্তা করে । এভাবে একটি মেলা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির জগৎটাকে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে প্রতি বছর । দিন দিন আমাদের জ্ঞানের জগতটা সমৃদ্ধ হচ্ছে । প্রকাশনা শিল্পের উন্নতী হচ্ছে । নতুন নতুন অসংখ্য বই বের হচ্ছে । এর পেছনে -আমরা না দেখলেও- বসন্তের এই বইমেলা অনেকখানি গতিশীল ভুমিকা পালন করছে । প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে বসন্ত নিয়ে আসে । জ্ঞান বিজ্ঞানের বসন্ত । বইপ্রেমীদের বসন্ত ।
আরআর