হাওলাদার জহিরুল ইসলাম
দেওবন্দ থেকে
'আধিপত্তবাদি, দখলদার ইংরেজরা যখন পুরো ভারতবর্ষে নিজেদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলো তখন তারা দেখলো যতো দিন মুসলমানদের 'ধর্মীয় চর্চা' নষ্ট করা না যাবে ততো দিন তাদের ক্ষমতা পাকপোক্ত করা সম্ভব নয় তখন তারা একের পর এক মাদরাসা মসজিদ গুড়িয়ে দিতে লাগলো৷ নির্বিচারে আলেম-উলামাদের ওপর অত্যাচার শুরু করলো৷ গণহারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহিদ করতে লাগলো৷ এভাবে দীর্ধ দিন চলতে থাকলে এক পর্যায়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে একজন মুসলমানের জানাযার নামাজ পড়ানোর জন্য কোনো মাওলানা তো দূরের কথা সুরা কেরাত জানে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যেতো না৷ মানুষ গ্রামের পর গ্রামে মৃতদেহ নিয়ে ঘুরে বেড়াতো একজন মাওলানার খোঁজে৷ অধিকাংশ সময় তারা জানাযা ব্যতীতই মরদেহ দাফন করে দিতো৷
১৮৩১ ও ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক বিপ্লবী আন্দোলন ব্যর্থ হলে মুসলমানদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে৷ এহেন পরিস্থিতিতে অত্যাচারী ইংরেজদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কালেম নানুতাবী রহ.সহ কয়েকজন দরদি আলেম-মুরুব্বী মিলে ১৮৬৪ সালে দেওবন্দে একটি মাদরাসার ভিত্তি স্থাপন করেন৷ এর প্রধান লক্ষ্য ছিলো কুরআন-হাদিসের সহিহ ইলম সংরক্ষণের পাশাপাশি ইসলামি নেতৃত্ব তৈরি করা৷ যা়তে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখা যায় এবং আরো গতিশীল করা যায়৷'
আজ ভারতের ৬৭তম প্রজাতন্ত্রী দিবস উপলক্ষে 'জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ দেওবন্দ শহর শাখা' কর্তৃক আয়োজিত এক সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে সদরে জমিয়ত সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানি সাহেব উপরোক্ত কথাগুলো বলেন৷
আল্লামা আরশাদ মাদানি আরো বলেন, 'আজ অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের ঐতিহাসিক অবদান থাকলেও সুকৌশলে নতুন প্রজন্মকে সে ইতিহাস থেকে ফিরিয়ে রাখা হচ্ছে৷ নতুন প্রজন্ম মহাত্না গান্ধী, জওরহর লাল নেহরু, সুভাস চন্দ্র'র ইতিহাস জানলেও তারা মুসলমানদের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারছে না৷'
মাদানি সাহেব আরো বলেন, 'ভারত স্বাধীনতা আন্দোলন সর্বপ্রথম মুসমানরাই শুরু করেছিলো৷ ইংরেজদের বিরুদ্ধে 'জেহাদ ফরজে'র ঐতিহাসিক ফতোয়া মুসমানদের ধর্মীয় নেতাই দিয়েছিলেন৷ তারাই সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার করেছিলো৷ মহাত্না গান্ধী, জওহর লাল নেহরুসহ হিন্দু নেতারা তো অনেক পরে এসে স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন৷ দেওবন্দের কৃতি সন্তান, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসেনানি মাওলানা মাহমূদ হাসান দেওবন্দি রহ.ই তো মহত্না গান্ধীকে 'মহাত্না' উপাধি দিয়ে ভূষিত করেছিলেন৷'
আরশাদ মাদানি সাহেব নতুন প্রজন্ম বিশেষত উলামা-তলাবাকে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস, অবদান, ঐতিহ্য জানতে উৎসাহিত করে বলেন, 'আমাদের পূর্বসূরীদের ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না৷ তাদের ত্যাগের ইতিহাস আজকের প্রজন্মের অবশ্যই জানা থাকা প্রয়োজন৷' তিনি বলেন 'আমাদের পূর্বসূরীরা একটি সুষম, ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন৷ আমরাও সেটাই চাই৷ আমরা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী নই৷ যে কোনো ধর্মের নামে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমরা সর্বদাই সোচ্চার থাকবো৷ আমরা দেশ ও জাতির কল্যাণ চাই৷'
দেওবন্দের 'মহল্লা বর জিয়াউল হক'-এ অনুষ্ঠিত উক্ত সমাবেশে জমিয়ত দেওবন্দ শাখার নেতৃবৃন্দসহ স্থানীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন৷ ক'জন শিখ ও হিন্দু নেতাকেও সমাবেশে অতিথি করা হয়েছিলো৷ হিন্দু নেতৃবৃন্দ তাদের ভাষণে বলেন, আমরা হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই৷ আমরা একই মাটির সন্তান৷ আমরা দেওবন্দসহ পুরো ভারতে শান্তি ও নিরাপত্তায় বিশ্বাসী৷
পরে স্থানীয় সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ দেওবন্দে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখায় সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানি সাহেবকে বিশেষ সম্মাননার ক্রেস্ট তুলে দেন৷
সমাবেশটি স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হয়ে মাওলানা আরশাদ মাদানি সাহেবের সভাপতির ভাষণ ও দোয়ার মাধ্যমে পৌনে ১১টার দিকে শেষ হয়৷ এতে দারুল উলুম দেওবন্দ, দারুল উলুম ওয়াকফ, জামিয়া জাকারিয়া'র ছাত্র-শিক্ষকসহ স্থানীয় সর্বস্ততরের জনগণ ব্যাপকভাবে অংশ গ্রহণ করে৷
এর আগে সকাল ৯টার দিকে দেওবন্দের মসজিদে রশিদের সামনে থেকে একটি বিশাল র্ ালি বের করা হয়৷ র্ ালিটি দেওবন্দের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে সামাবেশস্থলে এসে শেষ হয়৷