মোস্তফা কামাল গাজী
শিক্ষার্থী; দারুল উলুম দেওবন্দ
ট্রেনের জানালার ফাঁক গলে মৃদুমন্দ বাতাশ বইছে। ঝক ঝক ঝক শব্দ বাহিরের শব্দকে গিলে ফেলেছে। মন্দ লাগছে না এ শব্দটা। কেমন যেনো নেশা নেশা ভাব। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে কোথাও ছোট ছোট তারার মতো টিপটিপ করে জ্বলছে গেঁয়ো মশাল। শীতের এ রাত্রিতে মনে হচ্ছে যেনো হারিয়ে যাচ্ছি কোনো দূর অজানায়।
শশমাহি ইমতেহান শুরু হবার আগ থেকেই নানা কল্পনা জল্পনা করছি কোথাও ঘুরতে বেরুবো। যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়নি কোথাও। মুনাসিব সাথী পাওয়া মুশকিল। অনেকবার প্লান করার পরেও ভেঙ্গে গেছে। আশা নিরাশার জলে ভাসছিলাম। কাল আব্দুল্লাহ ভাই বললেন তিনি শিমলা যাচ্ছেন। সাথে আরো একজন। ব্যাস আমিও হয়ে গেলাম তাঁদের সফরসঙ্গী।
শিমলা হলো ভারতের উত্তর দিকে হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। ভারতের পর্যটনকেন্দ্রেরর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রচণ্ড গরমেও এখানে থাকে কনকনে শীত। শীতকালে তো বরফ পড়ে। তাই বরফ দেখতে ট্যুরের জন্য শীতকালকেই বেছে নেয় ট্যাুরিস্টরা।
দেওবন্দ স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়লাম। আম্বালা স্টেশনে হবে খানিক যাত্রাবিরতি। সেখান থেকে কালাকা। পরদিন কালকা থেকে শিমলা। সফরটা মনে হয় আনন্দেই কাটবে। চড়বো পাহাড়ে। মেঘের নির্মল জল ছুঁয়ে দেখবো পাহাড়ে চড়ে। ঝর্ণার আমল জলে ভাসবো খানিকটা। কী মজাই না হবে!
আম্বালা পৌঁছলাম রাত ১০ টায়। ট্রেন থেকে নেমে গেলাম কালকা এক্সপ্রেসের টিকেট আনতে। লম্বা লাইন। স্টেশনে দায়িত্বরত একজন বললেন, কালকার ট্রেন তো সাত নাম্বার প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে ট্রন ধরুন। টিকেট না কেটেই আমরা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কোনোমতে ট্রেন ধরলাম। জানালার পাশে সিট পেতে বসলাম। সময় কাটছিলো না যেনো। ফেসবুকেও একটু ঢু মারতে পারছি না। এরোপ্লেন মুড দিয়ে রেখেছি। সফরের সময় চার্জ ধরে রাখার এটাই একমাত্র পদ্ধতি। কী আর করা! বাহিরের রাতের দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। কালকা স্টেশনে নামলাম রাত ২:৩০ মিনিটে। ভেবেছিলাম কোথাও টিকেট চেক হবে না। কিন্তু না। ট্রেন থেকে নামার পর টিকেট চেক হলো। টিকেট না কাটার অপরাধে দিতে হলো পাঁচশ রুপি জরিমানা। সমস্যার কথা বুঝিয়ে বললেও মানেনি তারা।
শিমলার ট্রেন রাত ৩:৩০ টায়। ট্রেনগুলো দেখতে খুব সুন্দর। ছোট ছোট বগি। জানালাগুলো বাসের জানালার মতো বড় বড়। ৩/৪ বগিবিশিষ্ট ট্রেনগুলো দেখতে অনেকটা শিশুপার্কের বাচ্চাদের চড়ার ট্রেনের মতো। টিকেট কেটে গেলাম ট্রেন ধরতে। ট্রেনের বগির তুলনায় যাত্রী ছিলো বেশি। সিট নেই কোনো বগিতে। এতোদূর দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। প্রায় ছয় ঘন্টার রাস্তা। পরামর্শ করে ঠিক করলাম পরবর্তী ট্রেনে যাবো। সেটা ছাড়বে ভোর ছয়টায়। ততক্ষণ ওয়েটিং রুমে বসে রইলাম।
যথাসময়ে ট্রেনে চড়লাম। জানালার পাশে সিট নিয়ে বসলাম। পুরো বগিতে হৈ হুল্লোড় চিল্লাচিল্লি। বিপুল আনন্দে মত্ত সবাই। কয়েকটা ফ্যামেলিও এসেছে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। ট্রেনজুড়ে যেনো খুশির বন্যা বইছে।
হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছাড়লো খানিক বাদে। সারারাতের নির্ঘুম ক্লান্তিতে ফের ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘন্টাদেড়েক বাদে আব্দুল্লাহ ভাই ডেকে তুলে বাইরের দিকে ইশারা করলেন। বাহিরে তাকিয়ে জীবনের আশ্চর্য সব দৃশ্য দেখলাম। শত শত ফুট ওপর দিয়ে ট্রেনটা এগুচ্ছে। নিচে খাদের দিকে তাকালে গা ছমছম করে। দূরের বিশালাকারের পাহাড়গুলো যেনো আকাশের নীল ছুঁয়েছে। কোনটা পহাড় সবুজে ঘেরা কোনটা কোনটা কালো পথুরে কোনটা গাঢ় খয়েরী। লাগোয়াভাবে রয়েছে এক পাহাড়ের সাথে অন্য পাহাড়। যেনো স্বপ্নের কোন ভূস্বর্গ। বৃষ্টি হচ্ছিলো খানিকটা। সেই সাথে প্রচণ্ড শীত। একেবারে জমে যাবার অবস্থা। এতো উঁচুতে চলে এসেছি যে পাহাড়ের নিচে ভাসমান মেঘ দেখা যায়। চলতি ট্রেনে বসে ছুঁয়েও দেখেছি মেঘের ভেলা। কেমন শিরশিরে ভাব। আমার কাছে এটাই সব'চে আশ্চর্যের আর আনন্দের লেগেছে। মেঘ ছুঁয়ে দেখার অনুভুতি এই প্রথম।
একটু পরপর আসে ছোটবড় গুহা। ইংরেজদের আমলে নির্মিত এ রেলপথ আর পাহাড়ের গুহা সত্যিই আশ্চর্যের। বিশাল বিশাল পাথুরে পাহাড় কেটে তৈরী হয়েছে প্রায় ২০৪ টি গুহা। এসবের ভেতরে ঢুকলে সবাই আনন্দচিৎকারে মেতে ওঠে। পাশের সিটের দিদিদের আনন্দ যেনো একটু বেশিই। একটু পরপরই চিৎকার চেঁচামেচি নয়তো গলা ছেড়ে হিন্দি গান।
যত ওপরে উঠছি ততই শীত বেড়ে চলছে। একটু ওপরে উঠতেই তুষাঢ়পাত শুরু হলো। চারদিকে বরফের মেলা। গাছের ওপর, গাড়ির ওপর, ঘরের ছাদে বরফ পড়ে সব শুভ্রবর্ণ হয়ে আছে। সবাই আনন্দে লাফাচ্ছে বরফ দেখে। মোবাইল বের করে শুভ্র প্রকৃতির ভিডিও করলাম। বরফে আবৃত্ত গাছগুলো দেখতে সত্যিই চমৎকার।
এক স্টেশনে ট্রেন থামলো মিনিট দশেকের জন্য। ট্রেন থেকে বরফ খেলায় নামলাম সবাই। হাতে নিয়ে গোল পাকিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি। ওপর থেকেও ঝরছে বরফ নিচেও তার ছড়াছড়ি । কী এক নন্দনমুগ্ধতায় হারালাম কতোক্ষণ। সেলফি তুলে নিলাম কয়েকটা। দূরের পাহাড়গুলো বরফে বরফে সম্পূর্ণ সাদা হয়ে আছে। মনে হলো পাখা হলে একটু উঁড়ে আসতাম দূরের ঐ শুভ্রনীল জগতে থেকে।
আবারো ট্রেনে চড়ে বসলাম। প্রায় ছয় ঘন্টা পরে পৌঁছুলাম স্বপ্নের শিমলা। শিমলার রেলস্টেশনটা যেনো স্বর্গের কোনো নিকুঞ্জ। সবার সাথে আমরাও কতোক্ষণ হৈ হুল্লোড় করলাম বরফে। সেখানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে হালকা নাস্তা করে নিলাম স্টেশনের একটা দোকান থেকে।
স্টেশনের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলাম বালুগঞ্জ মাদ্রাসায় যাবার জন্য। ড্রাইভার 'ওম নমঃ শিবা' পড়ে খানিকটা পূজো করে আমাদের নিয়ে ছুটলেন মাদ্রাসার উদ্দেশে। আঁকাবাঁকা পিচ্ছিল রাস্তা। বরফ গলে গলে আরো পিচ্ছল হচ্ছে। নিচের দিকে বিশাল খাদ। রাস্তার সাইডে লোহার রেলিং দেয়া। যাতে কোনো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গভীর খাদে না পড়ে যায় সে ব্যবস্থা। মিনিট দশেক বাদে পৌঁছুলাম বালুগঞ্জ মাদ্রসায়। মাদ্রসা এখন ছুটি। পুরোটা শীতে মাদ্রাসা ছুটিই থাকে। দায়িত্বরত একজনের সাথে সাক্ষাৎ হলো। নাম আনিস। দারুল উলুমের ছাত্র শুনে ভেতরে নিয়ে বসালেন। লেপ কম্বল দিলেন গরম হবার জন্যে। আলাপচারিতা হলো খানিকটা। মিনিট বিশেক পরে তিনি বললেন, চলুন আপনাদেরকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। আমরা তার সাথে বেরুলাম। মাদ্রসার পাশে বড় একটা মাঠ।
পুরো মাঠ সাদা বরফে ঢাকা। যেনো আকাশের শুভ্রতা নেমে এসেছে এখানটায়। মাঠে নেমে দৌড়াদৌড়ি হুড়াহুড়ি করলাম কতোক্ষণ। বিভিন্ন কায়দায় সেলফিও তোলা হলো।
যোহরের সময় মোহতামিম সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ হলো। কুশল বিনিময়ের পর জিগ্গেস করলেন কোথায় বাড়ি? কোথায় পড়ি? বললাম বাড়ি কোলকাতায় আর পড়ি দেওবন্দে। দারুল উলুম দেওবন্দের কথা শুনে দিলেন এক শক্ত ধমক। বললেন, এখন তো মাদ্রসা ছুটি না। ক্লাস ফেলে ঘুরতে চলে এলে কেনো?
আমরা চুপ করে রইলাম। তিনি আর কিছু বললেন না। খাদেমকে বললেন থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। কোনো সমস্যা হলে জানাতে।
নামাজ পড়ে খানা খাওয়ার পর মোহতামিম সাহেব খাদেমকে ডেকে বললেন আমাদের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে আনতে। অচেনা জায়গায় এ মানুষটার অশেষ মায়া আর কৃপা দেখে সত্যিই জল এসে গেলো চোখে। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে এখন ঘুরতে নিয়ে যাবার জন্যে একজন রাহবারও ঠিক করে দিলেন। সত্যিই অভাবনীয়।
আনিস ভাই আমাদের নিয়ে পাহাড়ে চড়তে লাগলেন। ঢালু সিঁড়ি থাকলেও উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মাঝে মধ্যে বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে থাকি। মিনিট দশেক বাদে আমরা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছুলাম। সেখানটায় একটা পুরোনো আমলের বাড়ি নজরে এলো। আনিস ভাই বললেন এটা ইংরেজরা নির্মাণ করে গিয়েছে। নাম এডভান্স এস্টেডি। এর ভেতর নাকি আশ্চর্য সব জিনিস রয়েছে। সেদিন এটি বন্ধ থাকায় ভেতর ঢুকতে পারিনি। বাহির থেকে ঘুরে দেখেছি কেবল।
এরপর আনিস ভাই আমাদের নিয়ে চললেন আরেক বিস্ময় দেখাতে। আগেরটা চাইতে এ পাহাড় বেশ উঁচু আর বড়। চড়তে চড়তে হাঁপিয়ে ওঠার জোগাড়। জিরিয়ে নিয়ে নিয়ে ওঠতে লাগলাম তবুও। বেশ উঁচুতে রয়েছে একটা মসজিদ। আনিস ভাই বললেন এ মসজিদের নাম কাশ্মীরি মসজিদ। এটাও বেশ পুরোনো। এ মসজিদের নাম কাশ্মীরি মসজিদ কেনো তা জানা হয়নি। ভেতর ঘুরে আনিস ভাই আরো ওপরে নিয়ে চললেন আমাদের। একেবারে প্রান্তচূড়ায় পৌঁছে বিস্ময়ে আমরা হতবাক! কী সুন্দর প্রকৃতির রূপলাবন্য। মহান প্রভুর অসীম মহিমাময়তার দেখা পেলাম যেনো। কী কুদরতি হাতছানি! চারদিকে বরফের পাহাড় শুধু। বাতাশে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। আলতো করে ছুঁয়ে দেখা যায়। এখানটাতে মনে হলো পৃথিবীর সব'চে উঁচু জায়গায় আমরা রয়েছি। দূরের পাহাড়গুলো ছোট মনে হলো। রাস্তার পাশে রেলিং করা একটা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে নিচের জগৎ দেখলাম। শুভ্র বরফে ছেয়ে আছে সব। মনে হচ্ছে যেনো পুরো শিমলাই সাদা বরফে ঢাকা। পাহাড়ের আরো ওপরে রয়েছে একটা শিব মূর্তি। অনেক দূর থেকে এটি দেখা যায়। বড় একটা গীর্জাও রয়েছে এ চূড়ায়। আনিস ভাই বললেন এ জায়গার নাম মালরোড। পাশের দোকান থেকে আইসক্রিম কিনলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আইসক্রিমে আলাদা একটা স্বাদ আছে। বিকাল পর্যন্ত সেখানে ঘুরাঘুরি করে মহান প্রভুর তৈরি অনিন্দ্য কান্তরূপ দেখলাম। সন্ধেয় ফিরলাম বালুগঞ্জ মাদ্রসায়।
এখানের বাড়িঘরগুলো খুবই সুন্দর আর আশ্চর্যের। পাহাড় কেটে খোপে খোপে নির্মাণ করা হয়েছে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি। কোথাও কোথাও জুমচাষও হয়।
রাতের পাহাড় দেখতে আরো সুন্দর। প্রতিটা পাহাড়েই জ্বলজ্বল করছে বাতি। যেনো এটিও একটি আকাশ। যেখানে জোনাকির মতো জ্বলছে অসংখ তারকারাজি।
রাতে প্রচণ্ড শীত পড়লো। কাঁথা কম্বলে মানছিলো না শীত। এমনিতে সারাদিন বরফে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তার ওপর এ শীত! শরীর যেনো আর মানছিলো না। পরামর্শ করলাম পরদিন সকালে দেওবন্দের উদ্দেশে রওনা হবো। শিমলার উল্লেখযোগ্য জায়গা দেখা ইতোমধ্যে দেখা শেষ। ইচ্ছে ছিলো মানালিতে যাবো। সেখানে আরো বেশি বরফ পড়ে। আরো কিছু দেখার ছিলো। কিন্তু এ শীতে আর কোথাও যেতে আমাদের কারোরই ইচ্ছে হচ্ছিলো না। উপরন্তু শীতের জামাও বেশি নিয়ে আসিনি। তাই সবারই ফিরে যাবার ফায়সালা।
পরদিন মোহতামিম সাহেব থেকে বিদায় নিলাম। অল্প সময়ে যেনো অনেক ঘনিষ্ট হয়ে গেছেন তাঁরা। বিদায়ের সময় সবার মুখই মলিন। কৃত্রিম হসি দিয়ে তাঁরা বিদায় দিলেন। এবার আমাদের ট্রিপ বাসে করে ফিরা। বাসস্টেন্ড এসে বাসে চড়ে বসলাম। মিনিট পাঁচেক পরে বাস ছাড়লো সেই আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে। জানালা দিয়ে মেঘের উড়াউড়ি দেখছি। কিছুই ভালো লাগছিলো না। কারণ পেছনে ছেড়ে এসেছি কারো কারো আমল ভালোবার স্পন্দন আর নৈসর্গিের সুন্দরের মুক্ত হাতছানি।
আরআর