মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
দেওবন্দ, ইন্ডিয়া থেকে
ট্রেনে ফুরফুরে মনে
বহুদিন বাদে ছুটছি আজমির শরিফ৷ দেখার ইচ্ছে আবারও হজরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি রহ.-এর মাজার৷ ঘুরবো রাজিস্তান৷ গড়বো পাহাড়েঘেরা জনবসতির সঙ্গে বন্ধুত্ব-মিতালি৷ চড়বো উটের পিঠে৷ প্রেমখেলায় মাতবো পৃথিবীখ্যাত সাঙ্গে মর্মর পাথরে পাথরে৷
দেওবন্দ টু উত্তরাখাণ্ড পৌঁছুলাম বাদ আসর৷ রিজার্ভেশনে চড়েছি এইতো ঘণ্টা দেড়েক হলো৷ বসে রয়েছি এখন সিটে৷ মায়ের সঙ্গে আলাপ হলো টানা মিনিট বিশেক৷ দোপাট্টা, জায়নামাজ নিয়ে আসতে বললেন তিনি৷ ছোটভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম দু'চারটে৷ লালসূতো আনার কথা জানালাম মজা করে৷ খুশির হাসি হাসলো অকপটে৷ ট্রেন ছুটছে বেশ গতিতে৷ সকাল দশটে নাগাদ পৌঁছুবো হয়তো বা৷ ‘পুরো সফর নিয়ে লেখার ইচ্ছে রয়েছে অভিনব কিছু৷ সুস্থতার জন্য বিশেষ মোনাজাতে সঙ্গে রাখুন৷ ঠিকঠাক সব দেখে-জেনে ফিরতে পারি যেনো মহামহিমের অশেষ রহমে, সালামতে৷' প্রার্থনা ও লেখার আবদার রাখলাম বন্ধুদের৷ শেষমেষ রাতটি ভর কাটালাম হুল্লোড়ে, আনন্দে৷
খাজার দরবারে
ভোর সাড়ে ন'টায় নামলাম ট্রেন থেকে৷ আজমির জংশন থেকে রিকশায় চড়ে হাজির হলাম সোজা দরগাহ রোডে৷ দরবারের কিছুটা দূরেই নামিয়ে দিলো ড্রাইভার৷ সামনের পথ পায়ে হাঁটার, বুঝে নিলাম আপনাতেই৷ হাজারো ভিড় দেখলাম সকাল হতে না হতেই৷ হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খৃস্টান, নরনারী, ধনী-গরিব, ভাষাবর্ণের ভেদাভেদ নেই কোনো৷ নেই পোশাক-পরিচ্ছদেরও তফাৎ৷ তবে দেওবন্দি পোশাকে সংকোচ এদের, এমনটা জানা ছিলো আগে৷ সামনে এগোতেই সেই সংশয়ও দূর হতে লাগলো৷ সতর্কতাবলম্বন হিসেবে কৌশল গ্রহণ করলাম একটি৷ হাতে পরলাম লালসূতো৷ গলায়ও বাঁধলাম মালার মতো একটি৷ মাত্র দশ রুপিতে মিললো পাঁচটে সূতো৷ রাস্তার দু'পাশে বাহারি চুড়ির দোকান চোখে পড়লো৷ ইচ্ছে হচ্ছিলো ওগুলোও পরে নিই৷ তাতে কৌশলটা আরও মাত্রাতিরিক্ত হতো৷ পরা হয়নি৷ কিন্তু ভেতরে গিয়ে মনে হলো, নাহ! পরা দরকার ছিলো৷
আমাদের সুফিজমের চারটে প্রসিদ্ধ সিলসিলা৷ যাকে ‘হক্কানি পীর-মুরিদির ধারা' বলে৷ সেই চারটের অন্যতম একটি ‘চিশতিয়া'ধারা৷ যার মূল হলেন এই হজরত পীর খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি রহ.৷ তিনি তো আগাগোড়া ছিলেন শুদ্ধমানব৷ কিন্তু মুসলমান নামধারী আজ কিছু লোক অর্থ কামাইয়ের বাহারি ফন্দি এঁটেছে তাঁর কবর ঘিরে৷ যাকে তারা নাম দিয়েছে ‘আজমির শরিফ'৷
হজরত যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো এই প্রতিটা না-মর্দের গালে সজোরে চড় কষতেন৷ ভণ্ডামির মাত্রা নিঃশেষ করে দিতেন চিরতরে৷ কী আর করা! হবারই ছিলো হয়তো বা এমনটাই৷ যার ফলে হিন্দুস্তানি হক্কানি উলামায়ে কেরামও এর বিপক্ষে খুলতে পারছেন না আজ অবধি মুখ৷ কারণ এটি যে পুরোই সরকারের নিয়ন্ত্রণে৷
মুসলমান নামধারী কিছু চামচার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে দিব্যি কেবল৷ কামাচ্ছে যারা কোটি কোটি রুপি প্রতিদিন৷ সরকারের খাতায়ও জমা হচ্ছে কাড়ি কাড়ি অর্থ৷ সহজে পকেট কাটার এরচে' শ্রেয় কৌশল আর কী হতে পারে! এমনটাই জানালো লাখনৌ থেকে আসা এক ভদ্র লোক৷
প্রধান গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইলাম৷ একটা লোক বললো, ‘ফুরফুরা সে আয়া হো কিয়া?' বললাম, ‘জী'৷
‘দেওবন্দ' বললে ওদের চোখ চরকগাছে ওঠবে৷ ভয়ে থরথর করে কাঁপবে৷ ‘দেশদ্রোহী' বলে কমপ্লেনও করতে পারে থানায়৷ ফুরফুরার মুরিদই তাই বনে গেলাম ক্ষণিকের জন্য৷
ভেবেছিলাম গেট বোধয় একটা৷ ভেতরে গিয়ে দেখি একের পর এক গেট৷ সর্বমোট পাঁচটে ফটক৷ প্রতিটা ফটকের আগে রয়েছে রকমারি কারসাজি৷
প্রধান ফটক পেরিয়ে যখনই চালাবো পা, অমনিই দেখলাম সারি সারি ফুলের তোড়ায় সাজানো ছোট্ট ছোট্ট মোড়ক৷ একটা নিতে বললো একজন৷ বাবার দরবারে চড়াতে কাজে আসবে বোঝালো৷ নিলাম না তবু৷ ফটোসেশনে ব্যস্ত রইলাম কেবল৷ পরিচয় দিলাম উচ্ছন্নে কোনো তরুণ আমি৷ আপনাদের অপকম্মে সায় রয়েছে আমাদের৷ কিন্তু মনে রইলো কৌতূহলী ভাবনা৷ মোনাফিকিও বলা যেতে পারে একরকম৷
দ্বিতীয় ফটকে পা রাখতেই দেখলাম দুটি উঁচু জায়গা৷ প্রচুর লোকের ভিড় যেখানে৷ এগিয়ে যেতেই ধরা পড়লো একটি রহস্য৷ ‘ছোটা দ্যাগ', ‘বড়া দ্যাগ' নামে দুটো বড় ডেকচি গাঁথা মাটির তলায়৷ খাজার নামে সবাই তাতে পাঁচশো, হাজার রুপির নোট রেখে দিচ্ছে কমপক্ষে৷ জানতে উদ্যোগী হলাম বিষয়টি৷ হিন্দুস্তানি এক ভদ্রলোক জানালো ভোজনবিলাসের কথা৷ সাদা বাংলায় যাকে ভিক্ষাবৃত্তি বলে৷ মানে দিন শেষে সব পয়সা জমা করে দায়িত্বশীলরা পেটে চালান করে৷ কেবল উরসে সামান্য যতোটুকুন ব্যয় করা হয়৷ সবার ধারণা, এসব বাবার দরবারে খাবারের ব্যয় বাবদ খরচ করা হয়৷ কিন্তু বিষয়টি তা নয়৷
বাঁপাশে নজরে পড়লো সুবিশাল মসজিদ৷ ভাবলাম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের হয়তো বা৷ কিন্তু ভেতরে গিয়ে বুঝলাম ধারণাটি ভুল আমাদের৷ কয়েকজন লোক তালিম দিচ্ছে বাচ্চাদের৷ সুরতে যারা বেদাতিদের মতো৷ খারাপ লাগলো খুব৷
এগোলাম ডানপাশে৷ চোখ আটকালো আড়াইশো হুজরায়৷ যার প্রতিটায় রয়েছে লাল, সবুজ পোশাকপরুয়া ভদ্রলোক (?)৷ যাদের কাজ কেবল হিন্দিতে বিভিন্ন ছন্দ মেলানো হজরতের নামে৷ সুর করা৷ গান গাওয়া; ব্যস৷ এতেই লাখো রুপি কামাই প্রতি মুহূর্তে৷ বেজায় ভড়কে গেলাম৷ একজন ওলির কবর ঘিরে এত্তোকিছু! হিম্মত আসে কোত্থেকে এসবের! একটুও ভয়-ডর নেই কী এদের খোদায়ি গজবের!?
এগোলাম তৃতীয় ফটকে৷ পাশেই একটি পাথরে বাঁধা হাউজ দেখলাম৷ দাঁড়িয়ে গেলাম অবাক চোখে৷ তাতে নারী-পুরুষ হাত-মুখ ধুচ্ছে গোলাপজলে৷ কিছু লোক চামড়ার মশকে শুদ্ধজল বলে পানি বিক্রি করছে চড়াদামে৷ আহ, সে কী ভণ্ডামি দৃশ্য! একজনকে জিগ্গেস করে জানতে পারলাম, এতে নাকি গোনাহ ঝরে যায়৷ গোলাপের মতোন পবিত্র হয়ে যায়৷ বনে যায় পুরোদস্তুর নিষ্পাপ শিশু৷
পা বাড়ালাম চতুর্থ ফটকে৷ কিছু লোককে দেখলাম ঢোল-তবলা বাজাচ্ছে হরদম৷ আমিও বসে পড়লাম এই বরকতি (?) কাণ্ডে৷ সামনেই নজরে পড়লো হজরতের কবরের মূল গেট৷ হাতের ইশারায় একজন দেখিয়ে দিলো ভেতরে যাবার সারি৷ দাঁড়ালাম লাইনে৷
মিনিট দশেকের মতোন ঠেলাঠেলি বাদে পৌঁছুলাম ভেতরে৷ আমার সামনেই ছিলো একজন অপরূপা৷ তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ দিলো সংশ্লিষ্ট এক বাবা (!)৷ কবরের চারপাশে প্রায় জন তিরিশেক নামধারী বাবাকে ব্যস্ত দেখা গেলো ঝাঁড়ফুঁকে; ফের অর্থ হাতিয়ে নেবার নামে নানা বুলি আওড়াতে৷ সবার মতো যুবতীটিও ফেঁসে গেলো৷ আমি ফাঁসলাম না৷ আমি নিলাম না ভণ্ড বাবাদের আশীর্বাদ৷ লোকটি সোজা ভেংচি কাটলো আমায়৷ কিছু খসাতে পারবে না পকেট থেকে, হয়তো টের পেয়েছে সে৷ জলদি বেরিয়ে যাবার নাম করে তাই সজোরে ধাক্কা দিলো আমায়৷ পা বাড়ালাম অন্য ফটকে৷
একটি বিশাল গাছ দেখলাম বাইরে বেরিয়েই৷ কিছু লোককে দেখলাম খাজার সুর ধরেছে ভাটিয়ালি আদলে৷ কাওয়ালি-অভিনয়ে তাল মেলালাম মিনিট কয়েক৷ বেশ হাসি পেলো আমার৷ এখানে কতো বড় বড় বুদ্ধিজীবির আগমন হয়, দুনিয়ার সব বুঝতে বুঝতে যাদের টাক পড়ে যায়, অথচ এই দরবারি ব্যবসায়ীদের সরল চেহারাটি কী তারা বুঝতে পারেন না? হায়, বড় অবাক লাগে!
আরও হতবাক হই সামনে এগোতেই৷ নরনারী, হিন্দু-মুসলিমকে দেখলাম মাজার বরাবর সেজদা করছে একসঙ্গে৷ হু-হু শব্দে রোনাজারি করছে বাবার দরবারে৷ ফুল চড়াচ্ছে বড় আবেগে৷ লালসূতো হাতে পরছে সব বয়সী উপস্থিতিগণ৷ আহ, কতো বড় ব্যবসা! কতো বড় ভণ্ডামি!
আজমির শরিফকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নামি-দামি হোটেল, দোকান পাশেই৷ খুলেছে নতুন নতুন ধর্মব্যবসার দ্বার৷ এসব ভক্ত-মহাভক্ত কিংবা বাবারা কী বুঝবে না কোনোদিন আসল সত্যটি!? ভাঙবে না কী এই মহাভণ্ডামির আসর!? হজরত চিশতি রহ.-কে কী ঘুমোতে দেয়া হবে না একটু শান্তিসুখে সাড়ে তিন হাত ভুমির তলে!
দূরে ওই পাহাড় মিশেছে নীল আকাশে
আজমির থেকে বেরোতে বেরোতে দুপুর হলো৷ গেটের সামনে এসে টেম্পু ভাড়া করলাম একটি৷ ড্রাইভারকে জানালাম রাজস্থান প্রদেশের বিখ্যাত স্পটগুলি বেড়িয়ে নিয়ে আসবার কথা৷ বেচারা পাঁচটে জায়গা বেড়াতে নেবার নাম করে আটশো রুপি আবদার করে বসলো৷ সম্মত হলাম পরামর্শ করে৷
আজমির গেট পেরিয়ে এলাম ইন্ডিয়া গেটে৷ পুলিশ চেকিং সেরে এগোতে লাগলাম রেগিস্তানের পথে৷ পাহাড় দেখবো৷ উটের পিঠে চড়বো৷ পাহাড়ের সঙ্গে গান গাইবো৷ কতো কী ইচ্ছে মনে!
উঁচুতে চড়তে লাগলো আমাদের টেম্পু ধীরে ধীরে৷ পাশ কেটে যাচ্ছিলো সাঙ্গে মর্মর পাথরগুলোর৷ আহ, কী সুন্দরই না দেখতে বিশ্বখ্যাত এসব!
পৌনে এক ঘণ্টা বাদে পৌঁছুলাম রেগিস্তান গেটে৷ টেম্পু আর এগোবে না মনে হলো৷ ড্রাইভার আমাদেরকে পাহাড়ে বেড়াবার টিকেট কেটে নিতে বললো৷ হাজার রুপির টিকেট নিয়ে উটের পিঠে চড়লাম চারজনে৷
‘মরুর জাহাজ' বলা হয় উটকে৷ কথাটি পুরোপুরি খেটে গেলো এই ভরদুপুরে৷ কিছুটা পথ ছিলো পিচঢালার৷ খুব ইনিয়ে-বিনিয়ে এগোচ্ছিলো যেনো উটটি৷ মিনিট তিনেক বাদেই যখন আরম্ভ হলো মরুএলাকা, অমনিই দে ছুট হাল উটটির৷ চালক বয়সী বেশ৷ কথা বলছিলো মিষ্টি মিষ্টি৷ আমায় ‘বাবু' বলে মাতিয়ে রাখলো সারাক্ষণই৷
রাশি রাশি বালু পেরিয়ে একসময় উটটি থেমে গেলো মেলা ময়দানের দক্ষিণে৷ চালককাকু জানালো পাহাড়ে চড়বার কথা৷ ততোক্ষণে বিশ্রাম নেবে সে৷ অমনিই আমরা দিলাম ভোঁ দৌড়৷ কিছুটা পথ এগোতেই মাটিতে গেঁড়ে গেলো পা৷ মাথার ওপর ছিলো প্রচণ্ড রোদ্দুর৷ পায়ের তলে তপ্ত বালুকণা৷ তবু পাহাড়িকার সঙ্গে মজতে মন মানলো না কোনো বাঁধা৷
এগোতে এগোতে পৌঁছুলাম পাহাড়ে৷ আহ, মহামহিমের কী অপরূপ সৃষ্টি খানিকটা ওপরেই! মিনিট বিশেক বাদে হাতের ইশারায় ফিরতে বললো চালককাকু গোপালকাগা৷ একরকম দৌড়েই পৌঁছুলাম তার কাছে৷ উটে চড়ে ছবি তুলে নিতে বললো সে৷ ফটাফট তুলে নিলাম কয়েকটি৷
বলিউড তারকা শাহরুখ খান, কাজল নাকি এখানটায় বেশ কিছু সিনেমায় শুটিং করেছেন৷ বিশাল এ ময়দানটি নাকি কোনো কাজে আসে না তেমন৷ এমনিতেই পড়ে থাকে সারাটি বছর৷ তবে প্রতিবছর নাকি দীপাবলির পরে উট-ঘোড়া লড়াইয়ের প্রতিযোগিতা হয় এখানে৷ যে ফার্স্ট হয়, তার নাকি বড়ধরনের এনাম মেলে৷ একটি দেয়াল দেখিয়ে এসব জানাতে লাগলো সে৷
ফেরার পথে দেখলাম পাহাড়ে চড়বার জন্য ডিজিটাল হেলিপ্যাডের কাজ চলছে৷ মাস দেড়েক বাদেই হয়তো চালু হবে ডিজিটাল সিস্টেমটি৷ কষ্ট করে আর কাউকে পায়ে হেঁটে চড়তে হবে না এই পাহাড়ে৷ প্রতি প্যাডে চারজন আরামে বসে ওপরে চড়তে পারবে অনায়েসেই৷
কথায় কথায় উটটি এসে দাঁড়ালো মূল গেটে৷ চালককাকু বখশিশ চাওয়ার ভান করলো৷ পঞ্চাশ রুপি হাতে ধরিয়ে দিতেই চেহারা তার খুশিতে ভরে ওঠলো৷ ফের নেমে পড়লাম আমরা পায়ে চলার পথে৷
আনা সাগড়ের পারে
বিশাল জায়গাজুড়ে ‘আজমির শরিফ'৷ একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মনোরম একটি শহর৷ নগরটিও কয়েক কিলোমিটারে ঘেরা৷ রেগিস্তান থেকে ফিরে আমরা চললাম শহরের পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে৷ হঠাৎ গাড়িটা থামালো ড্রাইভার৷ হাতের ইশারায় পাহাড় চিরে বানানো একটি দরবারের মতোন ঘর দেখিয়ে দিলো সে৷ জানালো, খাজা গরিব নেওয়াজ এখানে আসতেন কখনও-সখনও৷ দরবারি আর কতো! মন সায় দিলো না অতোটা৷ ওখানে তেমন কাউকে দেখাও গেলো না৷ পাশেই দেখালো বিশাল সাগর৷
খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম এটি বিখ্যাত ‘আনা সাগর'৷ যেটি হজরত চিশতি রহ.-এর বিশেষ অবদান৷ বৃটিশ আমলের শাসকরা এই এলাকার মুসলমানদের জল ব্যবহারে বাঁধা দিয়েছিলো একবার৷ কোথাও থেকে কোনো জলের যোগাড় সম্ভবও ছিলো না তখন৷ হজরত চিশতি রহ.-এর মুরিদান তাকে বিষয়টি অবহিত করলো৷ তিনি সোনার একটি পেয়ালায় সামান্য জল রাখলেন৷ এরপর তাতে ফুঁক দিয়ে ছেড়ে দিতে বললেন তখনকার এই মরা নদীতে৷ খানিকপর আরম্ভ হয় সাগরটির তলদেশ থেকে উতলে ওঠা জলপ্রবাহের৷ আজ অবধি যা পুরোপুরি বহাল৷
নদীটির ফটকে চোখ রাখতেই ক'জন কপোত-কপোতিকে দেখলাম একসঙ্গে পূণ্যস্নান (?) করছে৷ লোকচোখের সামনেই বদলাচ্ছে কপোতিরা নিজেদের ভিজে কাপড়-চোপড়৷ ক'জন তরুণ লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আবার সেদিকে৷ জলে নজর ফেললাম শরম ঢাকতে৷ দেখি জলের হালতটাও বারোটা বাজার উপক্রম৷ হয়তো বা এদের নাপাকি জমে জমে এমন ময়লা, ঘোলাটে হয়ে গেছে৷ রাব্বুল আলামিন! হেফাজত করো, বিড়বিড়ালাম মনে মনে৷ অবশেষে বেরিয়ে পড়লাম ঘাট থেকে৷
সামনে রয়েছে আরেকটি ফটক৷ সেখানে দেখা গেলো অনেক বাবা, মা আর সন্তানদের৷ বাবারা হাত ধরে হাঁটছেন ললিপুটের মতোন বাচ্চাদের৷ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন এদিক-ওদিক৷ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম আমি৷ বড্ডো খারাপ লাগলো আমার৷ আমারও তো বাবা ছিলো৷ আমারও তো এমন সব পাবার কথা ছিলো৷ কিন্তু পাইনি৷ বলা ভালো, পাওয়া হয়নি৷ কী আর করা! চোখের জল মুছতে মুছতে এগোলাম আরও সামনে৷ দেখলাম নদীজলে সারি সারি কই মাছের বহর৷ বেশ দেখতে লাগলো৷ জায়গাটিতে আরও দেখলাম কয়েকটি পুরোনো ইটপাথরে গাঁথা ঘর, ফুলবাগান৷ ঘুরে ঘুরে বেশ বেলা গড়ালাম৷ ফিরে এলাম ফের বাইরের দুনিয়ায়৷
ফেরারী পথ ধরে
আনা সাগরের ঘাট থেকে এলাম ‘সোনিজি কি নাসিয়া' জাদুঘরে৷ জৌনধর্মের সোনালি নকশা দেখলাম কাঁচের ভেতর৷ এরপর যেতে চেয়েছিলাম আজমির ফোর্টে৷ কিন্তু গেট অবধি গিয়েই ফিরতে হলো আমাদের৷ মন সায় দিলো না আর ততোটা৷
তখন আসর ছুঁই ছুঁই৷ ট্যাক্সি করে পৌঁছুলাম আজমির জংশনে৷ সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখের পাতা এক হয়ে এলো প্রায়৷ নামাজ আদায় করে শুয়ে পড়লাম প্রতীক্ষালয়ে৷ দেখতে দেখতে একটা সময় ঘড়ির কাটা দাঁড়ালো সাতটে পঁয়তাল্লিশে৷ ট্রেন ছেড়ে যাবার ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠলো হঠাৎ৷ চড়ে বসলাম সিটে৷ নাশতা করে শরীরটা এলিয়ে দিলাম কখন যেনো৷ জানালা গলে আসছিলো হু হু বাতাস৷ হঠাৎ বেড়াতে গেলাম ঘুমের দেশে৷
সারারাত কেটে গেলো ঘুম ঘুম বেলায়৷ চোখদুটো যখন মেললাম, তখন ট্রেন হজরত থানবি রহ.-এর থানাভবন স্টেশনে দাঁড়িয়ে৷ ক্রসিংয়ের জন্য অন্য আরেকটি ট্রেনের অপেক্ষায়৷ নামাজ আদায় করে নেমে পড়লাম বাইরে৷ আলসে মোড়া দিলাম হাত-পা নেড়ে নেড়ে৷
ঘুরে ঘুরে দেখলাম থানাভবন স্টেশনটি৷ এইতো সেই স্টেশন, যেটি হজরত থানবি রহ.-এর অাদেশে ব্রিটিশ সরকার করতে বাধ্য হয়েছিলো৷ মুরিদান দূর-দূরান্ত থেকে আসতো ইমদাদিয়া খানকায়৷ স্টেশন না থাকায় টাপড়ি স্টেশন কিংবা অন্য কোথাও নামতে হতো তাদের৷ সেখান থেকে পায়ে হেঁটে আসতে হতো তাদের থানাভবনে৷ কিন্তু আজ আর তেমনটা করবার প্রয়োজন নেই৷ স্টেশন রয়েছে৷ তবে হজরত থানবি রহ. আজ আর নেই৷ পাশেই দেখতে পেলাম ঐতিহাসিক ‘শামেলি ময়দান'৷ কোরবানির ঈদের আগে এসেছিলাম থানাভবনে৷ ঘুরেছিলাম পুরো থানবিগৃহ৷ জেয়ারত করেছিলাম হজরত থানবি রহ., হজরত আবদুল্লাহ জানজাবি রহ., হজরত হাফেজ জামিন শহিদ রহ.-এর কবর৷ তাই আজ আর নামা হলো না৷
ট্রেন এখন টাপড়ি জংশনে৷ ‘চায়ে চায়ে' বলে কান ভারী করে তুলছে হকারের দল৷ যাত্রী সব জেগে গেছে এতোক্ষণে৷ কেউ চায়ে চুমুক মারছে, কেউ হিন্দিতে বক্ওয়াস করছে৷ আর আমি জানালায় চোখ রেখে দেখে চলেছি মহামহিমের অপার প্রকৃতি৷ হঠাৎ একটি শব্দে নজর রাখলাম ভেতরে৷ দেখি একটি বালিকা তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ অবাক হলাম না৷ তাকাতে পারে৷ তাতে আমার কী! হিন্দুস্তানে ওরা তাকাতে পারবে৷ আমরা তাকালে দোষ কিনা তাই! তারওপর আমার লেবাস, মনন তো এসবে সায় দেয় না৷ ছোট্ট একটি ছেলে আমার পাশে এসে বসলো৷ এর নজর লক্ষ্য করলাম মেয়েটার দিকে৷ হাবভাবে ছেলেটিকে মনে হলো মেয়েটির ছোটভাই৷ সাত-আট হতে পারে বয়স৷ মেয়েটির আর কতো! সবে কিশোরীর গায়ে যোগ হয়েছে হয়তো ভরা যৌবনের বসন্ত৷ আরও দু'তিনবার চোখে চোখ রাখলো আমার৷ আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম বাইরের দুনিয়ায়৷ গড়াতে থাকলাম মেঘলা আকাশসমেত আবহাওয়াময় প্রহর৷
সাবেরি দরবারে মুহূর্ত কয়েক
ট্রেন থেকে রুড়কি নামলাম সকাল দশটে নাগাদ৷ পরামর্শ হলো কালিয়ার যাবো৷ অটো ভাড়া করলাম আপডাউন দুশো রুপিতে৷ গঙ্গার পাশ কেটে যাচ্ছিলো গাড়িটি৷ অনেককে দেখলাম গঙ্গাস্নান করে পবিত্র (!) হতে৷ মিনিট বিশেক বাদে পৌঁছুলাম কালিয়ারে৷ এখানে শুয়ে আছেন চিশতিয়া তরিকার আরেক বড় মনীষী৷ নাম তাঁর হজরত আলাউদ্দিন সাবেরি কালিয়ারি রহ.৷ ভেতরে তেমন জমজমাট নয় আজমিরের মতো৷ তবে অবাক হলাম বেশকিছু কাণ্ডে৷ আছাড়-পাছাড় খেতে দেখলাম ক'জন নারীকে৷ ‘ইয়া সাবেরি' বলে চিৎকার করতে দেখা গেলো চল্লিশোর্ধ ক'জন পুরুষকেও৷
একটু এগিয়ে দেখলাম বড় একটি গাছে কাগজ ঝুলছে বেশকিছু৷ তাতে হিন্দি, উর্দুতে লেখা ভক্তদের মানত হয়তো বা৷ কাছে গিয়ে দু'চারটে মেলে ধরতেই হাসি থামাতে পারলাম না আর৷ একজনে তার প্রেমে সফল হবার জন্য বাবার সাহায্য চেয়েছে৷ একজনে তার মায়ের মৃত্যু কামনা করে পত্র লিখেছে৷ হায়রে, ফাজলামো!
পশ্চিমে এগোতেই দেখলাম পুলিশের বহর৷ আজমিরের মতো এই পাক (?) দরবারটিও হয়তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে৷ কিন্তু এখান থেকে তেমন অর্থের আয় হয় না৷ বিদেশিরা তেমন আসে না৷ তবে আজমিরের তুলনায় বেশ ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে দেখা গেলো হাজিরিনদের৷
নরনারীর কোনো ভেদাভেদ নেই, সবার চোখে দেখলাম কান্নাজল৷ কাঁদছে অঝোরে৷ চিৎকার করছে দফায় দফায়৷ পূর্বপাশে দেখতে পেলাম তেল মালিশ করছে দাড়িহীন এক যুবাবয়সী বাবা (?)৷ আহ, বড় বড় বুজুর্গের কবর নিয়ে কী সব ব্যবসা! কতো বড় ধোঁকায় রাখছে আমজনতাকে! এসব ভণ্ডামি থেকে উত্তরণের পথ কী কেউ খুঁজবে না কোনোদিন!?
কালিয়ার থেকে রুড়কি মাছবাজারে গেলাম মাছ কিনতে৷ হাজার রুপির সাত কিসিমের মাছ নিয়ে চড়লাম বাসে৷ রুড়কি টু শান্তির ঠিকানা দেওবন্দ ফিরছি ঘণ্টাখানেক হলো৷
সফরের ক্লান্তি দেহজুড়ে৷ তবু কোনোরকম এসে পৌঁছুলাম দারুল উলুম দেওবন্দের দরোজায়৷
চাই সূচিবদ্ধ শুদ্ধতা
গাওয়ার ঢংয়ে নেই শুদ্ধতা৷ পোশাক-পরিচ্ছদে আগাগোড়া ফাসেক৷ দাড়ি নেই৷ গোঁফের বাহার বটে৷ মাথার ঝাঁকুনিতে বোধয় সমানে জিকির করছে৷ কাছে গেলাম এগিয়ে৷ জিকির তো নজরে এলো৷ তবে রাব্বুল আলামিনের নয়, অর্থ কামাইয়ের, ধান্দাবাজির৷ নরনারীর কোনো ভেদাভেদ নেই৷ বাবার দরবারে সব পর্দা মাফ (?)৷ মনের পর্দা বড় (?) পর্দা মনে হলো৷
ভাবনাটি হলো আজমির শরিফের ভেতরে গিয়ে আমার৷ যাবার পথে ফেসবুক পোস্টের ফলে নানা টাইপ ইনবক্সবার্তা এসেছে অনেকের৷ কাওয়ালি গাইতে বলেছেন কেউ কেউ৷ গাইতে পারিনি৷ সুর, তাল-লয় যে জানা নেই৷ কবর জেয়ারত করেছি কেবল৷ ভালো লাগেনি নামধারী বাবা ভক্তদের সেসব৷
লালসূতো যে বাঁধিনি দরোজায়৷ পকেট কাটতে যে পারেনি আমার৷ ময়ূরপঙ্খীরাজের পশমে যে আমায় করতে পারেনি চিরশুদ্ধ৷ খাজা বাবার দরবার হতে নাকি কেউ ফেরে না খালি হাতে৷ ওদের চোখে আমিই কেবল ফিরেছি শূন্য হাতে৷ তবে আমার তো মনে হয় না খালি হাতে ফিরেছি৷ সঙ্গে তো বোধয় নিয়ে এসেছি আফসোসের মহড়া৷ অজানা-রহস্যকাহিনি৷ আহ, মুসলমান আজ কতো অধঃপতনে!
আমরা বেশ লেগেছি আহলে হাদিস নামধারীদের টুটি টিপতে, রাজনীতির নামে দ্বন্দ বাড়াতে৷ কিন্তু মুসলমানদের মধ্যকার শুদ্ধিকরণে কী একটি দলও এগোবে না!
প্রতিটা সেক্টরে আমাদের উলামায়ে কেরামের ভুমিকা থাকা চাই৷ আমাদের দেশেও কতো বেদাতি, বে-শরা পীর-ফকির কিংবা ওলিদের কবর ঘিরে রয়েছে এ ধরনের হাজারো ভণ্ডামি; লাখো ধান্দাবাজি৷ সেসব থেকে আমজনতাকে হাত ধরে টেনে তোলার দায়িত্ব কী আমাদের নয়?
এদিকে আজমিরঅলাদের দৃষ্টিতে খালি হাতে ফিরলেও গোপনে কিন্তু একটি মজার জিনিস নিয়ে এসেছি আমরা৷ ওরা জানলে হয়তো ওখানেই দাফন করে দিতো আমার মোবাইলটি; কিংবা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে মাহরুম (?) করতো খাজার শানে গাওয়া বরকতি (?) এই কাওয়ালি-নাত শোনা থেকে৷
লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত
আরআর