আওয়ার ইসলাম:দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে জাতীয় সংসদ ভবন, প্রস্তাবিত আইয়ুব নগর প্রকল্পসহ স্থপতি লুই আই কানের হাতে গড়া দুর্লভ স্থাপত্যকর্মের ঐতিহাসিক নকশাগুলো দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও এ মুহূর্তে নকশার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে যাচ্ছে না সরকার।
বিশেষ করে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর অপসারণে এখনই কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে না। সেই সঙ্গে নকশার বাইরে থাকা স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন এবং বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মতো বড় স্থাপনাগুলোও অপসারণের পরিকল্পনা নেই সরকারের। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, সহিংসতা নিরোধ ও জঙ্গি হামলা ঠেকানোর লক্ষ্যে আসন্ন একাদশতম জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা নেই। এছাড়া পাকিস্তান আমলে তৈরি করা এসব নকশা বর্তমানের সঙ্গে কতটা মানানসই সেটাও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দায়িত্বশীলরা এরই মধ্যে নকশাগুলো পর্যালোচনাও শুরু করছেন। পর্যালোচনা শেষে তাদের দেয়া প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বহু খোঁজাখুঁজির পর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভে সংরক্ষিত বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের এ সংক্রান্ত ৮৫৩টি নকশা গত বছরের ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সংসদ ভবনে পৌঁছায়। সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আপিএ) আ ই ম গোলাম কিবরিয়া নকশাগুলো গ্রহণ করেন। এর আগে তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে লুই আই কানের উত্তরসূরিদের কাছ থেকে নকশাগুলো সংগ্রহে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে আসেন।
সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭৪ সালে লুই আই কান যখন মূল নকশাটি করেন, তখন ২৭টি মন্ত্রণালয়ের জন্য এ পরিকল্পনা করেন। তখন সেখানে মসজিদ ছিল, মাঝে বাগান ছিল, চন্দ্রিমা উদ্যানের ওখানে একটি বড় সড়ক ছিল, এর সামনে লেক ছিল, এরপর সংসদ ভবন ছিল।
২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ ছিল নকশার প্রথম ধাপ। যার সামনে ও পেছনেও বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক ও মাঝখানে লেক। দ্বিতীয় ধাপে আছে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ। এছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়। কিন্তু নকশার ব্যতয় ঘটিয়ে সংসদ ভবনের উত্তরে ৭৪ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝে বিশাল এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার কমপ্লেক্স।
আর সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্ত লাগোয়া স্থানে পাঁচ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে সমাধিস্থ করা হয়েছে সাতজনকে। লুই আই কানের নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকেনি।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে নকশা উপেক্ষা করে আসাদ গেটের উল্টো দিকে অবস্থিত সংসদ ভবনের জায়গায় স্থাপন করা হয় পেট্রোলপাম্প। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশে খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনও নির্মাণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ এবং মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিলে প্রতিবাদ শুরু করেন পরিবেশবাদীরা। নকশাবহির্ভূত এসব নির্মাণ বন্ধে তারা সোচ্চার হয়ে উঠলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সব উন্নয়ন কাজ বন্ধ রেখে মূল নকশা সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। ওইসময় থেকেই নকশার বাইরে থাকা জিয়াউর রহমানের কবর অপসারণের দাবিও জোরালো হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনসহ মহাজোটের শরিক দলগুলো অতিদ্রুত সংসদ এলাকা থেকে জিয়ার কবর অপসারণে সরকারকে তাগাদা শুরু করে। এনিয়ে সংসদের অধিবেশনেও দাবি তোলেন এমপিরা। সর্বশেষ গত বছরের শেষ অধিবেশনে নকশাগুলো দেশে আসার এক দিন পরই সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়ার কবরসহ বিধিবহির্ভূত সব স্থাপনা সরানোর লক্ষ্যে ৭১ বিধিতে নোটিশ উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের সদস্য নুরজাহান বেগম।
নোটিশে তিনি বলেন, ‘সংসদ ভবনের মূল নকশা পদে পদে লঙ্ঘন করা হয়েছে। লঙ্ঘন করে জিয়াউর রহমানের সমাধিসহ অনেক স্থাপনা করা হয়েছে, যেটি আমাদের সংসদ ভবনের পরিবেশ ও সংসদের জনগুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়েছে এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়েছে। তাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর প্রতি আমার নিবেদন অবিলম্বে সংসদ ভবন এলাকা থেকে বিধি বহির্ভূত সব স্থাপনা সরানো হোক।’ অবিলম্বে লুই আই কানের নকশা বাস্তবায়নেরও জোর দাবি জানান তিনি। জবাবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শিগগিরই নকশা বহির্ভূত স্থাপনা অপসারণ করা হবে বলে ঘোষণা দেন।
এরপর থেকেই জিয়ার কবর সরে যাচ্ছে বলে রব ওঠে। প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে বিএনপি। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তারা এটিকে সরকারের চক্রান্ত আখ্যায়িত করে জিয়ার কবরকে নিশ্চিহ্ন করতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেয়। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল পর্যায়ের অনেকেই বিষয়টি নিয়ে নিজেরা আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রীকেও অবহিত করেছেন বলে জানা গেছে।
ক্ষমতাসীন দলটির সিনিয়র কয়েক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদমাধ্যমক বলেন, আওয়ামী লীগে এখন আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি চলছে। এই নির্বাচনের আগে দেশের পরিবেশ অস্থিতিশীল হোক এটা চান না প্রধানমন্ত্রী। তাই চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে জিয়ার কবর সরানোর মতো পদক্ষেপ এ মুহূর্তে নাও নেয়া হতে পারে। দেশের পরিবেশ অনুকূল রেখে নির্বাচন সম্পন্ন করাটাই এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া নকশাগুলো পর্যালোচনাও শেষ হয়নি এখনো। সবকিছু মিলিয়ে এটা বলা যায়, এখনই এসব হচ্ছে না।
ডিএস