জামিল আহমদ: কবি আফজাল চৌধুরী । স্বদেশ ও স্বধর্ম চেতনায় উজ্জীবিত এক শক্তিমান কবি। তার কবিতায় ফুটে ওঠত স্বদেশ প্রেম ও ধর্মের চিরন্তন জয়গান। তার কাব্য হয়ে ওঠেছিল কল্যাণ ও মানবতার সেতুবন্ধন। শব্দের গাথুনিতে মানবতার ঝঙ্কার তুলতেন তিনি। আমরণ লড়েছেন শোষিতের পক্ষে।
আজ তার ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী।৯জানুয়ারি ২০০৪ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে কবির রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। ইসলামের নব-উত্থান প্রত্যাশী এই কবির কবিতায় সমসাময়িক ঘটনাবলী যেমন নান্দনিক হয়ে ওঠেছে তেমনি নিকট-ইতিহাসও বাঙ্ময় হয়েছে তার তীর্যক-তীক্ষ্ণ ও অনুসন্ধানী ভাব ও ভাষায়। বর্তমান দ্বান্দ্বিক কাললগ্নে নিকট-ইতিহাসের সেই সোনালি অধ্যায়ের সফল প্রতিস্থাপন ছিল তাঁর আমরণ প্রত্যাশা।
সাহিত্যের টাইরেসিয়াস খ্যাত দূরদর্শী এই প্রবক্তা কবি আত্মিক দিক দিয়ে নিপীড়িত বিশ্বের সকল মানুষের বিশেষভাবে শোষিত ও নির্যাতিত মুসলিম জনগণের পক্ষে ছিলেন অত্যন্ত সোচ্চার। মানবাত্মার সব ধরনের অবমাননার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন চির প্রতিবাদী কবিকণ্ঠ। তাঁর অধিকাংশ কবিতায় এ সত্য বিধৃত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিষ্ট শাসকগোষ্ঠীসহ বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের ধ্বজাধারী কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সাত দশকের অপশাসন শোষণ ও গণহত্যার নিন্দায় অধ্যক্ষ কবি আফজাল চৌধুরীর কবিতা ছিলো প্রতিবাদমুখর।
তিনি ১০মার্চ ১৯৪২ সালে হবিগঞ্জের খাগাউড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। বড় ভাই প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রাক্তন এমএনএ ও সংসদ সদস্য মরহুম এ.কে. লতিফুর রহমান চৌধুরী ( কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ) এবং মেঝো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা , ভাষা সৈনিক এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মরহুম আলতাফুর রহমান চৌধুরী ( ইয়াকুত চৌধুরী )।
কবি আফজাল চৌধুরী হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন (১৯৫৯) । হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (১৯৬১)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ (অনার্স) (১৯৬৪) ও এমএ (১৯৬৫)সম্পন্ন করেন।১৯৬৯ সালে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য হিসেবে তাঁর কর্ম জীবনের শুরু হয়। প্রথম কর্মস্থল রাজশাহী সরকারী ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (১৯৬৯ -’৭০)। পরবর্তীতে সিলেট সরকারী এমসি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (১৯৭০-’৭২), চট্রগ্রাম সরকারী ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (১৯৭২-’৭৩), সিলেট সরকারী কলেজ ( বর্তমান সরকারী এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ১৯৭৫ -’৮০ ও ১৯৯০-’৯৫) এবং সিলেট সরকারী মহিলা কলেজে (১৯৮৯-’৯০) অধ্যাপনা করেন। হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ১৯৯৬-’৯৯ পর্যন্ত। এ পদে কর্মরত থাকাবস্থায় ১৯৯৯ সালের ৯ মার্চ সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের প্রিন্সিপাল থাকাবস্থায় এ কলেজের উন্নয়নে তিনি প্রভুত অবদান রাখেন এবং ৭টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করেন। মাঝখানে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেষণে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ - এর ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেট ও ঢাকার যথাক্রমে ’উপ-পরিচালক’ (১৯৮০-’৮১) ও ’পরিচালক’ (১৯৮২-’৮৪) এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার ’স্কুলসমূহের পরিদর্শক’ ছিলেন।
তিনি ছিলেন ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা ’উপ- পরিচালক’ । ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঢাকার ’পরিচালক’ থাকাকালে সাহিত্য পত্রিকা ’ঐতিহ্য’ এর প্রকাশ ও সম্পাদনা; সেমিনার, আলোচনা সভা প্রভৃতির মাধ্যমে দেশের বরেণ্য কবি – সাহিত্যিক – সাংবাদিক – বুদ্ধিজীবিদের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নবজাগৃতির সৃষ্টি; ১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন উপলক্ষে ’আফগানিস্তান আমরা ভালবাসি’ সংকলন গ্রন্থের প্রকাশ প্রভৃতি ছিল তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচায়ক।
গ্রন্থপঞ্জি : কবি আফজাল চৌধুরীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। এরমধ্যে কাব্যগ্রন্থ ৭টি, কাব্যনাটক ১টি, প্রবন্ধ গ্রন্থ ২টি, নাটক ১টি ও অনুবাদ গ্রন্থ ১টি। তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৬টির ও অধিক। রচনাসমগ্র প্রকাশিত হলে তা দেড় হাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে যাবে। প্রকাশিত গ্রন্থ : কাব্যগ্রন্থ : কল্যাণ ব্রত (১৯৬৯, দ্বি. সং. ২০০৮), শ্বেতপত্র (১৯৮৩), সামগীত দু:সময়ের (১৯৯১), শবমেহেরের ছুটি (২০০৫), নয়া পৃথিবীর জন্য (২০০৬), বিশ্বাসের দিওয়ান (২০০৭), এই ঢাকা এই জাহাঙ্গীরনগর (২০১১)। কাব্যনাটক : হে পৃথিবী নিরাময় হও (১৯৭৯)। নাটক : সিলেট বিজয় (২০০৫)। প্রবন্ধ গ্রন্থ : ঐতিহ্যচিন্তা ও রসুল প্রশস্তি (১৯৭৯, ৪র্থ সং. ২০০৪), তাঁর কাব্যালোকে সৈয়দ আলী আহসান (২০১২)। অনুবাদ গ্রন্থ : বার্নাবাসের বাইবেল (১৯৯৬, দ্বি. সং. ২০০৫)।
অপ্রকাশিত রচনা : কবিতা : বন্দী আরাকান ও অন্যান্য কবিতা , খোশাহাল খান খটকের জন্য পঙক্তিমালা , অন্য গোলার্ধে হৃদয়, শাশ্বতের পক্ষে কবিতা, ঐতিহাসিক মর্সিয়া ও অন্যান্য কবিতা, অনুবাদ কবিতা : জালালুদ্দীন রুমির কবিতা, আলী শরীয়তীর কবিতা, কাব্যনাটক : বাঁশী, গীতিনকশা : সবুজ গম্বুজে ঢাকা ফুল, নাটক : ক্ষুধিত ক্যাম্পাস, প্রবন্ধ গ্রন্থ : কবিতার সংসারে জটিলতা, প্রতিশ্রুত কথকতা, সমকালীন সাহিত্যের ধারা, নান্দনিক ভুবন, সিলেটে সূফী সাধনা, মক্কার পথ : মুহম্মদ আসাদের মহাজীবন প্রভৃতি। কবি আফজাল চৌধুরী ২০০১ সালে সিলেট বিভাগের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ’রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ২০০৪ সালে মরণোত্তর ’কিশোর কন্ঠ সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।
ডিএস