সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মৌলিক অধিকার বিরোধী আইন করতে পারে না সংসদ ;অপারেশন ক্লিনহার্টের দায়মুক্তি অবৈধ :হাইকোর্ট

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

high-courtআওয়ার ইসলাম: মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আইন প্রণয়ন না করতে জাতীয় সংসদকে বারণ করেছে হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নন।

সংসদকে ভুলে গেলে চলবে না যে তাদের ক্ষমতা সংবিধানের বিধি বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। এই অভিমত দিয়ে হাইকোর্ট দায়মুক্তি অধ্যাদেশকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে। গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এই রায় প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত রায়টি ৫২ পৃষ্ঠার। রায়ে বলা হয়েছে, আইনগত প্রতিকার পাওয়ার অধিকার সংবিধান সকল নাগরিককে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোনো আদালতে প্রতিকার চাইতে এবং কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করতে পারবে না-এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এই অভিযানের সময় যৌথ বাহিনীর কোনো সদস্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন।

মূল রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। নিজস্ব অভিমত দিয়ে রায়ে একমত পোষণ করেছেন কনিষ্ট বিচারক বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর এই রায় ঘোষণা করা হয়।

রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ যথা-নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি অঙ্গই সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট। অর্থাত্ তিনটি অঙ্গের কেউ সার্বভৌম নয়। প্রত্যেকটি অঙ্গ সংবিধানের বিধি বিধান সাপেক্ষে স্বাধীন। শ্রেষ্ঠত্ব শুধুমাত্র এই সংবিধানের। সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মানে জনগণের শ্রেষ্ঠত্ব। জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছার প্রতিফলন এই সংবিধান। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গই সংবিধানের বিধি বিধান মেনে চলতে বাধ্য।

সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের সকল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধুমাত্র সংসদের এবং এই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সংসদ স্বাধীন। এতদসত্ত্বেও এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদের কিছু সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। অর্থাত্ সংসদকে আইন প্রণয়ন করতে হবে সংবিধানের ‘বিধানাবলী সাপেক্ষে’। জাতীয় সংসদ কোনোভাবেই সংবিধানের বিধানাবলীর পরিপন্থি কোনো আইন প্রণয়ন করবে না। সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নন। সংসদকে কখনই ভুলে গেলে চলবে না যে, তাদের ক্ষমতা সংবিধানের অন্যান্য বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। কারণ সংবিধান লিখিত। দেশের জনগণ সকলকেই এই সংবিধানের বিধি বিধান মোতাবেক চলার নির্দেশনা দিয়েছে।

রায়ে বলা হয়, যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ইতোমধ্যে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, বরং সকলেই আইনের অধীন। যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে যদি কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে তা বেআইনি, অসাংবিধানিক ও নিন্দাযোগ্য। এ ধরনের কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখেন।

রায়ে বলা হয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা হচ্ছে মানবাধিকার লংঘনের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। সংবিধান অনুসারে একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীরও আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। আমরা মনে করি যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না।

রায়ে বলা হয়, জাতীয় সংসদকে সতর্ক থাকতে হবে যেন এ ধরনের সংবিধানের চেতনা-পরিপন্থি আইন যেন আর প্রণীত না হয়ে যায়। ইচ্ছাধীন হত্যাকে দায়মুক্তি দিতে সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আইনটি জন্মগতভাবে মৃত এবং এর কোনো আইনগত অস্তিত্ব নেই। তবে মানুষের মৌলিক অধিকারের দিকে খেয়াল রেখে সংসদকে আইন পাস করতে হবে।

রায়ে বলা হয়, মামলার নথিপত্র এবং পেপার ক্লিপিং থেকে এটা স্পষ্ট যে যৌথ দায়মুক্তি আইন যে সময়ের জন্য করা হয়েছে ওই সময়ে দেশে এমন কোনো ভয়াবহ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হয়নি বা দেশে ব্যাপক কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়নি। কিংবা সে সময় দেশ গৃহযুদ্ধে বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। তাই উক্ত দায়মুক্তি সংবিধানের ৩১, ৩২, ৪৬, ৪৭(৩) এবং ৪৭(ক) এর বিধান মোতাবেক অসামঞ্জস্যপূর্ণ যেহেতু দায়মুক্তি আইনটি সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রণয়ন হয়নি সেহেতু আইনটি বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হল।

রায়ে বলা হয়, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি ধারণার সাথে যে কোনো ধরনের দায়মুক্তি সাংঘর্ষিক। মহান মুক্তিযুদ্ধ এই চেতনার উপর সংঘটিত হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধান গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনগণের মৌলিক অধিকারের রক্ষা কবচ। এ কারণে দায়মুক্তি আইনটি সংবিধানের সঙ্গে শুধু সাংঘর্ষিকই নয় চেতনাবিরোধীও বটে।

চার দলীয় জোট সরকারের আমলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, জনগণের নিরাপত্তা বিধান, সন্ত্রাস দমন এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের লক্ষ্যে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়। বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় পরিচালিত অভিযানকে ‘ক্লিনহার্ট অপারেশন’ নামে অভিহিত করা হয়।

২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশব্যাপী এই অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানের সময় নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের শিকার হয় কয়েক শত মানুষ। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে পরিচালিত এই অভিযানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো সদস্য বা ব্যক্তি বা শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণ কর্তৃক যৌথ অভিযানে কৃত যাবতীয় কার্যাদির জন্য তাদেরকে দায়মুক্ত করার লক্ষ্যে এই দায়মুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়।

দায়মুক্তির এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না। আবেদনের পক্ষে ড. শাহদীন মালিক ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু শুনানি করেন।ইত্তেফাক

ডিএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ