শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল কুরআন-সুন্নাহর আইন ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না : মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী শীত ও শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস

ছোটগল্প: ইউটার্ন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাসান ইনাম

hasan_inamএ নগরের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা ধরেছে। কিচ্ছু নেই এখানে। রাক্ষুসে নগর। আমার যা আধুলি ছিলো তাও চুষে নিয়েছে। নগরের প্রতি আমার যেমন ক্ষোভ তেমনি আমার প্রতি নগরের। আমি নিরস। আমি নষ্ট পেন্ডুলামের মতো ঝুলে আছি নগরে। মাকালের মতো পড়ে আছি। আমি ব্যর্থ পথিক। একে একে কত কিছুই ঘটে গেলো। আমি শুধু সাক্ষী হয়েই থাকলাম। কিছুই করতে পারলাম না। পাররলাম না কিচ্ছু। অবসরজীবনে চলে যাচ্ছি কদিন পরেই। শেষ ক'টা দিন একটু ইজ্জত নিয়ে থাকতে চাই। এমন কিছু করতে চাই যেটাকে পুঁজি করে অবসরযাপন করতে পারবো। ডিপার্টমেন্ট অথবা দেশকে আর কিছুই দেয়ার নেই আমার। যা দেওয়ার সব দিয়ে দিয়েছি। কিচ্ছুটি রাখিনি নিজের। সর্বস্ব উজাড় করেছি। স্ত্রীকেও তো দিয়ে দিলাম। সন্তানাদিও রাখিনি। আর কী দেওয়ার আছে? দু সপ্তাহ হাতে আছে মাত্র। এর মধ্যেই আমার বেঁচে থাকবার খোরাক জেগাড় করতে হবে। বেঁচে ধাকবার জন্য সাধারণ ভাবে মানুষের অধিকার কয়টা? ছেলেবেলায় সমাজ বইতে পড়তাম জোরে জোরে, হ্যারিকেন জ্বালিয়ে। বাবার ভয়ে পড়তাম। 'মানুষের বেঁচে থাকর জন্য কয়টি মৌলিক অধিকার রয়েছে। এগুলো হলো খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান,চিকিৎসা,নিরাপত্তা ইত্যাদি। এগুলো মানব জীবনর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো মানুষের সামাজিক অধিকার।' তালিকাটা অপূর্ণ। আমি যদি কখনও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নকারীদের কাউকে পাই তাহলে বলে দেবো মৌলিক অধিকারেন ওখানে 'স্ত্রী' শব্দটা যোগ করে দিতে। স্ত্রী ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। মহাপুরুষ বা সাধি সাধকদের কথা ভিন্ন। আমি প্রায় মহাপুরুষদের পর্যায়েই চলে গিয়েছি এখন। ডিপার্টমেন্টে তো আমাকে আইডল হিসেবেই দেখা হয়। গতবছর যারা ট্রেনিং করে এসেছে নতুন তারা তো এসে ওমনি আমাকে খোঁজা শুরু করেছিলো। আমার বাসাতেও এসেছিলো অনেকে। শুধু আমি জানি আমার খবর। আমি জানি আমার ব্যর্থতা আর পরাজয়ের গল্প।

খাদিজার সাথে যখন আমার বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ঊনত্রিশ। মোটামুটি ভালো র‍্যঙ্কেই ছিলাম। বাসা ছিলো ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেই। দু বছর জন্য মিশনে গিয়েছিলাম বিয়ের পর। ঘটনার শুরু তখন থেকেই। মা বাবাকে রেখে গিয়েছিলাম বাসায়। খাদিজা মাস তিনেক পর পর চিঠি লেখতো। আমিও নিয়ম করে উত্তর দিতাম। একবার একটা অপারেশনের লিড দিচ্ছিলাম আমি। প্রতিপক্ষের ঘাঁটিতে একটা যুবতী ছিলো। একদম খাদিজার মতো চেহারা। আমি বার কয়েক গুলি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। ফলপ্রসুত আমাদের সেই অপারেশনটা ব্যর্থ হয়। আমার কাঁধে একটা গুলিও লাগে। সেদিন রাতেই চিঠিতে পুরো ঘটনাটা লিখে পাঠাই খাদিজার কাছে। আমাদের ক্যাম্প থেকে দুই কিলো দূরে ছিলো পোস্ট বক্স। আমিই সবসময় চিঠি ফেলে আসি। সেদিন আহত ছিলাম তাই সেকেন্ড অফিসার রাফসানকে দেই চিঠিটা ফেলে আসার জন্য। আমি দেশে ফিরে আসি দুই সপ্তাহ পর। আমি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম যে আমাকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলো পুরো ইউনিট। বিশেষ ফ্লাইটে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমাকে। আসি যতটা শারিরীকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম তার থেকে বেশি ভেঙে পড়েছিলাম মানুষিক ভাবে। কারণ আমি যেই মেয়েটিকে গুলি না করতে পারার কারণে পুরো মিশন ভেস্তে দিয়েছিলাম, সেই মেয়েটা পরদিন নিহত হয় আমাদের অন্য একটা ইউনিটের কাছে। আমি দূর্ভাগ্যবশত লাশটাও দেখে ফেলেছিলাম। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো আমার খাদিজাকে খুন করা হয়েছে। আমি বারবার খাদিজা খাদিজা বলে চিৎকার করছিলাম। দেশে ফেরার পর আমাকে একমাস মেন্টালি ট্রিটমেন্ট করানো হয়। আস্তে আস্তে সুস্থ হই আমি। বিকারভাবটা কেটে যায় এক সময়।

তখনকার একদিন আমাকে ডেকে পাঠান উর্ধ্বতন এক অফিসার। আমাকে জানিয়ে দেন আমি সাসপেন্ড হয়েছি একমাস আগে। মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়ার দরুন আমাকে কিছু বলা হয়নি। আমি শকড হই। ইউনিফর্ম জমা দিয়ে দুদিন পথে পথে ঘুরি। আমি সব সময় আমার কাজকে ভালোবাসতাম। আর আমার স্ত্রী...

আমার চাকরি চলে যাবার পর খাদিজার আসল রূপ দেখতে পাই। এতদিন পই পই করে আমার সব রেশনের জিনিসপাতি বাপের বাড়ি নিয়ে যেতো। বেমাক্কা সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে খাদিজা অন্য খাদিজা হয়ে যায়। আমি সারাদিন বাসাতেই থাকতাম। মানুষিক ভাবে অনেক বিপর্যস্ত ছিলাম। তখন খাদিজা সারাদিন ঝগড়া করতো। আমাকে হেনেস্থা করতো। আমার উইক পয়েন্টগুলো নিয়ে খোঁটা দিতো।

একদিন আমি বারান্দায় বসে আছি। খাদিজাকে বললাম চা দিতে। খাদিজা এমন ভাবে আমার দিকে তাককালো যেন ওর কাছে ফকিরের মতো ভিক্ষা চেয়েছি। আমার তখন সময়টা অনেক খারাপ যাচ্ছিলো। নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারছিলাম না। উঠে গিয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে থাপ্পড় কষি খাদিজার গালে। খাদিজা কিচ্ছু বলেনা। সন্ধ্যায় দেখতে পাই ট্রলি নিয়ে খাদিজা চলে যাচ্ছে। আমি ইচ্ছে করেই পথ আটকায়নি ওর। আমিও চাচ্ছিলাম কদিন একা থাকতে। আর খাদিজা কদিন বাপেরবাড়ী থেকে আসলে ওর জন্যেও ভালোই হবে। কিন্তু আমার এই চাওয়াটা যে চিরস্থায়ী হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারিনি।

খাদিজা চলে যাওয়ার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই আমার কাছে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। আমি কোন প্রশ্ন করিনি খাদিজার কাছে। আমার কাছে তখন মনে হয়েছে আমি আসলে খাদিজার যোগ্য না। আমি নির্বিকার চিত্তে সাইন দিয়েছি। তখন ফ্যামিলির লোকজন ছাড়া কেউ জানতো না ব্যাপারটা। আমি জানাতেও চাইনি। চুপচাপ ঘরে বসে থাকতাম। বন্ধুবরেনা সহানুভূতি জানাতে আসতেন। সান্ত্বনা দিতে আসতেন। উনারা প্রশ্ন করতেন খাদিজা কোথায়? আমি এড়িয়ে যেতাম। ইনিয়ে বিনিয়ে আমি অন্য টপিকে উতরে যেতাম। আমি আসলে চাচ্ছিলাম না আমার নতুন কোন উইক পয়েন্টে আমাকে কেউ আঘাত করুক। আমাকে সাসপেন্ডের কারণটা ছিলো 'আমি নাকি ওই মিশনটা ইচ্ছে করেই ভেস্তে দিয়েছিলাম।' শুধু সাসপেন্ড করা হয়েছিলো প্রথমে। একদিন সকালে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে রাফসান ভাই আসলেন। রাফসান ভাই সেদিন মাত্র মিশন থেকে ফিরেছেন। আমার খবর শুনেই দৌড়ে এসেছেন। আমি অনেক কাঁদলাম সেদিন। রাফসান ভাই আমি খাদিজাকে কতটা ভালোবাসতাম। আমার এমন পরিস্থিতিতে খাদিজাকে পাশে পেলে অনেক কিছুই সামলে উঠতে পারতাম। রাফসান ভাই নতুন সংবাদ দিলেন। আমার সেদিনকার লেখা চিঠিটা নাকি উনি পোস্ট করতে পারেননি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন অন্য কাজে। পরদিন আমাকে ফেলে রাফসান ভাই অন্য ইউনিটে চলে যান। আমাকে চিঠিটা ফেরত দিতেও ভুলে যান। কথা বলতে বলতে পকেট থেকে চিঠিটা টেবিলের উপর রেখে চলে গেলেন।

এত সহজেই সব সহজ হওয়ার কারণ হলো আমি মর্শালকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে আমি শুধু মাত্র স্ত্রীর জন্যই অপারেশনটা ভেস্তে ফেলেছিলাম। আর সেজন্যই আমি আমার স্ত্রীকে ত্যাগ করেছি।

আমার কাছে তখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে উঠলো বিষয়টা। খাদিজা জানতোই না কেন আমি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কেনই বা আমার চাকরি চলে গেলো। খাদিজা হয়তো জানতো একটা মেয়ের জন্য আমি বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েছি। কিন্তু..ঐ মেয়েটার মধ্যেই যে আমি খাদিজাকে দেখতে পেয়েছিলাম সেটা খাদিজা জানতে পারেনি। যদি জানতো তাহলে এভাবে ছেড়ে যেতো না আমাকে। আর ভালোবাসাটাও এরকম ম্লান হতো না। খাদিজা খাদিজার জায়গায় ঠিক ছিলো। কোন নারী সহ্য করবে না তার স্বামি অন্য নারীর জন্য বিকারগ্রস্ত হবে আর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকবে। সব নিয়তির খেল..।

মিশন ফেরত ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে রিপোর্ট নেওয়ার পর কোর্ট মর্শাল বসলো। রাফসান ভাইয়ের সাক্ষী আর সেই চিঠিটা উত্থাপিত হওয়ার পর আমাকে ডিপার্টমেন্ট আবার ডেকে নেয় আর আমি হিরো হয়ে যাই। এত সহজেই সব সহজ হওয়ার কারণ হলো আমি মর্শালকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে আমি শুধু মাত্র স্ত্রীর জন্যই অপারেশনটা ভেস্তে ফেলেছিলাম। আর সেজন্যই আমি আমার স্ত্রীকে ত্যাগ করেছি। ডিভোর্স পেপার শো করতে বলা হলে দেখা গেলো ডিভোর্স লেটারটাও আমার পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছিলো। আমি সত্য বলছি আমি কোর্টের সাথে কোন প্রকার প্রতারণা করিনি। আমি লিগ্যাল কাগজ শো করেছি সব।

এখানেই আমার জীবনের পরাজয়। খাদিজা এখানেই জয়ী হয়ে যায়। আমি এতটাই বিপর্যস্ত ছিলাম যে আমি ডিভোর্স লেটারটা সেদিন একবারো পড়ে দেখিনি। ওটা আসলে আমার পক্ষ থেকে খাদিজাকে ডিভোর্স
ফরম ছিলো। খাদিজাই উকিলের সাথে কথা বলে এই চালটা চেলেছিলো। স্বামীর জীবনটা বাঁচানোর জন্য এর থেকে বড় ত্যাগ কেউ করেছে বলে মনে হয় না। আমি হয়তো কাগজটা আগা গোড়া পড়লে সাইন করতাম না। কিন্তু কদিন পর আমার ফাঁসি হয়ে যেতে পারতো। খাদিজা আমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসতো। যতটা না আমি করতাম। ডিভোর্সের পরপরই খাদিজা স্ট্রোক করে। আর তার কিছুদিন পর চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে।

দু সপ্তাহ পর তো অবসর নিবোই। এর মধ্যে এমন কি করা যেতে পারে? খাদিজাকে শান্তি যদি দিতে পারতাম। ওর শান বাধানো কবরের পাশে যদি....

পুনশ্চ : একটি বুলেট অথবা ভালোবাসার আঘাতে কর্ণেল হাসান মৃত্যুপথে গমন করেন অবসর গ্রহণের দুদিন পর।

জেএম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ