শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান রহ.-এর আত্মশুদ্ধির ভাবনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা রিজওয়ান রফীক জমীরাবাদী

fakihul_millat আত্মশুদ্ধি হলো আত্মাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করা। বাহ্যিক বিষয়ের মতো আত্মিকভাবেও অসংখ্য পাপ-পঙ্কিলতা বিদ্যমান।

বাহ্যিক বিষয়ে ব্যভিচার, সুদ-ঘুষ, মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, দুর্নীতি, খুনখারাবি, গিবত ইত্যাদি যেমন পাপকাজ, তেমনি আত্মিকভাবেও মানুষের অনেক হারাম বিষয় ও পাপ-পঙ্কিলতা রয়েছে। বাহ্যিক বিষয়ে যেগুলো পাপ, অন্তরে সেগুলোর চিন্তা করা, পরিকল্পনা করাও পাপ। এর বাইরে অহংকার, লোক দেখানো ইবাদত, হিংসা, বিদ্বেষ, প্রবৃত্তির বিভিন্ন অবৈধ চাহিদা, ইত্যাদি অন্তরের পাপ। শরিয়তের বিধান ইমানদার ব্যক্তিকে পালন করতে হয়। তেমনি চিন্তাজগতের পাপ দূর করে সেখানে ইখলাস, তাকওয়া, সবর, শোকর ইত্যাদি অর্জনের জন্যও শরিয়তের রুহানি বিধান পালন করতে হয়। সেসব বিধানের চর্চা ও সে অনুযায়ী আমল করার নামই হলো আত্মশুদ্ধি। নবী করিম (সা.)-কে দুনিয়ায় প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনি [মহানবী (সা.)] তাদের আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে শোনাবেন আর তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের তাজকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি করবেন। ’ (সুরা :  বাকারা, আয়াত : ১২৯)কেউ যদি অন্তরে খারাপ নিয়ত রেখে বাহ্যিকভাবে কোনো ভালো কাজ করে, তাহলেও আল্লাহর কাছে তা গৃহীত হয় না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই সে সফলকাম, যে আত্মাকে পরিচ্ছন্ন করেছে। ’ (সুরা : শামস, আয়াত : ৯)

মানুষের সুপথ কিংবা বিপথগামী হওয়ার কেন্দ্রবিন্দু হলো তার অন্তর। পবিত্র কোরআনে এসেছে : ‘আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করতে চান, তার বুক ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন এবং যাকে বিপথগামী করতে চান, তার বুক  অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন, তার কাছে ইসলাম অনুসরণ আকাশে আরোহণের মতোই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। যারা বিশ্বাস করে না, আল্লাহ তাদের এভাবেই লাঞ্ছিত করেন। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১২৫)

যাদের অন্তর পরিশুদ্ধ নয় কিংবা পরিশুদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আসলে চক্ষু তো অন্ধ হয় না, বস্তুত অন্তরই অন্ধ হয়। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪৬)

অন্য আয়াতে এসেছে : ‘আল্লাহ মোহর এঁটে দিয়েছেন তাদের অন্তরে। ফলে তারা বুঝতেও পারেনি। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৯৩)

হাদিস শরিফে আছে, ‘জেনে রেখো, মানুষের দেহের মধ্যে এক খণ্ড মাংসপিণ্ড আছে, যখন তা সংশোধিত হয়, তখন গোটা দেহ সংশোধিত হয়ে যায়। আর যখন তা দূষিত হয়, তখন পুরো দেহটাই দূষিত হয়ে যায়। মনে রেখো, সেটাই কলব। ’  (বুখারি ও মুসলিম)

রাসুল (সা.) আরো ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের শরীর বা আকৃতির দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের কলবের দিকেই তাকান। ’ এরপর রাসুল (সা.) কলবকে দেখানোর জন্য নিজ আঙুল দিয়ে নিজের বুকের দিকে ইশারা করলেন। (মুসলিম শরিফ)

কলব বা অন্তর সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কলব হলো সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাদশা। ’ (মেরকাত)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘মানুষ যখন কোনো পাপ কাজ করে তখন তার কলবের মধ্যে কালি পড়ে যায়। ’

আরেকটি হাদিসে আছে, ‘শয়তান প্রতিটি মানুষের কলবের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। যখন সে জিকির শুরু করে, তখন সে পালিয়ে যায়। আবার যখন আল্লাহর জিকির থেকে অমনোযোগী হয়, তখন শয়তান আবার কলবে ফিরে এসে ওয়াসওয়াসা তথা কুমন্ত্রণা দিতে থাকে।

উল্লিখিত কোরআনের আয়াত ও হাদিস থেকে বোঝা যায়, মানুষের কলবের পরিচ্ছন্নতা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মোক্ষম পথ। অন্তরের অপরিচ্ছন্নতা মানুষকে কুফরি পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাই উলামায়ে কেরাম তালিমের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন। জাহেরি শিক্ষার পাশাপাশি বাতেনি শিক্ষা তথা আত্মশুদ্ধির প্রতি অতীব গুরুত্বারোপ করেছেন। দারুল উলুম দেওবন্দের মূল শিক্ষানীতির সঙ্গেই আত্মশুদ্ধির বিষয়টি সন্নিবিষ্ট।

আত্মশুদ্ধি বা রুহানি শিক্ষার ব্যাপারে রাসুল (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও সলফে সালেহিনের বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। উপমহাদেশের অন্যতম ইলমি ও রুহানি ব্যক্তিত্ব ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) বসুন্ধরা, ঢাকায় ইসলামী উচ্চশিক্ষা ও আত্মশুদ্ধি কোর্সের সমন্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে। ‘মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশ’ নামে এই প্রতিষ্ঠান অতি স্বল্প সময়েই ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিম বিশ্বে খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইসলামী উচ্চশিক্ষা বিষয়ে যেমন প্রতিষ্ঠানটি সবার কাছে সমাদৃত, তেমনি আধ্যাত্মিকতা ও আত্মশুদ্ধির  মেহনতের ক্ষেত্রেও এটি অনন্য হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

হজরত ফকিহুল মিল্লাত (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা আওলাদে রাসুল সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর সরাসরি ছাত্র। তিনি ছিলেন শায়খুল হাদিস হজরত জাকারিয়া (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক দীক্ষাপ্রাপ্ত। তিনি ছিলেন হাকিমুল উম্মত হজরত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর খলিফায়ে আজল হজরত হারদুয়ী (রহ.)-এর খলিফা। তিনি আত্মশুদ্ধির বিশুদ্ধ চর্চার জন্য ‘মারকাযুল ইসলামী’তে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ‘খানেকাহ’। যার নাম দেওয়া হয়—‘খানেকাহে এমদাদিয়া আশরাফিয়া আবরারিয়া। ’ প্রতিদিন মারকাযে আত্মশুদ্ধির কোর্স হিসেবে, সাহরির সময় জিকির, সুন্নতি জিন্দেগি গড়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান ও ছাত্রদের যাবতীয় তত্ত্বাবধান করা হয়। প্রতি আরবি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার আত্মশুদ্ধিমূলক আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে প্রতিবছর রবিউল আওয়ালের প্রথম বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুই দিনব্যাপী ‘এহইয়ায়ে সুন্নাত ইজতিমা’র আয়োজন করা হয়। এটি বিশেষভাবে আলেমদের জন্য আয়োজন করা হয়। এই ইজতিমায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হজরতের খলিফা-মুরিদানসহ উলামায়ে কেরাম, মসজিদের খতিব ও ইমামগণ অংশগ্রহণ করেন। দুই দিনব্যাপী ইজতিমায় আগত শত শত উলামায়ে কেরামের জন্য এই প্রতিষ্ঠানে শবগুজারি, ইসলাহি বয়ান, দরুদ ও জিকির, সুন্নত মতে আমলের প্রশিক্ষণ ইত্যাদির নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

গত ১০-১১-২০১৫ হজরত ফকিহুল মিল্লাত (রহ.) জান্নাতবাসী হয়েছেন। তখন থেকে তাঁর সুযোগ্য সাহেবজাদা হজরত মাওলানা মুফতি আরশাদ রহমানি সাহেব হুজুরের অনুকরণেই সার্বিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেকটি বিষয়ে তিনি সফল কাণ্ডারীর ভূমিকায় কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছেন। তিনিও পিতার মতো হজরত হারদুয়ী (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা। রুহানি দীক্ষা ও আত্মশুদ্ধিবিষয়ক হজরত ফকিহুল মিল্লাত (রহ.)-এর মহান মিশনও সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। হজরত ফকিহুল মিল্লাত (রহ.)-এর ইন্তিকালের পর ১৪৩৭ হিজরি ‘এহয়ায়ে সুন্নাত ইজতিমা’ অনুষ্ঠিত হয় অত্যন্ত সফলভাবে। এটি ছিল মুফতি আরশাদ রহমানি সাহেবের তত্ত্বাবধানে প্রথম ইজতিমা। ১৪৩৮ হিজরির ইজতিমাও গতকাল থেকে চলছে। প্রথম দিনেই উপস্থিত হয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গণ্যমান্য ও বরেণ্য প্রায় ১৫০০ উলামায়ে কেরাম। মারকায কর্তৃপক্ষও দূর-দূরান্ত থেকে আগত মেহমান উলামায়ে কেরামের জন্য যথাসম্ভব উন্নত মেহমানদারি ও খেদমতের ব্যবস্থা করেছেন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক আল-আবরার

আআ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ