আবদুর রহমান ফারুকী
এক____
সকাল সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো ব্যস্ত পায়ে হেঁটে চলছে। কেউ অফিস, কেউ স্কুল, কেউবা দোকান পাটে। ব্যস্ত রাস্তার ব্যস্ত গাড়িগুলোও ছুটে চলছে ব্যস্ত চাকায়। সেরকমই ব্যস্ত এক পথ ধরে ছেলেটি হেঁটে চলছে, তবে ছেলেটি অতটা ব্যস্ত না। তার মধ্যে কোনো কিছুরই তেমন ব্যস্ততা নেই। না অফিস, স্কুল না দোকান পাট। ধীর পায়ে হেটে চলছে। গায়ে একটি ঢিলেঢালা সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামাও সাদা। কিন্তু দুই সাদার মাঝে খানিকটা তফাৎ। সবার চোখ এড়িয়ে না গেলেও ছেলেটির চোখ অন্তত এড়িয়ে গেছে। ডান পকেটটা একটু ছিঁড়ে ঝুলে আছে। কারোর সাথে মারপিটে এ দশা..!!? কে জানে। মাথায় বাকা করে বসানো পাঁচকল্লি টুপি। এক পাশের কাধে ঝুলে আছে স্কুল ব্যাগ। যদিও সে স্কুলে যাচ্ছে না। ধীর পায়ে হেটেই চলছে....
-ঐ মোল্লা..!!! সাইড লন;
পেছন থেকে ভেসে এলো কর্কশ এক কণ্ঠ। এটা যে রিকশাওয়ালা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই পেছনে আর না তাকিয়ে এক পাশে সরে গেলো। সে ঠিক মতই সরেছিল কিন্তু রিকশাওয়ালা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে বুদ বুদ করতে লাগল ...‘মোল্লায় জেমনে হাডতাসে.!! মনে হইতাসে বাপের টেকা দিয়া রাস্তা কিন্না লইছে..। এ দেশের মোল্লাগো জালায় আর থাকা গেল না। কেল্লিগা জে....’
দ্রুত প্যাডেল চালিয়ে সামনে চলে যাওয়ায় বাকিটা আর শোনা গেলো না। ছেলেটা ধীর পা আর থামিয়ে দিলো না। যেমন চলছিল তেমনি চলতে লাগল। শুধু মাথাটা একটু নুইয়ে পড়লো। সামনের মোড় পেড়িয়ে বামের গলি ধরলো একটা। আর একটু এগুলেই মদরাসা ভবন। হাত ঘড়ি দেখলো, ক্লাস শুরু হতে আর পনেরো মিনিট। দ্রুত পা চালালো। উলটো দিক থেকে তিনটে ছেলে আসতে লাগল, আসলে দু'টো ছেলে আর আরেকটি যে মেয়ে ভালো মতন না তাকালে বুঝার উপায় নেই। জিন্স-টি শার্ট পরা। ছেলে দু'টোর চুল স্পাইক, হাতে ব্রেসলেট আরো কত কী..। পাশ কাটানোর সময় ওদের বাঁকা চাহনি আর বাঁকা হাসি দেখেও না দেখার ভান করলো। আরো দ্রুত পা চালালো এবং একটুপর মাদরাসা ভবন।
দুই_____
ইমরান, ছেলেটির নাম। লালবাগের ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকে। ভাই-নিষাদ, বোন-নিনিত, বাবা-মিস্টার রিফাত আমান, মা-মিসেস আমান। ভাই বোন দু'জনই স্কুলে পড়ে। শুধু ওই মাদ্রাসায় পড়ে। বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো, কেনো শুধু ওই মাদরাসায় পড়ে?!। বাবা কিছু বলে নি, চুপ করেছিল। মা থেকে বাবাই একটু বেশি আদর করেন। মা আদর করে না শাসন করে.!!? বুঝতে পারে না সে। মাদরাসা আজিমপুরে। নাহুবেমির জামাতের ছাত্র। বাসা থেকে মাদরাসাই ভালো লাগে। কতশত ছাত্র, নিয়মিত ক্লাস, ছোট্ট লাইব্রেরি। আর বাসায় বাবা চলে যায় সেই ভোরে। সারাদিন মায়ের বকাঝকা আর ভাই বোনদের ক্যাচর ম্যাচর। একটুও ভাল্লাগে না। তাই মাদরাসাতেই অনেকটা সময় কাটায়।
ক্লাস শুরুর দশ মিনিট আগে এসে পৌছলো। এখন অবধি সবাই আসে নি। দশ মিনিট পর সবাই আসলো এবং আরো দশ মিনিট পর উস্তাদ আসলেন।
তিন_____
বিকেল চারটায় বাসায় পৌঁছলো ইমরান। সূর্য্যের উত্তাপন, রাস্তাঘাটের অসহ্য যানজট আর ক্ষুধাতৃষ্ণা, তিনটের চাপে একেবারে নুইয়ে পড়েছে। বাসায় ঢুকেই এক পাশে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে ডাইনিং টেবিলের এক কোণে বসে পড়লো। মিসেস আমান নিষাদ-নিনিতকে খাওয়াচ্ছে ভাত আর কী জানি। ক্লান্ত কণ্ঠে ইমরান....
-- মা.!!! খাবার দাও তো!. অনেক ক্ষুধা লেগেছে। রাস্তায় যা গরম আর...'
-- রান্না ঘড়ে সব আছে, বেড়ে খা গিয়ে'; ইমরানকে মাঝ পথেই থামিয়ে দিল।
-- মা..!!! তুমি একটু এনে দাও, উঠতে মন চাচ্ছে না'
-- .......
-- মা..!!! দেও না..!!!'
-- বড় কি বাতাসে হয়েছিস নাকি অন্যকিছুতে..!!?? মাথায় কি কিচ্ছু নাই!?? খেয়ে খেয়ে শরীরটা কী বানিয়েছিস!!?? আয়নায় দেখেছিস একবার..!?? দেখছিস না ওদের খাওয়াচ্ছি, যা বেড়ে খা!! বুড়ো খাসি কোথায়কার!!'
কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। আলপিন দিয়ে ফুটো করা বেলুনের মত চুপসে গেলো। তার বিশ্বাস এবং দৃঢ় বিশ্বাস, আম্মু এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছে। সে বাতাসেও বড় হয় নি অন্যকিছুতেও না। বড় হয়েছে বাবা-মা'র আদর শাসনে। আর আয়না বলতে হবে কেনো.!!?? সে মোটেও মোটা না। আর ‘বুড়ো খাসি’ তো বুঝলো... ‘কোথায়কার’ মানে কী??!! সে খুজেও পেলো না। হয়তো এটার মানে নিয়ে চিন্তা করতে করতে চেহার ছেড়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।
ক্রলিং বেল বেজে উঠলো। এ সময় বেজে উঠা মানে মিস্টার আমান। নিনিত দৌড়ে গেলো। একটু পর বাবার কোলে নিষাদ,পরমানন্দে একটা ললিপপ খাচ্ছে।
-- খাওয়ার সময়ে কেনো যে চকলেট দাও!!?? বুঝি না?!? এখন আর খাবে??!'
-- থাক না!!! বাচ্চাকাচ্চা একটুআধটু চকলেট খাবেই, এখন যাও..খাবার নিয়ে এসো'।
-- বসো, আনছি '
-- কিরে..!! লেখাপড়ার খবর কী তোর??!!';
ইমরানের উলটো দিকে বসতে বসতে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
-- এইতো, বাবা!! আলহামদুলিল্লাহ।
-- ঠিক মত মাদ্রাসায় যাচ্ছিস তো??!!'
-- হুম,
-- লেখাপড়া করছিছ তো??!
-- হুম
-- শুন!! মন দিয়ে করবি আর হ্যা, কোনোকিছু দরকার পড়লে মাকে না, আমাকে বলবি। তুই তো জানিস তোর মা একটু....
-- আচ্ছা বাবা..!! ঠিক আছে; আবার খাবারে মন দিলো।
মিসেস আমান টেবিলে প্লেট রাখতে রাখতে ইমরানকে জিজ্ঞেস করলো- 'আর কিছু লাগবে তোর?? বাবা!!'।
অনেকটা বিস্ময়ের সাথেই জানিয়ে দিলো তার আর কিচ্ছুই লাগবে না।
চার____
প্রথমা সূর্যকিরণ চোখের পাতায় পড়তেই কুচকে ফেলল চোখ। হাত দিয়ে ঢেকে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। একটুপর আবার। হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করলো আবার, কাজ হলো না। কিছুসময় এ পাশ ও পাশ করে বাধ্য হয়ে বিছানায় উঠে বসলো। আধোবোজা চোখ টেবিল ঘড়িতে পড়তেই কপালে উঠে গেলো চোখজোরা।অবশ্যি তখন আর আধবোজা নেই। আটটে বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট, ন'টায় তার ক্লাস। সে আরো দু'মিনিট এভাবে তাকিয়ে রইল। ভাবছে... ফজর পড়ে সে সাতটায় এলার্ম দিয়েছিল, তাহলে বেজে উঠলো না কেনো??!!! আর বেজে উঠলেও সে উঠতে পারলো না কেনো.!!?? প্রতিদিন উঠে আজ কেনো পারলো না??!!!। এত `কেনো’র উত্তর দেয়ার সময় নেই, দ্রুত বাথরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হতে হতে আরো পাচ মিনিট লেগে গেল। বাসার গেইট থেকে বেরিয়েই গুলিস্তান-ধামরাই'র একটা রঙচটা বাস পেয়ে গেলো। ইমরান তো মহা খুশি, দৌড়ে বাসে উঠতে যাবে...বাসের গেইটে এক পা দিয়ে ফেলেছে অমনি হেল্পারের বাধায় অন্য পা আর দিতে পারলো না।
-- কই জাইবেন..!? হুজুর!!
-- আরে...!! আজিমপুর,
-- তিরিশ টাহা ভাড়া, জাইবেন..!???
-- বলেন কি!! পাঁচ টাকার ভাড়া ত্রিশ টাকা!!
-- হ..!! পারলে উডেন নাইলে সরেন; বাসের গায়ে দু'টা থাপ্পর দিতেই সামনে এগিয়ে গেলো। আর কিছু বলারও সুযোগ দিলো না। মনটা একেবারেই ভেঙে গেলো। কী করবে এখন!!?? এমনিতেই আজ উঠতে দেরি, এর উপর বাস পেয়েও পেলো না। আরো পাঁচ মিনিট এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে যখন আর কোনো বাস এলো না, এমনকি রিকশাও পেলো না। অগ্যতা হাটা শুরু করলো। হাটতে হাটতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে চলে এলো। একটু থামল। সামনে দেখলো... সেই বাসটিতে কলেজ স্টুডেন্টস আর কিছু সুট-টাইওয়ালাকে ডেকে ডেকে উঠাচ্ছে। সেই হেল্পারটি। ইমরানের একবার মনে হল, হেল্পারটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, এমনটা কেনো করলেন!?? আমার সাথে!!?? কীবা দোষ ছিল আমার!?? আমার মাথায় টুপি বলে!!?? গায়ে পাঞ্জাবী বলে??!! নাকি???!। কিন্তু বলতে পারলো না। কেনো পারলো না..কে জানে।
মাদরাসায় পৌছে দেখলো, বেশ ক'টা ক্লাস ইতোমধ্যে শেষ। ধপ করে নিজের জায়গায় বসে পড়ল। জীবনের এই প্রথম তার ক্লাস মিস হলো।
পাঁচ____
যোহর নামাজ পড়ে বাসার পথ ধরলো। মনস্থির করেছে বাস বা রিকশা... কিছুতেই আজ চড়বে না। হেঁটেই যাবে। অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে...। হাঁটতে হাঁটতে আজিমপুর গার্লস স্কুলে চলে এসেছে। একটু বেশিই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো হয়ত, ফুচকা মুখে দিতে যাবে এমনি এক স্কুল মেয়ের সাথে হঠাৎ ধাক্কা। হাত থেকে ফুচকার বাটি পড়ে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লো। মুখে যেটা দিতে যাচ্ছিল সেটাও পড়ে গেলো, আর মেয়েটা পড়তে গিয়েও পড়লো না। ইমরান নিজেও ভাবতে পারে নি এমন কিছু একটা ঘটবে।
আগুনঝরা চোখে পেছনে তাকালো মেয়েটি।
-- আপু!! আম...আমি খুবই দুঃখিত, ইচ্ছে করে করি নি, কেমনে কেমনে জানি...।
-- কেমনে কেমনে জানি না..!!???। তোর সাহস তো কম না!!?
-- খুবই দুঃখিত আমি.., ইচ্ছে করে করি নি।
-- ইচ্ছা কইরা করছ নাই না...!!? মাইয়া মানুষ দেখলেই খালি ধাক্কা খাইতে মন চায়!!??; চিৎকার করে বলল মেয়েটা, এখনো আগুন ঝরছে।
-- বিশ্বাস করুন..!! আমি...আমার ভুল হয়ে গেছে।
স্কুলছাত্রীর চিৎকারে বেশ কিছু মেয়ে ছেলে জড়ো হয়ে গেল, ঘিরে ফেলল তাদের। চুল স্পাইক করা এক ছেলে এগিয়ে এলো...
-- কী হয়েছে রে??! জেরিন!! (আসল নাম হয়তো জরিনা হবে)
-- আরে দেখিস না, এ হুজুরটা আমাকে ধাক্কা দিছে, আমি ফুচকা খাচ্ছিলাম।; নেকামো সুরে বলল।
-- অই...!!! ধাক্কা দিলি ক্যাঁ!!??
-- আম.. আমি ইচ্ছে করে দি...দিইই নি ; আমতা আমতা করতে লাগল।
সামনের চুল বড় আর দু' পাশের চুল ছাটা এমন একজন বলে উঠলো..
-- আরে.!! হুজুর না!! মাইয়া দেখলেই খালি ... ।; বাকিটা শুনে মাথা নিচু হয়ে গেলো ইমরানে।
আরেকজন..
-- পুলিশে দিয়ে দিই, ইভটিজিং কেস।
গুন্ডার মতন আর একজন শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে...
-- আমরা থাকতে পুলিশ কিসের রে!!? চল না..সাইজ করে দেই বেটাকে।
সিরিয়াস কিছু একটা ঘটে যেতো, রাস্তা দিয়ে স্থানীয় এক মুরুব্বী যাচ্ছিলেন। তিনিই সব মিটমাট করে দিলেন।
ছয়_____
বাসায় ঢুকেই ব্যাগটা এক কোনে ছুড়ে ফেলে বিছানায় চিংহয়ে শুয়ে পড়লো। সিলিং ফ্যানের দিকে দৃষ্টি স্থির। ভেতরে ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে না। অন্যকেউ হলে ঠিকই ধাউ ধাউ করে জ্বলতো, মেয়ে আর হেল্পারকে শায়েস্তা করার ফন্দি আটতো। কিন্তু ইমরান সব দোষ নিজের উপর গুটিয়ে নিয়েছে। নিজের বোকামো আর নির্বুদ্ধিতায় আজ এ পরিণাম। তবে...এসব শুধু তার সাথেই কেনো ঘটতে হবে..!?? আর অন্যকারোর সাথে ঘটে না কেনো!!?? সে হুজুর বলে!??? মোল্লা বলে??!! নাকি অন্যকিছু বলে??!! এসব ভাবতে ভাবতে চোখের কোনে ঝিলিক দিয়ে উঠলো একটুকরো পানি।
-- ইমরান!!! কই রে তুই??!; দরোজা খুলে হঠাৎ উকি দিলো মিসেস আমান।
-- জী আম্মু!! চোখের কোণ মুছতে মুছতে জবাব দিল।
-- যা তো! এ বাজারগুলো নিয়ে আয়! টেবিলের উপর বাজার ব্যাগ আর লিস্টি ছুড়ে মারলো।
-- আম্মু!! আজ ভাল্লাগতাসে না। সবেমাত্র বাইরে থেকে আসলাম।
-- ঘরে কোনো বাজার সদাই নাই, না গেলে আজ দুপুরে খাওন পাবি না।
-- তুমি একটু নিচের দারোয়ান চাচাকে ঢেকে দাও না, উনিই সব এনে দিবে।
-- তুই কি নওয়াবের জাদা নাকি মিনিস্টারের পোলা!!?? হ্যাঁ!!?? বাইরে যাইতে পারবি না। বাপের বয়সি একজনকে আদেশ করছ!!?? ঘরে বসে বসে বুড়ো খাসি হচ্ছিস..! যা তাত্তাড়ি যা!!
-- আম্মু!! তুমি সব সময় আমার সাথে এমুন করো!. একটুও আদর করো না। সারাদিন খালি বকা আর ঝকা। আজ আমার মন ভীষণরকমের খারাপ। জানো!!?? কেনো এত খারাপ!!??. একটা বার জিজ্ঞেস করেছ!?? হাহ!! আর জিজ্ঞেস করবেই বা কেনো!??. তুম....তুমি যাও তো। আমি যেতে পারবো না, এগুলো সে বলতে গিয়েও বলল না। কেনো জানি চুপ করে রইল। ওইখানে আম্মু রান্নাঘরে গিয়েও বকবক করেই যাচ্ছে.. ‘বাপে লাই দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে ফেলেছে,বাইরে যাইবে না!! ওইখানে যাইবে না!! হেন করবে না!! তেন করবে না..পাইছে কী!?? সারাদিন পায়ের উপর পা তুলে খাবে!?? আর ঘুমাবে!?....’ স্থির হয়ে বসে আছে। নড়ছেও না, চড়ছেও না। বাজার ব্যাগ আর লিস্টির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণে আবারো ঝিলিক দিয়ে উঠলো, পানি। এবার আর মুছলো না, বাজার ব্যাগ আর লিষ্টি নিয়ে দরোজার দিকে রওনা দিল।
সাত____
ঘুমটা হঠাৎই ভেঙে গেলো। বার কয়েক চোখ পিট পিট করে দেয়াল ঘড়ি দেখলো ইমরান। চারটে বেজে সাতত্রিশ। কেনো ভাঙলো..!? টের পেলো তখনি। ক্ষুধা লেগেছে অনেক। সকালে বাজার থেকে আসার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল???!! খেয়াল নাই। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে চলে এলো। সব খাবার টেবিলে বাড়া। গ্লাস থেকে ঢকঢক করে খানিকটা পানি খেল। তখনি কানে আসলো আম্মুর উচ্চকণ্ঠ। ওনাদের বেডরুম থেকেই আসছে। আধো খাওয়া গ্লাসটা নামিয়ে রেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো। কান আর পাততে হলো না। কাছে যেতেই শুনতে পেল,
-- .... আমি আর পারছি না!!! তুমি এর একটা বিহিত করো!!
-- আহ!! হয়েছেটা কী!!?? বলবে তো,
-- বাজারে যেতে পারবে না!! ভাত বেড়ে খেতে পারবে না!!? হেন করবে না তেন করবে না!!! ও কি নওয়াবের জাদা!!??
-- আরে!! ও কিছু না! এ বয়সের ছেলেমেয়েরা একটুআধটু এমন করেই।
-- না না..!! আমার আর ভাল্লাগতাসে না এসব।
-- তো কী করতে চাও তুমি!!??
-- ওকে... ওর মায়ের মত কোথাও ফেলে এসো..!!
-- আহ!! আস্তে বলো। শুনে ফেলবে তো!!.।
-- শুনুক!! তাতে আমার কী!?? কাল পরশুর মধ্যে একটা কিছু করো নাইলে...
-- আহ!! তুমি থামবে।
হঠাৎ দুলে উঠলো ইমরান। হাত দিয়ে দেয়াল খামচে ধরে ফেলল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। একবার মনে হল এখনো ঘুমিয়ে আছে সে। এগুলো স্বপ্ন, সব স্বপ্ন। কিন্তু না.. বাস্তবেই সে শুনেছে এবং ঠিক শুনেছে। তাহলে... তাহলে কি তার মা...!! আবারো দুলে উঠলো, ভীষণভাবে। আর ভাবতে পারলো না, এক পা দু পা করে রুমে চলে এলো। দরোজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতেই থাকলো।
আট______
সাত সকালে মিস্টার আমান ছেলের দরোজার সামনে এসে ডাক দিল..
-- কিরে!!? কত আর ঘুমাবি??! মাদরাসায় যাবি না??!!
দরোজায় টোকা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করলো খোলা। উকি দিয়ে দেখলো, ঘরের সব কিছুই ঠিক শুধু ইমরানটা নেই। এত সকালে তো কোথাও যাওয়ার কথা না। অন্যান্য রুম,ছাদ, বেজমেন্ট, গ্যারেজ সম্ভাব্য সবখানেই তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। নেই এবং নেই। আস্তে ধীরে শংকা এবং আশংকার একটা ছাপ ফুটে উঠতে লাগল মিস্টার আমানের মুখে।
-- এত্তো পেরেশান হওয়ার কী আছে??!! গেছে হয়তো কোথাও, হাই তুলতে তুলতে মিসেস আমান
-- তুমি চুপ করো!! রাতে বলেছিলাম, ওসব বলতে না। শুনলে না। ক্লান্ত আর খানিকটা শংকিত মিস্টার আমান একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লো। হাপাচ্ছে অনেক। দর দর করে ঘাম ঝরছে প্রচুর। পানি খাওয়ার জন্যে গ্লাস নিতে গিয়ে দেখলো... সেই আধো খাওয়া গ্লাস দিয়ে একটা হলুদ চিরকুট চাপা দেয়া। তুলে নিয়ে দেখল, গুটি গুটি অক্ষরে লেখা -
" 'ওদের'নিয়ে তুমি ভালো থেকো "
মিস্টার আমানের হাত থেকে চিরকুটটা ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ে গেলো।
নয়_______
এ ঘরে আর কোনোদিন ইমরান ঘুমাবে না। মিসেস আমানকে আর বিরক্ত করবে না। আজিমপুরের সেই রাস্তা দিয়ে আর কোনো ইমরান হেঁটে হেঁটে যাবে না, ধীর পায়েও না। কোনো রিকশাওয়ালা পেছন থেকে 'মোল্লা' বলে আর তাকে ডাক দিতে পারবে না। কেউবা বাঁকা ঠোটে কেউবা বাঁকা চোখে তাকাতে পারবে না। সেই আধোফুসকা খাওয়া মেয়েটার সাথে আর কোনো ইমরানের আচমকা ধাক্কা লাগবে না। হেল্পার আর কোনোদিনই বাধা দিবে না। চলে গেসে সে। অনেকদূর চলে গেসে। কোথায় গেসে.!!?? কে জানে। কেনো গেছে??!! হয়তো মা কে খুঁজতে বেড়িয়েছে। মা কে কি খুঁজে পাবে আর???!! হয়তো পাবে।
আরআর