আমিন আশরাফ : শুক্রবার দশটা দশ মিনিটে তিনি চলে গেলেন। স্মৃতি-বিস্মৃতির অফুরন্ত এক কায়া রেখে গেলেন। তাঁর আত্মা দেহত্যাগ করে উর্ধ্বজগতে চলে গেলেও তিনি বেঁচে থাকবেন ততদিন যতদিন কওমি মাদরাসা বেঁচে থাকবে। তার অবদান স্বীকার করবে তালিবুল ইলমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। তাকে স্মরণে রেখে জাতি কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে অনুপ্রেরণা পাবে।
৭৯ বছর বয়সী মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি সমস্যা, ডায়বেটিকস ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। গত সপ্তাহে তাঁকে প্রথমে খিলগাঁওয়ের খিদমাহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ডাক্তারদের পরামর্শে হলি ফ্যামেলি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।
মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদী ১৯৩৭ সালের বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার সহবতকাঠি গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নাসিম উদ্দীন। তিনি ৫ ভাই এক বোনের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়।
আবদুল জব্বার ১৯৬১ সালে রাজধানীর বড়কাটারা মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস পাস করেন। তিনি ওই মাদ্রাসায় শিক্ষকতাও করেন। পরে যাত্রাবাড়ী জামিয়া মাদানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন এবং সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন, মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, ফরজী হুজুর প্রমুখ মনীষীগণ। তিনি মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. এরও স্নেহধন্য ছাত্র ছিলেন। বেফাকে যোগদানের আগে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ঢাকা মহানগরের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন কওমি মাদ্রাসার এ আলেম।
সাংসারিক জীবনে এ আলেম তিন মেয়ের জনক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী, চার ভাই ও এক ও ১ বোন রয়েছেন।
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সুদীর্ঘ ৩৮ বছর যাবত। এর মাঝে তিনি বেফাকের বিভিন্ন পদে থেকে তিনি সুচারুপে তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সর্বশেষ তিনি বেফাকের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।
মাওলানা আবদুল জব্বার মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনেক মাদরাসার পরিচালনা কমিটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়াও তিনি ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। সাধ্যনুযায়ী এর বিপক্ষে রাজপথে আন্দোলনও গড়ে তোলেছেন। মাস দুয়েক আগে বেফাকের উদ্যোগে সারাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া জঙ্গিবাদ বিরোধী মানবন্ধন সফলে তার অসামান্য অবদান রয়েছে।
ছোটবেলা ক্লাসের দ্বিতীয় শেণিতে পড়ার সময় এই নামটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। বেফাকের বাংলা বইয়ে তার রচিত বাচ্চাদের উপযোগী অনেক লেখা তিনি লিখেছেন। তার লিখিত অনেকগুলো সময়পোযুগি বইও প্রকাশিত হয়েছে, ১. ইসলাম ও আধুনিক প্রযুক্তি ২. মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ৩. ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ও তাদের গৌরবময় ইতিহাস ৪. ইসলামে নারীর অধিকার ও পাশ্চাত্যের অধিকার বঞ্চিতা লাঞ্ছিতা নারী।
ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন নিরঙ্কার মানুষ ছিলেন। সবার সঙ্গে তিনি খুব অল্প সময়ে মিশে যেতে পারতেন। নম্র ও ভদ্র হিসেবে তার সুনাম ছিল। আমার জানা মতে, ঢাকা বা ঢাকার বাইরে মাওলানা আবদুল জব্বারের নামে কোন ব্যাংক একাউন্টও নেই। চা রুটি আর নুনতা বিস্কুট খেয়ে তিনি বেফাককে শক্ত ধরে রেখেছিলেন।
তাঁর সামগ্রিক চিন্তা চিন্তা চেতনা, ধ্যান-জ্ঞান ছিল কওমি মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি ও সাফল্য। কওমি মাদরাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি নিয়ে অনেক সময় অনেক জন কাজ করেছেন, কিন্তু সর্ব প্রথম বেফাকের সাবেক সভাপতি আল্লামা নুরুদ্দীন গহরপুরী রহ এর নির্দেশে তিনি কাজ শুরু করেন। কওমি মাদরাসার স্ব্রীকৃতি আমরা কেন চাই নামে তিনি একটি পুস্তকও রচনা করেন। সরকারি দপ্তরে তিনিই সর্বপ্রথম কাগজ পত্র দাখিল করেন। বর্তমান প্রস্তাবিত কওমি সনদের সিলেবাস এটা তার হাতেই তৈরি। কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির তিনিই ছিলেন প্রথম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ নামটা উচ্চারণের সময় ভেসে ওঠে মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বারের মুখ। বেফাকের প্রতিটি মাটির কণায় তার অবদান রয়েছে। তাঁর আগলে রাখা প্রতিষ্ঠান বেফাকের অধীনে কিয়ামত অবধি জাতির সন্তানরা শিক্ষা অর্জন করবে। আবদুল জব্বারের ব্যাপারে তাদের অধিকার রয়েছে যে, তারা এ মহান কর্মবীর সম্পর্কে জানা। সে জন্য বেফাকের পরবর্তী দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ রাখা যায়, প্রয়াত এ মহাসচিবের জীবনী যেন বেফাকের পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
বর্তমান সময়টা যেহেতু গ্লোবালাইজেশনের যুগ সে হিসেবে দেশে বিদেশের জ্ঞান অন্বেষণকারীরা যেন ইন্টারনেটে সার্চ করে তার সম্পর্কে জানতে পারে সে জন্য বেফাকের উদ্যোগে বাংলা, আরবি, উর্দু ও ইংরেজিতে তার জীবনী উইকিপিডিয়ায় অন্তর্ভক্ত করা যেতে পারে।
বেফাক কর্মকর্তারা যদি এ সামান্য কাজে অবদান রাখেন তবে ইতিহাস তাদেরও কখনো ভুলে যাবে না।
আরআর