আওয়ার ইসলাম: বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও বেফাক সভাপতি শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেছেন, দেশের অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষাবোর্ড বেফাকসহ শীর্ষ উলামায়ে কেরামের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ও মতামতকে পাশ কাটিয়ে কওমি মাদ্রাসা সনদের মান নির্ধারণের মতো অতিব গুরত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে ব্যক্তি অভিপ্রায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই। বিতর্কিত কারো প্ররোচণায় সরকার কওমি সনদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইলে, সেটা আলেম সমাজ ও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ তৌহিদী জনতা মেনে নিবে না।
তিনি ২৭ সেপ্টেম্বর ও ৯ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, কওমি সনদের বিষয়ে বিশেষ ব্যক্তির নয়, বরং আলেম সমাজের পরামর্শ গ্রহণ করে পদক্ষেপ নিন। তিনি বলেন, প্রতিনিধিত্বহীন ব্যক্তির ভ্রান্ত পরামর্শে সরকার কওমি সনদের বিষয়ে ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে আলেমসমাজসহ তৌহিদী জনতার কাছে সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এতে করে জনগণের মনে এমন ভাবনা জাগার আশংকা আছে, তবে কি স্বাধীনভাবে ধর্মীয় শিক্ষাক্রম পরিচালনা এবং ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকারেও সরকার হস্তক্ষেপ করতে চাইছে? জনগণের মনে এমন সন্দেহ জোরালো হলে, দেশের স্থিতিশীলতার জন্যে সেটা মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। এমনটা হোক, আমরা কখনোই চাই না। তিনি কারো নামোল্লেখ না করে বলেন, শুরু থেকেই একজন ব্যক্তি কওমি শিক্ষার অনেক ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।
বেফাক সভাপতি বলেন, কওমি শিক্ষার সনদের মান থাকার যৌক্তিক বিষয়টা সরকার আন্তরিকভাবে অনুভব করে থাকলে, শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের উচিত, কওমি মাদ্রাসার কেন্দ্রীয় বোর্ড বেফাকের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল আলেম সমাজের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করা। তিনি বলেন, কওমি সনদের মান নির্ধারণের বিষয়ে বেফাকসহ শীর্ষ আলেমদের পরামর্শক্রমে ২০১২ সালের এপ্রিলে কমিশন গঠনের আগেই মাদ্রাসাসমূহের স্বকীয় বৈশিষ্ট, স্বাধীন শিক্ষাক্রম পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাসহ দেওবন্দী নীতি-আদর্শের সুরক্ষার জন্যে সরকার সংশ্লিষ্ট মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ ও মাওলানা রূহুল আমীনের মধ্যস্থতায় ঐকমত্য সিদ্ধান্তে ৬টি পূর্ব শর্ত এবং কমিশন গঠনের জন্যে ২১ জনের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর কোনটাই না মেনে পছন্দের ১৭ জনকে দিয়ে কমিশন করে তখন থেকেই অদ্যাবদি একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তখন থেকেই সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত একটি মহল আমাদের সাথে অনেক প্রতারণা করে আসছে। কিন্তু তাদের বিতর্কিত ও ভ্রান্ত পরামর্শে সরকার কোনরূপ ভুল পদক্ষেপ নিলে, আমরা সেটা কেন মেনে নেব? সরকারের সাথে আলেম সমাজের ভুল বুঝাবুঝি ও দূরত্ব তৈরির ষড়যন্ত্র যারা চালাচ্ছে, সরকারের উচিত তাদেরকে অনতিবিলম্বে পরিত্যাগ করা।
বুধবার (১২ অক্টোবর) বেফাক শীর্ষ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে আল্লামা শাহ আহমদ শফী এসব কথা বলেন।
বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন, বেফাক সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা মুফতী ওয়াক্কাস, মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার জাহানাবাদী, মাওলানা আব্দুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুর, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ফরিদাবাদ, মাওলানা হাফেজ নূরুল ইসলাম, মুফতী মাহফুজুল হক, মাওলানা সাজেদুর রহমান বি-বাড়ীয়া, মুফতী মিযানুর রহমান সাঈদ, মাওলানা জুনায়েদ আল-হাবীব, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী, মুফতী আবু ইউসুফ, মাওলানা মুনির আহমদ, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি, মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দীন ইকরাম, মাওলানা আহমদ উল্লাহ প্রমুখ।
বৈঠকে বেফাক নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহ ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার নীতি-আদর্শ ও ৮ মূলনীতিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করেই পরিচালিত হয়। দেওবন্দের ৮ মূলনীতির ৭ নম্বর মূলনীতি হলো ‘এর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সরকারের অংশীদারিত্ব ক্ষতিকর’। সুতরাং সরকারের কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আমাদেরকে আমাদের শিক্ষা সনদের মান দিলে, তা এই মূলনীতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আমাদের পূর্ব পুরুষদের কঠোর সাধনা, অবর্ণনীয় ত্যাগ এবং চোখের পানির ফসলই হচ্ছে এ সব কওমী মাদরাসা। খেয়ে না খেয়ে যে কোন মূল্যে এগুলোকে আগলে রেখে রক্ষা করাই ছিল তাঁদের মিশন। ধৈর্য্য, সহনশীলতা, নেক আমলের মানসিকতা, দেশপ্রেম, পিতা-মাতার আনুগত্য, মুুরুব্বী ও গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পারিবারিক ও সামজিক মূল্যবোধের প্রশিক্ষণ, মানব সেবা, সুশৃঙ্খল জাতি গঠনে আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সর্বোপরি আত্মার উৎকর্ষ সাধন করে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাই হচ্ছে কওমী মাদরাসা শিক্ষাধারার মূল সৌন্দর্য। শিক্ষা ও দীক্ষার এক অপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয় কওমী শিক্ষাব্যবস্থায়। সে কারণেই আমরা চাই, আমাদের এসব স্বকীয়তা যেন কোন প্রকার সরকারী নিয়ন্ত্রণের ফলে বিন্দুমাত্রও নষ্ট না হয়।
বেফাকের বৈঠক থেকে সরকারের প্রতি অনতিবিলম্বে গত ২৭ সেপ্টেম্বর জারি করা প্রজ্ঞাপন ও গঠিত কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে বলা হয় যে, বিভিন্ন নির্ভিরযোগ্য সূত্র থেকে আমাদের কাছে খবর আসছে, ৯ সদস্যের কমিটির কয়েকজন সদস্য মিলে দ্বিতীয় দফা আজকেও বৈঠকে বসেছে। অথচ বেফাকসহ দেশের আলেম সমাজ গত ২৯ সেপ্টেম্বর সর্বসম্মতিক্রমে সেই কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আলেম সমাজ ও তৌহিদী জনতার কাছে এই কমিটির কোন বৈধতা নেই। বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, সনদের মাননির্ধারণের বিষয়ে বেফাক সভাপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফীর চিঠি নিয়ে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সময় নির্ধারণ করে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে চিঠিটি হস্তান্তর করবে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে চিঠি হস্তান্তরের পর ৯ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে এবং পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে।
বৈঠকে সুবিধামতো অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বড় পরিসরে সাংবাদিক সম্মেলন করে ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বেফাকসহ শীর্ষ আলেমদের সাথে সনদের মান নির্ধারণের বিষয়ে একের পর এক যেসব প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক আচরণ করা হয়েছে এবং এর সাথে যারা যারা জড়িত, তার সবিস্তার জনসমক্ষে প্রকাশ করারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
আরো পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বেফাক
আরআর